ছায়া

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
সকালে সূর্য ওঠার আগেই লিজেন ফিরে আসে তার ছোট্ট ভাড়াবাড়িতে। চারপাশ তখনও অন্ধকারে ঢাকা, শহর ঘুমিয়ে, আর বাতাসে একটা অস্বাভাবিক শূন্যতা।

লিজেন জানে, ব্যাগে থাকা এই ড্রাইভটি এখন তার জীবনের সবচেয়ে বিপজ্জনক বস্তু।

সে ড্রাইভটি কোনো সাধারণ কম্পিউটারে ঢুকাতে সাহস করে না। কারণ আয়াতের হাতে লেখা চিঠি থেকেই বোঝা যায়—এই তথ্য কারো চোখে পড়লে তার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।


---

▸ নিরাপদ পরীক্ষা

তার বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে একজন ছিল, নাম রাকিব—পুরোনো ভার্সিটি লাইফের বন্ধু, এখন একজন সাইবার সিকিউরিটি এক্সপার্ট। তবে সে সরকার বা প্রাইভেট কোম্পানির জন্য কাজ করে না। সে একটি নিজস্ব ল্যাবরেটরি চালায়, যেখানে হাই লেভেল এনক্রিপশন ডিকোড করার প্রযুক্তি আছে।

লিজেন সেই রাতেই রাকিবকে ফোন করে:

— “রাকিব, একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আছে। কোনো কম্পিউটার, কোনো ইন্টারনেট কানেকশন থাকবে না। তুমি শুধু খুলে দ্যাখো, ভেতরে কী আছে।”

রাকিব প্রথমে একটু বিরক্ত হলেও, লিজেনের কণ্ঠে যে রকম ভয় আর দৃঢ়তা ছিল, তাতে সে রাজি হয়ে যায়।

সকাল ৯টায় তারা রাকিবের ল্যাবে বসে ড্রাইভটি খুলে।
আর তখনই স্ক্রিনে ভেসে ওঠে একটি পাসওয়ার্ড প্রটেক্টেড ফোল্ডার, যার নাম:

> “সাইলেন্স প্রটোকল – A.I. EXPERIMENT V-3.1”



রাকিব বলে,
— “দেখ, এটা সাধারণ কোনো ফাইল না। এটা মিলিটারি-গ্রেড এনক্রিপশন। যদি ভুল পাসওয়ার্ড দাও, তাহলে এটা নিজেই নিজেকে ধ্বংস করে ফেলবে।”

লিজেন বুঝতে পারে, আয়াত এটা এমনভাবে তৈরি করেছিল যেন ভুল হাতে পড়লে সেটা নষ্ট হয়ে যায়।

তারপর সে খেয়াল করে, আয়াতের হাতে লেখা চিঠির শেষ লাইনে ছিল একটা দাগ, হালকা করে লেখা—

> “28L.Ayat96”



রাকিব পাসওয়ার্ড হিসেবে এটা টাইপ করে—
‘28L.Ayat96’

এক মুহূর্ত স্তব্ধতা...

তারপর স্ক্রিনে খুলে যায় কিছু ভিডিও, নথি, আর একটি বিশেষ ফাইল যার নাম:
“Tyrant Activation Log”


---

▸ কী ছিল সেই ড্রাইভে?

১. একটি ভিডিও রেকর্ডিং:
আয়াত নিজে ক্যামেরার সামনে বসে আছে। তার মুখে ক্লান্তির ছাপ, চোখ লাল। ভিডিওতে সে বলে—

> “যদি তুমি এটা দেখছো, তাহলে আমি বেঁচে নেই। আমি যে সিস্টেমটি তৈরি করছিলাম, সেটা কোনো সুরক্ষা প্রযুক্তি নয়—ওটা এক ধরনের মানুষ নিয়ন্ত্রণের A.I. চিপ। G-9 ফাউন্ডেশন চায় এই চিপ ব্যবহার করে রাজনৈতিক বিরোধীদের, সেনাবাহিনীর মেজর অফিসারদের এবং জনগণের নেতাদের মন নিয়ন্ত্রণ করতে।”



> “আমি এক পর্যায়ে বুঝে গেছি—এই আবিষ্কার মানুষকে রক্ষা করবে না, বরং তাদের ‘জীবন্ত দাস’ বানাবে। আমি সবকিছু বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলাম, তাই এখন আমাকে শেষ করা হবে। আমি জানি।”



