অনিয়া জীবনের নতুন পথে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। প্রতিদিন সকাল তার জন্য নতুন শুরু নিয়ে আসে, কিন্তু পলাশের স্মৃতি এখনও মাঝে মাঝে তাকে পিছনে টেনে ধরে।
কিন্তু আজকের দিনটা অন্য রকম। অনিয়ার অফিসের কাজগুলো একটু আগেই শেষ হয়েছে। তাই, সে চিন্তা করে একটু হাঁটাহাঁটি করবে। শহরের কোলাহল থেকে দূরে, যেখানে সে কিছু সময় নিজেকে খুঁজে পাবে।
একটা ছোট ক্যাফে তার নজর কাড়ে। বেশ নিরিবিলি, তেমন কোনো ভিড় নেই। অনিয়া ভিতরে ঢুকে এক কোণায় বসে। ওয়েটার এসে জিজ্ঞেস করে, “আপনি কী নেবেন, ম্যাডাম?”
অনিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর বলে, “এক কাপ ব্ল্যাক কফি।”
কফি আসতে একটু সময় লাগে। এই সময়ের মধ্যে অনিয়া ভাবনার জগতে হারিয়ে যায়। তার মাথায় নানা স্মৃতি, প্রশ্ন, আর অসংখ্য অনুত্তরিত কথা ঘুরপাক খায়।
কফি আসার পর সে ধীরে ধীরে চুমুক দিতে থাকে। কফির তিক্ত স্বাদ তার ভেতরের তিক্ততাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। ঠিক এমন সময়, ক্যাফের দরজায় একটা পরিচিত মুখ দেখা যায়।
পলাশ।
হ্যাঁ, পলাশই। অনিয়ার হারানো দিনের সেই পলাশ। সে ক্যাফের ভিতরে ঢুকছে, কিন্তু একা নয়। তার পাশে একজন নারী, মুখে উজ্জ্বল হাসি। পলাশের চোখে আনন্দের ঝিলিক, তার মুখে হাসির আভা। সে কফি নিয়ে মহিলার সাথে মগ্নভাবে কথা বলছে।
অনিয়া স্থির হয়ে বসে থাকে। তার দৃষ্টি পলাশের দিকে আটকে যায়। সে দেখতে পায়, পলাশের চোখে কোনো দুঃখের ছায়া নেই, কোনো শূন্যতা নেই। যেন সে তার জীবনের নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে, যেখানে অনিয়ার কোনো স্থান নেই।
অনিয়া নিজেকে সংবরণ করে। তার হাতে ধরা কফির কাপ ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তার মনের মধ্যে আগুন জ্বলছে। সে বোঝে, পলাশ চলে গেছে, এবং সে আর ফিরে আসবে না।
অনিয়া মনে মনে নিজেকে বলে, “এটাই ছিল তার পথ। আমারও আমার পথ বেছে নিতে হবে।”
সে কফির শেষ চুমুকটা দেয়, এবং চুপচাপ ক্যাফে থেকে বেরিয়ে আসে। অনিয়ার হৃদয়ে একটা অদ্ভুত শূন্যতা কাজ করছে, কিন্তু সে জানে, এটাই তার জীবনের পরিণতি।
অনিয়া ক্যাফে থেকে বেরিয়ে আসার পর নিজের মধ্যে এক ধরনের অদ্ভুত শান্তি অনুভব করে। এতদিন ধরে যে দ্বিধা, যন্ত্রণার ভার সে বহন করেছে, আজ তা যেন একটু হালকা হয়েছে। পলাশের নতুন জীবনের সাথে তার আর কোনো সম্পর্ক নেই—এটা মেনে নিতে পেরেছে সে।
কিছুক্ষণ হাঁটার পর অনিয়া বাড়ি ফিরে আসে। দরজা খুলে ভেতরে ঢোকে, কিন্তু ঘরে প্রবেশ করেই তার চোখ যায় টেবিলের উপর রাখা খামটির দিকে। পলাশের লেখা সেই চিঠি।
অনিয়া খামটির দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তার মনে হয়, পলাশের সেই অমীমাংসিত কথাগুলো এই খামেই লুকিয়ে আছে। তবে সেগুলো জানার জন্য তার আর কোনো আগ্রহ নেই। পলাশের জীবনে যা ঘটেছে, তা নিয়ে আর ভাবতে চায় না সে।
অনিয়া খামটা তুলে নিয়ে একটি বাক্সের মধ্যে রেখে দেয়। খামের সাথে পলাশের স্মৃতিগুলোও যেন সেখানে বন্দি হয়ে থাকে। এরপর সে বাক্সটা আলমারির এক কোণে রেখে দেয়, যেখানে প্রতিদিনের জীবনযাপনে তা আর চোখে পড়বে না।
অনিয়া জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকায়। আকাশে সন্ধ্যার নরম আলো ছড়িয়ে পড়ছে। একটানা বৃষ্টি শেষ হয়েছে, শহরের রাস্তাগুলো এখনো ভিজে। তার মনে হয়, এই ভেজা রাস্তাগুলোর মতোই তার জীবনও এখন পরিষ্কার হতে শুরু করেছে।
আজকের রাতটা অন্যরকম। অনিয়া মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, সে আর পেছনের দিকে তাকাবে না। পলাশের সাথে তার জীবন থেমে গেছে, কিন্তু তার নিজের জীবন চলতে থাকবে।
হয়তো কিছুদিন পর সে নতুন কিছু শুরু করবে, নতুন কারো সাথে বন্ধুত্ব করবে। তবে আজ রাতে, সে তার নিজের সাথে সময় কাটাবে—নিজেকে বুঝবে, নিজের জন্য ভালোবাসা অনুভব করবে।
অনিয়া ধীরে ধীরে একটি বই তুলে নেয়। তার প্রিয় লেখকের লেখা, যে লেখাগুলো তাকে সবসময় শান্তি দেয়। সে আর এক মুহূর্ত দেরি না করে পড়তে শুরু করে।
পৃষ্ঠার শব্দ, মৃদু বাতাসের নাড়া, আর বইয়ের শব্দের মাঝে সে ডুবে যায়। তার মন শান্ত হয়, জীবন যেন একটু সহজ লাগে।
অনিয়া জানে, প্রতিটা গল্পের যেমন একটা শেষ থাকে, তেমনই তারও শেষ আছে। কিন্তু সেই শেষটাই নতুন কিছুর শুরু।
( চলবে...)