আমার বড় ভাই আমাদের ওপর ছায়া হয়ে সব সময় আগলে রাখতো। আমার বড় ভাই ইন্টার পাস করার পর আর পড়াশোনা করার সুযোগ পায় নি।কারণ অনার্সে ভর্তি হতে সম্ভবত আট হাজার টাকার দরকার ছিল। যার কারনে ইন্টার পাসেই পড়াশোনার সমাপ্তি করেছিলেন। আমার বড় ভাই আমার বাবার সমতুল্য। আমাদের গ্রামে কারেন্ট আসে নি।সবাই বাতি(দোয়াত ও হারিকেন) ব্যবহার করতো। ওই সময়ে বড় ভাই ব্যাটারী দিয়ে এক প্রকারের আলো জ্বালানোর ব্যবস্থা করে ছিলো।ওই ব্যাটারী প্রতিদিন বিকেলে চার্জ দেওয়ার জন্য বাজারে একটা চায়ের দোকানে যেতো আমার বড় ভাই। প্রতিদিন সকালে উঠে কাজে চলে যেতো।মাটি কাটা,পাট কাটা,ধান কাটা,কলা গাছ লাগানো,লেবু তোলা,ধান লাগানো,জমির আগাছা পরিষ্কার, মানে যতো রকমের কৃষি কাজ ছিলো তার সবই আমার ভাই পারতো।সকালে যখন কাজে যেতো কোন কোন দিন ভাত সাথে করে নিয়ে যেতো, আবার কোন কোন দিন পান্তা ভাত,রুটি,চাপড়ি,চিড়ামুড়ি এগুলোও নিয়ে যেতো।একেক দিন আমার মা ভাত নিয়ে যেতো।
আমার মা যখন দূরে থেকে দেখতো এতো টুকু ছেলে কতো বড় বড় মাটির ডালি মাথায় নিয়ে যাচ্ছে। তখন আমার মা কেঁদে ফেলতো।আজ বাবা নাই বলে এই ছেলের এতো কষ্ট করতে হয়। আমাদের দিকে তাকিয়ে আমার বড় ভাই কষ্টকে হাসি মুখে বরন করে নিয়েছিলো।কাজ থেকে আসতো চারটা সময়।বাড়িতে এসে গসল দিয়ে খাওয়া দাওয়া করে ওই যে ব্যাটারি নিয়ে চলে যেতো বাজারে।আর যদি বাড়িতে কোন কাজ থাকতো তাহলে বাজারে না গিয়ে কাজ করতো।বাজার থেকে আসতো রাত দশটা সময় কোন কোন দিন এগারোটা সময় আসতো, আবার কোন কোন দিন আটটা,নয়টা সময় আসতো।যদি রাত বেশি হতো তবে আমি ঘুমিয়ে যেতাম।সকালে উঠে দেখতাম আমার জন্য আমার ভাই একটা দুই টাকা দামের একটা বিস্কুট নিয়ে আসছে গতকাল রাতে।তা দেখে আমি প্রচুর খুশি হতাম।আমাকে আমার বড় দুই ভাই যেভাবে গড়ে তুলেছে আলহামদুলিল্লাহ কখনো বেশি কিছুর আশা করি নি।ছোট ছোট জিনিসেই আনন্দ খুঁজে পেতাম।বড় কিছু চাওয়ার বা পাওয়ার কোন আকাঙ্খা আমার পরিবারের কারো ছিলো না। একটা কথা কি জানেন কিছু জীবনের রং থাকে না।শখ করার বয়সে যখন দায়িত্ব এসে পড়ে তখন আর শখ করা হয়ে ওঠে না। আমাদের তিন-ভাই বোনেরও তেমনি শখ করা হয়ে ওঠে নি।
বড় ভাই শখ করতে পারে নি কারণ তার কাঁধে তখন আমাদের দায়িত্ব। অভাবের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায়। ছোট ভাই শখ করতে পারে নি, কারণ তখন আমাদের বাড়িতে ঝগড়াঝাটি মারামারি চলছিলো।একজন বাবা ছাড়া পরিবারে সন্তানদের ওপর দিয়ে যে কতো ঝড় ঝাপটা যায় তা নিজের চোখে না দেখলে হয়তো উপলব্ধি করতে পারতাম না।বাবা মারা যাওয়ার পর জমি নিয়ে মারামারি হয়। আমাদের জমি আমার চাচাতো ভাইয়েরা জোর করে খায়।প্রতিবাদ করতে গেলেই মার খেতে হতো।বিপদ যখন আসে চারদিক থেকেই আসে কথা টা হয়তো সত্যি। কারণ সাত, আটটা বছর আমাদের ওপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে ঝড় হাওয়া। কেবল আল্লাহর ওপর ভরসা করে আমরা বেচে ছিলাম। আমাদের আপন বলতে কেউ ছিলো না। না কোন মামা-খালা,আর না কোন চাচা-ফুফু। চাচাতো ভাইয়েরা সবাই আমাদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে নিজেরা আমাদের বাড়ি ঘর শোষণ করতে চেয়েছিলো। কিন্তু আমার মায়ের তো যাওয়ার কোন জায়গা নাই। মামাকে আগেই জমি লিখে দিয়ে টাকা নিয়ে আসছিলো।