> “যদি কেউ আছো, যে সত্যিই ভালোবাসে, যার হৃদয়ে আগুন আছে... তুমি এটা থামাও। ওরা যতই ক্ষমতাবান হোক না কেন, মানুষই সবশেষে জেতে।”



ভিডিওটি এখানেই শেষ হয়।


---

২. একাধিক ল্যাব রিপোর্ট, সিস্টেম স্ক্রিপ্ট ও কোড:
এখানে এমন সব চিপের ডিজাইন দেখানো হয়েছে যা মস্তিষ্কে বসালেই মানুষের চিন্তা, সিদ্ধান্ত ও আবেগ কন্ট্রোল করা যায়। এটা ছিল প্রাথমিক পর্যায়ে, কিন্তু আয়াত বলেছে সে বুঝে গিয়েছিল—এই গবেষণা যদি বাস্তবায়ন হয়, তাহলে বাংলাদেশে আর কোনো গণতন্ত্র থাকবে না।

৩. নামের তালিকা:
ড্রাইভে একটি তালিকা ছিল—১০ জন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, কিছু মিলিটারি অফিসার, কিছু মিডিয়া ব্যক্তিত্ব—যাদের চিপ ইমপ্লান্ট করা হচ্ছে বা হবে। অর্থাৎ, এরা নিজেরাও জানে না, তাদের চিন্তাভাবনা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে বা হবে।

এই তালিকার নিচে লাল হরফে লেখা:

> “THIS IS NOT SCIENCE. THIS IS WAR.”




---

লিজেন সব কিছু দেখে চুপ করে যায়। রাকিবও নিঃশব্দ। তারা বুঝে যায়—আয়াত কোনো সাধারণ মেয়ে ছিল না। সে জানত, তার মৃত্যু আসছে। তবুও সে সব তথ্য রেখে গেছে, যেন কেউ একদিন এসব ফাঁস করতে পারে।

রাকিব বলে:

— “তুই যদি এগোতে চাস, তাহলে পেছনে ফেরা সম্ভব না। এটা যদি কারো কানে যায়, তোকে মেরে ফেলবে, আমাকেও ছাড়বে না।”
— লিজেন শুধু বলে,
— “আমি পেছনে ফিরতে আসিনি, রাকিব। আমি শুধু এক মেয়েকে ভালোবেসেছিলাম। সে মরে গেছে। এখন আমার ভালোবাসা শুধু আগুন।

রাতে লিজেন ঘুমায়নি।
রাকিব ল্যাবের দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়লেও, লিজেন শুধু জানালার পাশে বসে থেকে ভোরের আলো দেখছিল। এই আলোটা এখন তার কাছে নতুন রকম—আলোকিত, অথচ ভারী। যেন আলো নয়, প্রতিটি কণার মধ্যে গুনগুন করে বলে যাচ্ছে,

> “তুমি যা দেখেছ, তা ভুলে যেও না। তুমি যা জানো, তা লুকিও না।”



সকাল ৭টার দিকে লিজেন ব্যাগে ড্রাইভটা ঢুকিয়ে রাস্তায় বের হয়ে পড়ে।
তার সামনে একটা ছোট তালিকা—G-9 ফাউন্ডেশনের ১০ সদস্যের নাম, যারা অংশ নিয়েছিল আয়াতের প্রজেক্টে।

তালিকার প্রথম নাম:

> ড. কামরুল হোসেন
বিজ্ঞানী ও G-9 গবেষণা বিভাগের প্রধান, বর্তমানে সরকারের টেকনিক্যাল উপদেষ্টা।




---

▸ একটি নিখুঁত মানুষ, একটি কুৎসিত আত্মা

ড. কামরুলকে মানুষ জানে একজন সজ্জন, ভদ্র ও জ্ঞানী হিসেবে।
টেলিভিশনে যখন আসে, তখন চোখেমুখে শান্ত ভাব, হাসিমুখ, সদা যুক্তির মানুষ।

কিন্তু আয়াতের ড্রাইভে তার নাম রয়েছে চিপ ব্যবস্থার মূল ডিজাইনার হিসেবে। অর্থাৎ, তিনিই ছিলেন সেই মানুষ, যিনি জানতেন এই প্রযুক্তি কী ভয়ঙ্কর হতে পারে, তবুও থামাননি।

লিজেন জানে, সে যদি কোনো পুলিশ স্টেশনে এই প্রমাণ নিয়ে যায়, তাহলে উল্টো তাকেই 'রাষ্ট্রবিরোধী' বলে ধরে নিয়ে যাবে।

