টিএসসি অডিটোরিয়ামের সেই ঘটনার পরে পুরো শহরে যেন একটা নতুন শব্দ ছড়িয়ে পড়ে—“ছায়া-হ্যাকার”।
কেউ জানে না, কে সে। কেউ দেখে না তার মুখ।
শুধু জানা যায়, সে একের পর এক প্রভাবশালী মানুষের মুখোশ ছিঁড়ে নিচ্ছে, সত্যকে জনসমক্ষে নিয়ে আসছে, কোনো স্বার্থ ছাড়াই।
আর একদম নিঃশব্দে।
লিজেন তখন মেসে ফিরেও না। সে এখন একটি পুরনো মসজিদের পাশে অব্যবহৃত একটি লাইব্রেরিতে থাকে—যেখানে আগে এক বুড়ো হুজুর থাকতেন, এখন আর কেউ যায় না।
এই জায়গাটাই তার নতুন ঘাঁটি। এইখানে সে আয়াতের ডেটাগুলোর ব্যাকআপ রাখে, নিজের নতুন নাম বানায়, নতুন পরিচয় তৈরি করে।
সে এখন আর শুধু লিজেন নয়—সে এখন এক ছায়া।
---
▸ কফির কাপ আর আগুনের স্বপ্ন
এক সন্ধ্যায়, লিজেন একটা পুরনো নোটবুক খুলে বসে।
সেখানে সে লিখে:
> “তোমার চোখে আমি যা দেখেছিলাম, তা কোনো ভাষায় বোঝানো যায় না।
তুমি আমাকে চিনতে পারো নি, আয়াত। কিন্তু আমি জানি, তুমি আমার অপেক্ষায় ছিলে।
আমি আসছি—তোমার স্বপ্নগুলো ফিরিয়ে দিতে। এই পৃথিবী বদলাতে নয়,
এই পৃথিবীকে তার আসল মুখ দেখাতে।”
সে চুপ করে বসে, কফির কাপটা ঠোঁটে নিয়ে চুমুক দেয়।
তার চোখে তখন এক রকম জ্বলন্ত স্বপ্ন, আর ঠোঁটে একটুখানি শান্ত হাসি।
এই হাসিটাই হয়তো তার ভেতরের যুদ্ধের প্রশান্তি—প্রথম পদক্ষেপ সফল হওয়ার হাসি।
---
▸ ফোনের অপর প্রান্তে
ঢাকার কোনো এক অভিজাত ভবনের পেছনে, একটি ঘরে বসে আছে একজন। চোখে চশমা, হাতে ফোন।
তার কণ্ঠে অদ্ভুত শীতলতা:
— “তাকে খুঁজে বের করো। এই ছায়া, এই ছেলেটা, আমাদের সবকিছু ছিন্নভিন্ন করে দেবে। আমরা যা গোপন রেখেছিলাম এত বছর ধরে, সে একে একে জনতার সামনে টেনে আনছে।”
আরেকজন বলে:
— “কিন্তু স্যার, কেউ জানে না সে কে। কোনো চিহ্ন, কোনো আইডি নেই। শুধু ট্রেসহীন ফিড। আপনি কি নিশ্চিত, সে একা?”
— “না,” — লোকটা বলে — “সে এখনো একা। কিন্তু যদি সে আমাদের আরও কিছু ফাঁস করে, তবে পুরো জাতি তার পাশে দাঁড়িয়ে যাবে। তখন আমরা হারব, আইন দিয়ে নয়, মানুষের বিবেকে।”
ফোন কেটে যায়।
ঘর নিঃশব্দ।
শুধু জানালার বাইরে শোনা যায় দূরে কোনো ট্রেনের হুইসেল।
ঠিক যেমন ছায়ার স্টেশন থেকে আসে প্রতি রাতে—নিঃশব্দ, অথচ অপ্রতিরোধ্য।
---
▸ প্রথম অধ্যায়ের শেষ সংলাপ
রাত গভীর হলে লিজেন তার ছোট্ট মোমবাতির আলোয় আয়াতের ছবিটার দিকে তাকায়।
চোখে জ্বলছে অভিমান, ভালোবাসা, ক্ষোভ, ও এক অদ্ভুত নীরব সংকল্প।
সে ধীরে ধীরে বলে:
> “তুমি যেখানেই থাকো, আমি আসছি।
তোমার জন্য না—
তোমার অসমাপ্ত সত্যটা শেষ করতে।”
▸ একটি নতুন সকাল, একটি বদলে যাওয়া শহর
ঢাকার বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠেছে।
মানুষের মুখে মুখে এখন এক রহস্যময় নাম—"ছায়া-হ্যাকার"।
টেলিভিশনের হেডলাইন, পত্রিকার প্রথম পাতা, এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাজারো পোস্ট—সব জায়গাতেই একটাই প্রশ্ন:
> “কে এই ব্যক্তি, যে সরকার ও ক্ষমতার মাথাদের গোপন কথা ফাঁস করছে?”
“আসলে সে কি হিরো? না কি একজন বিপজ্জনক অপরাধী?”
কিন্তু এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানে না কেউই।
কারণ ছায়া—বা যাকে আমরা জানি লিজেন নামে—নিজেকে কখনো প্রকাশ করছে না।
সে কাজ করছে নীরবে, নিখুঁতভাবে।
---
▸ ছায়ার ঠিকানা বদলায়
পুরনো লাইব্রেরির নিরাপত্তা নিয়ে লিজেন এখন একটু চিন্তিত।
সে বুঝে যায়, তার অবস্থান হয়তো কেউ ট্র্যাক করার চেষ্টা করছে।
তাই সে এক রাতে ব্যাগ গুছিয়ে উঠে পড়ে। চলে যায় ঢাকা শহরের এক অদ্ভুত জায়গায়—কমলাপুর রেলস্টেশন-এর পুরনো মালগাড়ি রাখার ওয়ার্কশপের পাশে একটা ফেলে রাখা রেলের বগিতে।
এই জায়গাটা শহরের কেউ চেনে না।
রেলের কর্মচারীরাই কেবল জানে, এটা একদম ফাঁকা, ময়লা, আর মরা বাতাসে ভরা।
কিন্তু এখানেই লিজেন তার নতুন ঘাঁটি বানায়।
সে জায়গাটাকে সাজায় খুব সাধারণভাবে।
একটা পুরনো টেবিল, কয়েকটা ক্যাবল, একটা সোলার প্যানেল, আর আয়াতের ছবি।
এই বগির জানালা দিয়ে সে মাঝরাতে ট্রেন চলার আওয়াজ শোনে।
এটা তাকে শান্তি দেয়। মনে হয়—তার চলার গতিও এখন ট্রেনের মতো—ধ্বংসের দিকে না, বরং সত্যের পথে।
---
▸ অন্যদিকে: চিহ্নহীন অনুসন্ধান শুরু
G-9 ফাউন্ডেশনের ভিতরে তখন বিশাল আলোড়ন।
ড. কামরুল হাসপাতালে। মিডিয়ায় কথা বলছেন না কেউ।
কিন্তু গোপনে তারা একটা নতুন টিম বানিয়েছে—ছায়াকে ধরার জন্য।
এই টিমের নাম Unit-Zero, যাদের কাজ—
ছায়ার ব্যবহার করা প্রযুক্তির উৎস খোঁজা
ভিডিও ও ফিড ট্র্যাক করা
ছায়ার পরিচয় নির্ধারণ করা
Unit-Zero-এর প্রধান হচ্ছেন রায়হান খান, এক প্রাক্তন গোয়েন্দা কর্মকর্তা, যিনি নিজের চোখ ও মন দিয়ে অপরাধের মানচিত্র আঁকেন।
রায়হান খানের সংলাপ:
> “আমরা হয়তো তার নাম জানি না।
কিন্তু ছায়ার ছায়া সবখানে পড়ে থাকে।
আমরা শুধু সেই ছায়ার দাগ খুঁজে পেতে চাই।”
---
▸ একটা নতুন চিহ্ন
লিজেন এবার পরবর্তী টার্গেট ঠিক করে:
> নাম: মাফরুজা হোসেন
পদবী: প্রযুক্তি নীতিমালার স্থপতি
অভিযোগ: আয়াতের প্রযুক্তি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে ব্যবহারের প্রস্তাব তিনি প্রথম তোলেন।
কিন্তু এবার কাজ হবে কঠিন।
কারণ মাফরুজা একদম সরকারের শীর্ষ নিরাপত্তার অধীনে।
তিনি কোথাও যান না ক্যামেরা ছাড়া। তার বাসায় ২৪ ঘণ্টা নজরদারি।
তাই লিজেন এবার পরিকল্পনা করে অন্যভাবে।
সে একটি ছোট ম্যাগাজিন প্রতিষ্ঠানের সাংবাদিক পরিচয়ে মাফরুজার অফিসে প্রবেশ করে।
তবে শুধু ঢুকতে না, তার ডেস্ক থেকে একটি স্পেশাল এনক্রিপ্টেড পেনড্রাইভ চুরি করতে।
---
▸ খাঁচার ভেতরে বাঘ
অফিসে ঢুকে লিজেন দেখে, দেয়ালে একটি ছবি টাঙানো—মাফরুজা ও আয়াত একসাথে দাঁড়িয়ে।
হয়তো একসময় তারা একসাথে কাজ করতেন।
লিজেন দাঁড়িয়ে থাকে ছবিটার সামনে। মনে মনে বলে:
> “তুমি তার পাশে দাঁড়িয়েছিলে। অথচ পরে তার বিপক্ষে গিয়েছিলে?
না, কিছু একটা আছে। তুমি কি সত্যিই খলনায়ক?
নাকি তুমিও আরেকটা ছায়ার শিকার?”
তারপর সে ধীরে ধীরে ডেস্কের পাশে এগিয়ে যায়।
ডেস্কের নিচে রাখা ছোট একটি ডিজিটাল সেফ।
কোড দরকার।
কিন্তু লিজেন ইতোমধ্যেই আয়াতের ডেটার মধ্য থেকে মাফরুজার জন্মতারিখ, প্রিয় নাম, এমনকি তার কুকুরের নাম পর্যন্ত খুঁজে বের করেছে।
সে কোড টাইপ করে: “Sophie2012” — মাফরুজার কুকুরের নাম আর জন্মসাল।
ক্লিক।
লক খুলে যায়।
সে স্পেশাল পেনড্রাইভটি বের করে পকেটে রাখে এবং নির্ভরযোগ্য ক্লোন ডিভাইস দিয়ে দ্রুত স্ক্যান করে নেয়—এই ডেটা পরে বিশ্লেষণ করতে হবে।
---
▸ পালিয়ে যাওয়া না, অপেক্ষা
ঠিক সেই মুহূর্তে অফিসের বাইরে নিরাপত্তা সদস্যরা চলে আসে।
লিজেন কাচের ভেতর থেকে দেখে।
কিন্তু সে পালায় না।
বরং ধীরে ধীরে দেয়ালে ঝোলানো আয়াতের ছবির দিকে তাকিয়ে দাঁড়ায়।
তার চোখে তখন আর ভয় নেই—শুধু প্রতিজ্ঞা।
এরপর সে অফিসের জানালা দিয়ে একটি ম্যাগনেটিক হুক ছুড়ে দেয়, ভবনের পাশে থাকা সার্ভিস পাইপে আটকে দেয়, এবং নেমে যায় ধীরে ধীরে—পেছনের রাস্তায়।
---
(চলবে…)
ছায়া
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
41
Views
2
Likes
0
Comments
0.0
Rating