দাদা-দাদী, নানা-নানী অনেক আগেই মারা গিয়েছে। কেবল নানীকে আমি দেখেছিলাম। আর কাউকে আমার বড় ভাইও দেখে নি।তাই আমার মায়ের যাওয়ার মতো কোনো জায়গা ছিলো না। অন্যদের মার খেয়ে হলেও আমাদের ওইখানেই থাকতে হতো।কেমন বিপদ আমাদের মুখোমুখি হয়েছিল শুনুন, আমি তো ছোট ছিলাম কারো গায়ে হাত তোলা, কাউকে গালি দেওয়া কখনো আমার দ্বারা সম্ভব হয় নি।আমি অনেক বোকা মানুষ তো তাই। সময়টা ছিলো বর্ষা কাল জমির আইল এর ওপর একটা গাছ ছিলো।আমার বড় ভাই বলে পুরো আইল আমাদের মধ্যে। সুতরাং গাছও আমাদের। কারণ আমরা তার ওইদিকে আরো জমি পাবো।কিন্তু তারা দিতে নারাজ। আমার ভাই বলে খুটি আছে না সেখানে সুতা ধরো দেখো গাছ কোথায় যায়।আমার চাচাতো ভাই বলে গাছ আমার মধ্যে আছে। মানে তিনি সুতা ধরবে না জোর করেই নিয়ে নিবে।এই নিয়ে তর্কাতর্কি করে তা মারামারিতে রূপ নেয়। সেই মারামারিতে আমার বড় ভাইয়ের গলাতে দা.. ধরে আমার চাচাতো ভাই। আমার মায়ের সাথেও আমার চাচী আর ভাবির ঝগড়া আর ছোট ভাইকেও আরেকজন মারে।আমার ছোট ভাই মার খেয়ে ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে। এই দৃশ্য দেখে আমি ঘাবড়ে যায়।কিছু করতে পারি না কেবল কান্না করা ছাড়া। আল্লাহ বাঁচায় জন্য আরেক চাচাতো ভাই এসে আমার বড় ভাইকে দা য়ের নিচ থেকে বের করে আনে।তবুও গলাতে অনেক খানি কেটে গিয়েছিলো। এমন আরো অনেক ঘটনা ঘটে আমাদের সাথে। এমনকি এক প্রতিবেশী আমাদের বাড়িতে মানে আমাদের ঘরে গিয়ে আমার বড় ভাইকে মেরে আসে।আমার বড় ভাই অনেক মা-র খেয়েছে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে।
আমার বড় ভাইয়ের চেয়ে ছোট ভাই আবার একটু চালাক।একটা বিচার হয়েছিল এইসব জমিজমা নিয়ে। তখন আমার ছোট ভাই তার মতামত দেয়। কিন্তু মাতব্বর বলে তুই ছোট মানুষ তুই এতো কথা বলিস কেন।আমার ছোট ভাইয়ের মতামত তখন গ্রহণ যোগ্য হয় না। আমার ছোট ভাইয়ের এসএসসি পরীক্ষার সময় এমন ঘটনা ঘটে। যদিও বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই এমন কিছু ঘটে। তবুও ওই সময় তা আরো বেড়ে যায়। হাজারো দুশ্চিন্তা টেনশন মাথায় নিয়ে আমার ছোট ভাই কোন মতে পরীক্ষা দেয়। পরীক্ষার রেজাল্টও আলহামদুলিল্লাহ ভালোই করে। এইসব মারামারি কাটাকাটি থেকে বাঁচতে আমার ছোট ভাই বিদেশ যাওয়ার জন্য বায়না ধরে। আমার আরেক চাচাতো ভাই অনেক আগে থেকেই বিদেশ থাকতো তাদের সাথে পরামর্শ করে বিদেশ যেতে চায়।আমার মা তো দিতে রাজিই না কিন্তু বাড়িতে থেকে আর কতো মা-র খাবে।তাই লাস্টে তিনিও রাজি হয়ে যায়। গরু,ছাগল,জমিজমা আরেক জনকে কটে দিয়ে আরো কিছু ঋন করে করে আল্লাহর ওপর ভরসা করে বিদেশে পাড়ী জমায়।আমার ছোট ভাই অনেক সপ্ন নিয়ে প্রবাসে যায়।এসএসসি পাসেই তার পড়াশোনার সমাপ্তি ঘটে।তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। আর তখন থেকেই হিজাব পড়া শুরু করি।ক্লাস সেভেন থেকে যে হিজাব মাথায় উঠেছে আলহামদুলিল্লাহ তা আর কখনো নামে নি।তখনও বোরকা পড়া শুরু করে নি।আমাদের স্কুলের মেয়েরা দুই একজন ক্লাস টেনে বোরকা পড়তো।আর সবাই স্কুল ড্রেস পরেই হিজাব ছাড়াই স্কুলে যেতো।
আজকে অনেক কিছু লিখে ফেলেছি।আসছি পরবর্তী পর্ব নিয়ে। বাস্তব জীবন থেকে নেওয়া গল্পটি সত্যিই কষ্টদায়ক। এমন খুব কম মানুষই আছে যারা বাবা মারা যাওয়ার পরও সুখে আছে। বাবা হলো একটা বট বৃক্ষের মতো যিনি তার পরিবারকে সর্বদা আগলে রাখেন।তেমনি বাবার পর বড় ভাইও তেমন বট বৃক্ষের মতো আগলে রাখে।আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করি গল্পটি গুছিয়ে লেখার। জানি না কতোটুকু গুছিয়ে লিখতে পেরেছি। আবারও বলছি ধৈর্য হারা হবেন না। আস্তে আস্তে জানতে পারবেন আমাতুল্লাহর দ্বীনে ফেরার গল্প। গল্পে কোন ভুল থাকলে আমাকে ধরিয়ে দিবেন। আর ভালো -মন্দ মন্তব্য জানাতে ভুলবেন না। জাযাকুমুল্লাহ খইর।
আসাদ খান
গল্পে আসল বিষয় কোথায়