তাই সে ঠিক করে—এই যুদ্ধের বিচার হবে, আদালতে না, কর্মে।


---

▸ পরিকল্পনার শুরু

লিজেন প্রথমে খোঁজ করে ড. কামরুল কোথায় থাকেন।
একটি সরকারি কনফারেন্সে অংশ নিতে তিনি আসবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি অডিটোরিয়ামে, যেখানে উপস্থিত থাকবেন আরও অনেক প্রযুক্তিবিদ, কিছু সাংবাদিক, এবং কিছু মন্ত্রী।

লিজেন ঠিক করে—এই প্রথম শিকার জনসম্মুখেই মুখোশ খুলে পাবে। যেন মানুষ দেখুক, কে আসলে কী।

সে নিজে কোনো অস্ত্র নেয় না। তার কাছে আছে শুধু একটি পেনড্রাইভ, যেটি আয়াতের ডেটার একটি ক্লোনড কপি, এবং একটি ছোট প্রজেক্টর ডিভাইস—যেটা পকেটে রাখা যায়, আর দেয়ালে ভিডিও ফেলে দেখানো যায়।


---

▸ জনসম্মুখে মুখোশ ছিঁড়ে যাওয়া

টিএসসি অডিটোরিয়ামের ভেতরে সব সজ্জা শেষ, ক্যামেরা অন, স্টেজে ড. কামরুল।

তিনি বক্তব্য দিচ্ছেন:

> “বিজ্ঞান মানে মানুষের কল্যাণ। আমাদের প্রতিটি আবিষ্কার মানুষের স্বাধীনতাকে সম্মান জানায়।”



ঠিক তখনই—অডিটোরিয়ামের দেয়ালে হঠাৎ আলো জ্বলে ওঠে।
একটি ভিডিও চলতে শুরু করে।
স্ক্রিনে ভেসে ওঠে আয়াত—তার সেই শেষ রেকর্ডিং।

> “এই প্রযুক্তি মানুষকে রক্ষা করবে না। এটা মানুষের চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করবে। আমি থামাতে চাই। কিন্তু যদি আমি না পারি…”



ভিড় গুঞ্জনে ফেটে পড়ে। কেউ বোঝে না কী হচ্ছে, কেউ চুপ করে।

এরপর ভিডিও চলে আয়াতের গবেষণার কোড, চিপের ডিজাইন, আর সেই তালিকা—ড. কামরুল সহ ১০ জনের নাম।

সবাই ঘুরে তাকায় ড. কামরুলের দিকে।

তিনি হঠাৎ মঞ্চে চুপ করে দাঁড়িয়ে যান, কিছু বলতে গিয়েও থেমে যান। তার চোখে ভয়, মুখে ঘাম।
সেই যে শান্ত, সজ্জন বিজ্ঞানী—সে মুহূর্তে এক ভীতু অপরাধী।

লিজেন সামনে আসে না। সে ভিড়ের মধ্যে মিশে থাকে। কারণ তার যুদ্ধ স্বীকৃতির জন্য না, বরং প্রতিটি অপরাধীকে তাদের নিজের ছায়ায় আটকে ফেলার জন্য।


---

▸ ফলাফল

পরের দিন, সংবাদপত্র গর্জে ওঠে:

> “G-9 ফাউন্ডেশনের বিরুদ্ধে গোপন প্রযুক্তি ব্যবহার করে মন নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ”
“ড. কামরুল বক্তব্য বন্ধ করে অজ্ঞান!”
“গবেষণা প্রশ্নবিদ্ধ, সরকার তদন্তে”



কিন্তু সেই খবরের নিচে একটি ছোট্ট লাইন:

> “ভিডিওটি কে চালু করেছিল, তা এখনো অজানা। কেউ দেখেনি তাকে।”
কেউ জানে না—লিজেন কী করেছে।




---

▸ প্রতিশোধ, ধাপে ধাপে

লিজেন এবার জানে, তার পদ্ধতি কাজ করছে।
সে জানে, তাকে খুঁজবে অনেক গোষ্ঠী—G-9, সরকারি গোয়েন্দা, প্রযুক্তির দালালরা।

কিন্তু সে নিজের নাম প্রকাশ করবে না।
তার কাজ হবে—এক এক করে সেই ১০ জনের মুখোশ খুলে ফেলা, জনসম্মুখে, প্রমাণসহ।

এটাই তার যুদ্ধে প্রথম আঘাত।
প্রথম শিকার—অভিজাত এক অপরাধী।


---

(চলবে…)





40 Views
1 Likes
0 Comments
0.0 Rating
Rate this: