নর্তকীর মহল (পর্ব ০৪)

আর্য এক এক করে পৃষ্ঠা উল্টোতে থাকে৷ অপর পাতায় লেখা রয়েছে,
তারিখ: ১৮৯৭ সালের ১৫ই জানুয়ারি
প্রতিদিনের মতো আজও আমি মহলে নৃত্য পরিবেশন করবো। জমিদার দীনবন্ধু রায়ের উপস্থিতি সর্বদা আমার মনকে এক অদ্ভুত আকর্ষণে ভরে দেয়। তার চোখের গভীরে লুকিয়ে থাকা ব্যথা আমি স্পষ্ট দেখতে পাই, তবে সেই ব্যথার উৎস আমার অজানা। তার চোখে এক অদ্ভুত আকর্ষণ এবং এক নিঃস্বার্থ ভালোবাসা লুকিয়ে আছে। আজকের নাচের জন্য আমি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত করেছি।আজকের রাতের নৃত্যটি হয়তো অন্য দিনের চেয়ে বিশেষ কিছু হয়ে উঠবে।
আমি আজ সাঁজবো৷ খুব সুন্দর করে সাঁজবো৷ আমি ও চাই সে মন খুলে আমায় সব কথা বলুক৷ আমি যে তাকে ভীষণ ভালোবাসি৷ তার সেই চোখের চাহনি আমার মনকে ছিন্নভিন্ন করে৷ আমার এই মনে ঝড় তোলে তার জন্য৷ লন্ডভন্ড করে সবকিছু৷ তার মনে কি এতো দুঃখ,কি এতো বেদনা আমি জানতে চাই৷ আমার যে এ মন আর মানে না৷ আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না৷ আমি সামান্য এক নর্তকী কীভাবে আমার মনের কথা তাকে বলি৷ আমি তাকে কিভাবে বলি তার এই দুঃখ যে আমি সইতে পারছি না৷ কেনো আমার এতো মায়া হয় তার জন্য৷ তার ধন,সম্পদ,অর্থ,অলংকার কোনো কিছুর অভাব নেই৷ কিসের অভাবে সে এতো কষ্ট পাচ্ছে৷ আমি এর জবাব চাই৷ আমি যে ভালো নেই কিভাবে তাকে বোঝাই৷
ডায়েরির পাতায় এতোটুকু লিখেই চলে যায় মাধুরী৷ সে নিজেকে অনেক সাজায়৷ আজ সে সবচেয়ে দামি শাড়িটি পড়েছে৷চোখে কাজল,মাথার খোপায় গোলাপ ফুল,গলায় ভারি গহনা৷ পড়নে কালো শাড়ি হাতে চুড়ি,কপালে বড় কালো টিপ, নাকে নথ৷ ঠোঁট রক্তজবার মতো লাল৷ কি অপরূপ লাগছে৷
নিচে থেকে তবলা,হারমোনিয়াম এর শব্দ আসছে৷ নিচে আসর বসেছে৷ সবাই উপস্থিত৷ মাধুরীর চোখ পড়ে দীনবন্ধু রায়ের উপর৷
দীনবন্ধু উচ্চস্বরে বললেন,"বাহ মাধুরী বাহ"৷ আজকে সবার নজর লেগে যাবেতো৷
কি সুন্দর লাগছে আমার মাধুরী কে৷ যেনো আসমানের পরী সাক্ষাৎ এসে হাজির হয়েছে৷
মাধুরী দেবীর চোখের কোনে জল এসে পড়ে৷ চোখের জল যেনো নিচে পড়ে ও আর পড়ল না৷ মাধুরী দেবী আজ অনেক খুশি৷ কারন এই আসরে এতো মানুষের সামনে সে যে আজ আমার বলে দাবি করেছে৷
মাধুরী দেবীর যে আজ ইচ্ছে করছে জমিদার এর কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিতে৷ সে ও চায় তার ভালোবাসার মানুষ তাকে আদর,ভালোবাসায় ভরিয়ে দিক৷
ধীরে ধীরে মাধুরী দেবী গান গাইতে শুরু করে এবং গানের সাথে সাথে নাচতে শুরু করে৷ আশেপাশে তবলা বাজছে,হারমোনিয়াম বাজছে,একতারা বাজছে৷
জমিদার প্রশংসায় পঞ্চমুখ৷ আহাহা, আহা কি সুর, কি কন্ঠ,কি নৃত্য৷
দর্শকরা হাতে তালি দিচ্ছে৷
দীর্ঘ এক ঘন্টা পর মাধুরীর নাচ,গান শেষ হয়েছে৷ অনেক হাঁপিয়ে ওঠে মাধুরী৷
জমিদার আবারো বলে উঠে,"তোমার মুখে আজ মধু ঝরছে"৷
এই মধু আমি পান করতে চাই৷ আজ তুমি আমাকে অনেক খুশি করেছো৷ কি চাই তোমার?
শুধু একবার বলো যা চাইবে তা তোমার সামনে হাজির করা হবে৷
মাধুরী দেবী লজ্জায় লাল হয়ে আছে৷মাধুরী দেবী জমিদার এর চোখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আর মনে মনে বলছে,
"আমার যে আপনাকেই চাই,আমার এই ভালোবাসা কিভাবে বোঝাই আপনাকে"৷
জমিদার অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাধুরীর দিকে৷
জমিদার মনে মনে বলছে,আমি জানি মাধুরী৷ তুমি আমায় ভালোবাসো৷ কিন্তু মুখ ফুঁটে কিছু বলতে পারছো না৷ আমি চাই তুমি অনেক ভালো থাকো৷ এই মহলের মানুষরা যে তোমাকে বাঁচতে দেবে না৷ আমি তোমাকে মুক্তি দিতে চাই৷ আমার মনের বেদনা,সুখ,দুঃখ সব যে তোমায় ঘিরে৷

চলবে!৷