নীলা

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:

সন্ধ্যা নেমেছে কলকাতার রাস্তায়।
ফুটপাথে ব্যস্ত মানুষের ভিড় ক্রমেই ফুরোচ্ছে।
আকাশের দিকে তাকালে দেখা যায়, কালো মেঘ জমেছে। যেন আজ কোনো অশনি সংকেত ছড়িয়ে দিচ্ছে চারপাশে।

নীলা জানালার পাশে বসে আছে। তার সামনে একটা ছোট মোমবাতি জ্বলছে। বৈদ্যুতিক আলো বন্ধ। যেন সে ইচ্ছে করেই অন্ধকার বেছে নিয়েছে।
এই নীরবতা, এই আধো আলো তার যন্ত্রণার সঙ্গী হয়ে উঠেছে গত কয়েক সপ্তাহে।

পরের দিন সকালে, নীলা অফিসে গিয়ে দেখে তার ডেস্কের উপর একটা নোট পড়ে আছে।
"তোমার সবকিছু আমরা জানি। প্রস্তুত হও, নীলা।"

বুকের ভেতরটা টনটন করে ওঠে।
অনব তখন আসে।
তার মুখেও চিন্তার ছাপ।
অয়ন এক মুহূর্তের জন্যও নীলাকে ছেড়ে যেতে চায় না।

সে আস্তে করে
নরম করে বলে,
"তুমি ভয় পেও না। আমি আছি তোমার পাশে।"

নীলা তাকিয়ে থাকে।
এই চোখ দুটোতে আজ নির্ভরতার ছবি আঁকা।
কিন্তু সেই ছবির ফ্রেম আজও টলোমলো।
কারণ, নীলা জানে, ভালোবাসা বাঁচানোর যুদ্ধ সে নিজের ভেতরে আজও জিততে পারেনি।


---

রাতে অরনব নীলাকে তার নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়।
সে চায় না নীলা একা থাকুক।

ছোট্ট ফ্ল্যাট, চারপাশে বইয়ের গন্ধ, মৃদু আলো।
নীলা বসে থাকে সোফায়।
অয়ন চুপচাপ কফি বানাতে যায়।

সে এসে একটা মগ এগিয়ে দেয়।
নীলা নিতে চায় না।
তার হাত কাঁপে।
অরনব মৃদু জোরে মগটা তার হাতে গুঁজে দেয়।

— "খাও। নিজেকে ভেঙে পড়তে দিও না।"

নীলা তাকিয়ে থাকে তার দিকে।
কী সহজ ভাষায় অয়ন যেন বলছে, ‘বাঁচো’।
কী সহজে সে বলে দিচ্ছে, 'আমি তোমার পাশে আছি'।
কিন্তু সহজ তো নয় নীলার কাছে।
তার হৃদয়ে তখনও শ্রাবণের ফাঁসির দাগ স্পষ্ট।
তার বুকের ভেতর এখনও মৃতপ্রায় প্রেমের লাশ পড়ে আছে।


---

রাত বাড়ে।
বৃষ্টি নামে।
বাইরের জগৎ ভিজে যায়।

নীলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।
বৃষ্টির ফোঁটাগুলো জানালায় ঝরে পড়ছে — যেন অশ্রুর মতো।

অনব চুপচাপ এসে তার পাশে দাঁড়ায়।

— "নীলা, তুমি যদি চাও, সব ছেড়ে আমরা দূরে কোথাও চলে যাবো।
তোমাকে কেউ খুঁজে পাবে না।"

নীলা কোনো উত্তর দেয় না।
শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

সে জানে, পালিয়ে বাঁচা যায় না।
নিজেকে নিয়ে কোথাও পালানো যায় না।

রাত গভীর হয়।
ঘড়ির কাঁটা টিকটিক শব্দ করে চলে।
নীলা বিছানার এক কোণে বসে থাকে।
অনব মেঝেতে তার কাছে পাতা একটা ম্যাটে শুয়ে।
দুজনের মধ্যে একটা অদৃশ্য প্রাচীর।

নীলা হঠাৎ ফিসফিস করে বলে,
"তুমি কি সত্যিই আমার সাথে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারবে, অরনব?
যখন তুমি জানো, আমার ভেতর ভাঙা মানুষটা আজও শ্রাবণের মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি?"

অরনব কোনো শব্দ করে না।
শুধু নীরবতায় সম্মতি দেয়।
তার নীরবতাই আজ সবচেয়ে বড় আশ্বাস।


পরদিন ভোরে দরজায় কড়া নাড়ে।
অনব দৌড়ে গিয়ে দরজা খোলে।
দুইজন অচেনা লোক দাঁড়িয়ে।
কাঠিন্য ছাড়া তাদের মুখে আর কিছু নেই।

একজন বলল,
— "নীলা ? আপনাকে আমাদের সঙ্গে আসতে হবে। তদন্তের স্বার্থে।"

অয়ন কিছু বলতে যায়, কিন্তু নীলা তাকে ইশারায় থামিয়ে দেয়।
সে বুঝেছে, পালানোর চেষ্টা করলে অবস্থা আরও খারাপ হবে।

সে মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসে।
হাতকড়া পরানো হয়নি, কিন্তু শিকলবদ্ধ মনে হয় তার।
পৃথিবী যেন হঠাৎ নিঃশব্দ হয়ে আসে।


পুলিশ স্টেশনের জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে কড়া আলো, মেটাল চেয়ার, হালকা গন্ধ।
কর্তব্যরত অফিসার একের পর এক প্রশ্ন করে:
— "আপনি কি শ্রাবণ সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন?"
— "কীভাবে তার মৃত্যুর পরদিনই আপনার নতুন প্রেম শুরু হয়?"
— "কীভাবে আপনার কাছে শ্রাবণের গোপন নথি এল?"

নীলা চুপ করে বসে থাকে।
তার ঠোঁট শুকিয়ে যাচ্ছে।
গলা দিয়ে শব্দ বেরোচ্ছে না।

একসময় অফিসাররা হাল ছেড়ে দেয়।
কিন্তু নীলা বুঝতে পারে, তারা তাকে সন্দেহ করছে।
শুধু প্রমাণের অপেক্ষা।


পুলিশ স্টেশন থেকে যখন বেরিয়ে এল নীলা, তখন সূর্য মাথার ওপরে।
তাপমুখর দুপুর।
রাস্তায় ছায়া বলতে কিছু নেই।

তার মাথাটা ঝিমঝিম করছে।
পায়ের নিচে মাটি নেই যেন।
সবকিছু দুলে উঠছে।

অরনব ছুটে আসে।
তার চোখের কোণে উদ্বেগ।
সে হাত বাড়িয়ে ধরে নীলার হাত।
সামান্য কাঁপা হাতে।

"চলো নীলা, এখানে আর থাকা ঠিক হবে না।"

নীলা কোনোরকমে মাথা ঝাঁকায়।
তারা দুজন হাঁটতে হাঁটতে অটোর দিকে যায়।
পেছনে, পুলিশ স্টেশনের বড়ো গেটের দিকে তাকিয়ে, মনে হয় যেন কোনো অদৃশ্য দৃষ্টি আজও অনুসরণ করছে তাদের।

অটোয় বসে নীলা চোখ বন্ধ করে।
তার ভেতরটা আজ ফাঁকা।
ভয়, রাগ, কষ্ট, ঘৃণা — সব যেন মিশে একাকার হয়ে গেছে।

তাকে কেউ বিশ্বাস করে না।
তাকে কেউ বোঝে না।
একটা নীরব হাতের মুঠো হয়ে পাশে থাকে।
সেইটুকুই তার সম্বল।

বাড়ি ফিরেই নীলা দরজা বন্ধ করে দেয়।
সে জানে, বাইরের দুনিয়া তাকে ছিঁড়ে ফেলবে যদি আরেকটু সুযোগ পায়।


নীলা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে।
আকাশ আজ বিষণ্ণ।
নির্জন বৃষ্টির ধারা তার গালে গড়িয়ে পড়া নোনা জলের মতো।

এখন শুধু একটা শীতল শূন্যতা।
শ্রাবণ, যে আর ফিরে আসবে না।

রাত বাড়ে।
অরনব ডিনার নিয়ে আসে।
নীলা এক চামচ মুখে দেয় না।
সে নিঃশব্দে বসে থাকে, চোখ দুটি শূন্য।

অরনব উঠে এসে তার সামনে বসে।
"তুমি এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না, নীলা।"
তার গলা দৃঢ় কিন্তু কোমল।

নীলা তাকিয়ে থাকে।
তার মুখ শুকিয়ে গেছে।
তার চোখের নীচে কালি।
কিন্তু সে কথা বলে না।
কোনো শব্দ করে না।

অরনব নীলার হাত ধরে।
সে হাতটা ঠাণ্ডা।
একটা মৃত ফুলের মতো।

"শুনো, আমি জানি তুমি কষ্টে আছো।
কিন্তু তুমি একা না। আমি আছি।"

নীলা ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে।
এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে তার গাল বেয়ে।
কেউ কোনো শব্দ করে না।
শুধু নিঃশব্দ কান্না বয়ে চলে।


---

রাত একটা সময়, হঠাৎ বাইরে চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যায়।

অরনব ছুটে যায় দরজার দিকে।
নীলা দাঁড়িয়ে থাকে কাঁপতে কাঁপতে।

দরজা খুলতেই দু'জন মুখোশধারী লোক জোর করে ঢুকে আসে।
হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় অরনবকে।
অরনব প্রতিরোধ করে।
কিন্তু লোকগুলো শক্তিশালী।

নীলা চিৎকার করে ওঠে:
"ছাড়ুন! ছাড়ুন ওকে!"

একজন লোক নীলাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়।
সে পড়ে যায় মেঝেতে।
চোখের সামনে সব আবছা হয়ে আসে।

অরনবকে মাটিতে ফেলে বেধড়ক মারধর করতে থাকে তারা।
নীলা হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসে, ঠেকাতে চায়।
কিন্তু কিছুই করতে পারে না।

লোহার রডের আঘাতে অরনবের মাথা ফেটে যায়।
রক্ত গড়িয়ে মেঝেতে পড়ে।
অরনব তখনো বলার চেষ্টা করে:
"নীলা... পালাও..."

কিন্তু সে কথা শেষ করতে পারে না।
একটি বিকট শব্দের সঙ্গে অরনব মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।

নীলা চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।

তারপর তারা আসে নীলার দিকে।
একজন চেয়ার এনে নীলাকে জোর করে বেঁধে ফেলে।মুখ চেপে ধরে। নীলা ছটফট করে।
কিন্তু শক্ত হাতে বাঁধা পড়ে যায়। তারপর তারা বেরিয়ে যায়।
ওরা দড়ি দিয়ে নীলার হাত আরও শক্ত করে বাঁধে।

নীলা চিৎকার করতে চায়, গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় না। তার মনভরা কষ্ট, প্রেম, হারানোর বেদনা সবকিছু যেন একসঙ্গে চেপে বসে।
একটা ছুরি তার গলার কাছে এসে দাঁড়ায়।
কিন্তু হঠাৎ —

একটা শব্দ —
গুড়ুম!

ঘরের বাইরে কোথাও কিছু ভেঙে পড়ে।

মুখোশধারীরা চমকে তাকায়।
একজন দরজার দিকে এগিয়ে যায়।
আর তখন —

কিছু একটা ঘটে যায়।

আচমকা ঘরের ভেতর আলো চলে যায়।
ঘন অন্ধকার নেমে আসে।

নীলা শুধু শুনতে পায় একটা ঝাঁপিয়ে পড়ার শব্দ।
কারো চাপা চিৎকার।
কারো দৌড়ে পালানোর শব্দ।

তারপর... নীরবতা।
কঠিন, ঘন নীরবতা।

34 Views
0 Likes
0 Comments
0.0 Rating
Rate this: