৬ মাস পরে...
জীবন কি সত্যই নদী র সঙ্গে তুলনীয়? জীবন রহস্যের মূলসূত্র ভেদ করতে মানুষের কৌতূহল যেমন অসীম, জিজ্ঞাসাও তেমনি অনন্ত। কে বলবে জীবনের যথার্থ সংজ্ঞা কী?... কবি, দার্শনিক, পণ্ডিত, আলঙ্কারিক নানা জনের নানা দৃষ্টিভঙ্গি-নানা মত। তাই জীবনকে নদীর সঙ্গে তুলনা করলেও যেমন আমরা ঘাড় কাৎ করে সায় দিই, তেমনি আবার নৌকোর সঙ্গে তুলনা করলেও আপত্তি জানাই না।
জীবন নদী , কি জীবনটাই পথ, কে বলবে জোর করে?
তবু এই তুলনাটাই আমরা পছন্দ করি, ভারী যেন মানানসই। নদী র সঙ্গে মানুষের জীবনের যেন প্রকৃতিগত মিল রয়েছে একটা।
পূর্বনির্দিষ্ট পথ ধরে লক্ষ্যে পৌঁছনই তার একমাত্র কাজ। ভাগ্যক্রমে কারো পথ প্রশস্ত মসৃণ রৌদ্রালোকে উজ্জ্বল, কারো বা সঙ্কীর্ণ সর্পিল অন্ধকারাচ্ছন্ন।
দৈবাৎ এমন এক-আধটি জীবনেরও আবির্ভাব ঘটে-পথ যারা নিজেরা সৃষ্টি করে। নির্দিষ্ট বাঁধাপথ তাদের জন্য নয়। কিন্তু সে নিতান্তই দৈবাৎ। তাই তাদের আমরা দূর থেকে পুজো করি, বলি 'দেবতা'।
সাধারণ যারা, তাদের প্রথম দল চলে নিশ্চিন্তে নিঃশব্দে। ছোটো-বড় যাই হোক, একের সঙ্গে অপরের বস্তুগত পার্থক্য বিশেষ কিছু নেই। জীবনটা যেন এদের কাছে জন্ম আর মৃত্যুর বেষ্টনীতে আবদ্ধ সাদা একখানা পর্দা মাত্র। সমস্যা নেই, সংগ্রাম নেই। এরা নির্দিষ্ট নিয়মে খায়, ঘুমায়, খেলা করে, সৃষ্টিরক্ষার অংশীদার হয়।... রোগ-শোক, আনন্দ-উৎসব, দারিদ্র্য-প্রাচুর্য-সব কিছুর মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে পরিণতির পথে। পৃথিবীর শাস্তি আর শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব নিয়েছে এরা। ভাগ্যের কাছে কোনো প্রশ্ন নেই এদের।
অপর দল সম্পূর্ণ উল্টো। এদের চাকা কখনো সঙ্কীর্ণ আর বাঁকাচোরা পথের কোণায় কোণায় ধাক্কা খেয়ে আর্তনাদ করে ওঠে, কখনো কাদায় বসে গিয়ে অচল হয়ে থেমে পড়ে। এরাই জগতে আনে অশান্তির অভিশাপ, ঘটায় বিশৃঙ্খলা। কাউকে সুখী করবার ক্ষমতাও যেমন নেই, তেমনি নেই নিজে সুখী হবার।... কেউ অসম্ভবের আশায় ছটফট করে, কেউ অবাস্তব স্বপ্নে বিভোর হয়ে হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে।... নিশ্চিন্ত সুখ বলে কিছু নেই এদের। ভাগ্যকে অবিরত প্রশ্ন করে চলেছে এরা। খেয়ালের বশে জটিল পথ আরো জটিল করে তোলাই এদের কাজ।
নইলে নীলা কেন দীর্ঘ এক যুগ ধরে অনবরত হারানো খুশিকে খুঁজে বেড়াবে? ক্লান্তিহীন শ্রান্তিহীন এই অনুসন্ধানের সাধনা যদি তুচ্ছ একটা পলাতক শিশুর উদ্দেশে না হয়ে আধ্যাত্মিক খাতে প্রবাহিত হতো, তাহলে বোধ করি এতোদিনে ভাগ্য বদলে যেত।
কিন্তু সে কথা কে বোঝাবে নীলাকেকে? কে ফেরাতে পারবে ওকে ওর এই উৎকট সাধনার পথ থেকে?
অরণব হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে, আর বোঝাবার চেষ্টা করে না। অপরিণত বুদ্ধির ক্ষণিক অসাবধানতার খেসারত জোগাচ্ছে পরিণত জীবনের সমস্ত সামর্থ্য দিয়ে।...
অনেক দিন-অনেক সময় বার বার এই কথাটাই ভেবেছে সে। কিন্তু অসাবধানতাটা কি কেবলমাত্র নীলার? বিশ বছর আগের সেই অভিশপ্ত ক্ষণটাকে কি সে বিশ হাজার বার যাচাই করেনি মনে মনে?...
সুদূর প্রবাসযাত্রার পূর্বক্ষণে, বিচ্ছেদবেদনার আশঙ্কায় কাতর রোহিতের কম্পিত হহৃদয়ের কাছে নিজেকে অমন নিঃশেষে সমর্পণ করতে এলো কেন নীলা?... নিজের আকুলতার তীব্রতা বোঝাতে?... অনেকটা দুঃখ বোঝাবার জন্যে অনেকটা মূল্য দিতে?...
নীলা অবুঝ ?... কিন্তু রোহিতই বা খুব বেশি বুঝমান হবে কিসের জোরে? নীলা কিশোরী ?... রোহিতই বা তখন কতো বিজ্ঞ বিচক্ষণ ছিল?
অপরাধের ওজন কষবে কে?... নিজের মনের বিচার আর বিশ্লেষণ দিয়ে যাই স্থির করুক, তবু নিজেকেই দণ্ড দিতে চেয়েছে রোহিত, অপরাধীর নম্রতা নিয়ে দাঁড়িয়েছে নীলার সামনে, তাই নীলার এই যুক্তিহীন খেয়ালের বাহক সে।
-'খুশিকে খুঁজে বার করতেই হবে"-নীলার এই ইচ্ছার বেগে এক যুগ ধরে চালিত হচ্ছে রোহিত।... কোন্ ফাঁকে কর্তব্য পরিণত হয়েছে অভ্যাসে, অভ্যাস দাঁড়িয়েছে স্বভাবে।...
হতাশ হয়েছে, হাল ছেড়ে দিয়েছে, তবু দিনের পর দিন নীলাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে-পথে ঘাটে, হাটে, বাজারে, স্কুলের গেটে, খেলার মাঠে, সিনেমায়, সার্কাসে, মেলায়, যাত্রায়, অনাথাশ্রমে, হাসপাতালে।..
কোথায় নয়? হারানো একটা মেয়েকে হঠাৎ দেখতে পাবার সম্ভাবনা কোথায় নেই?
অদেখা খুশি কে খুঁজে বার করতে হলে নীলাকে নিয়ে বেড়ানো ছাড়া উপায় কি?
খুশিকে যে স্কুলে ভর্তি করা হয়েছিল,সেখান থেকে সে কোথায় চলে গেল,তার খবর কেউ রাখেনি,জান্তেও চাইনি।মা বাবা হারা মেয়ের খঁোজ কেবা রাখে..
মায়ের হাতের পুতুল ছিল নীলা, বিনিদ্র রাতের, নির্জন অবসরে লুকিয়ে লুকিয়ে শুধু খুশির উপস্থিতির সমস্যাই ভেবেছে, অনুপস্থিতির সমস্যাটা তো ভেবে দেখেনি কোনোদিন।
তা ভাবলেই বা করতো কি? ফটো তুলিয়ে রাখতো খুশির? নামপরিচয়ের মোহরাঙ্কিত পদক ঝুলিয়ে দিতো খুশির গলায়!...
নীলা।-যে নীলা দু'শোটা শাড়িজামার স্তূপের ওপর বসে নিরুপায় দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছে দুটোমাত্র রং-জুলা ফ্রক পরে কী ভাবে দিন কাটছে খুশির। খুশি কোনোদিন একফোঁটা দুধ খেতে পেতো কি না নীলার জানা ছিল কি? খুশির খাওয়া হয়েছে কি না এই সাধারণ প্রশ্নটুকুও করবার সাহস কোনোদিন হয়েছিল খুশির?
নিজে হাতে করে কখনো কিছু খেতে দিয়েছিল নীলা খুশিকে?...
কি যেন দিয়েছিল না একদিন? তুচ্ছ বস্তু মাত্র। রূপোলী রাঙতায় মোড়া একখানা চকোলেট! আশ্চর্য, সেই চকোলেটখানা খায়নি খুশি! কী ভেবেছিল? খাবার জিনিস কি না বুঝতে পারেনি? তা নয়তো কাগজের ওপর কাগজ মুড়ে মুড়ে অতো যত্নে ছাদের সিঁড়ির জাফ্রিতে তুলে রেখে দিয়েছিল কেন?...
খুশি একবার যদি মা বলে মেনে নিত তাহলে হয়ত সমাজের কাছে নীলা খারাপ হয়ে যেত কিন্তু এই বেদনা তাকে আর সহ্য করতে হতো না।তার জীবনে কী বা হারাবে নিজেই হারিয়ে গেছে সমাজ থেকে।
.... পদ্মপুকুরের সেই ভাড়াটে বাড়িটার সিঁড়িতে।
যে বাড়ির বাতাসে হয়তো আজও ভেসে বেড়াচ্ছে অবহেলিতা নীলার দীর্ঘশ্বাস... খুশিরর স্মৃতির আভাস হারিয়ে যাবার ভয়ে যে বাড়িখানা ছাড়তে পারেনি নীলা।
.... অথচ নীলা এখনো ভালো ভালো শাড়ি জামা পরছে। ভালো জিনিষই খাচ্ছে। তবু রোহিত বলবে- 'নীলা পাগল', 'নীলা কাণ্ডজ্ঞানহীন', 'নীলা অধীর'!
নীলা অধীর? দীর্ঘ সাত-সাতটা বছর অতো ধৈর্য ধরে ছিল কি করে তবে? ...বিদ্রোহ করেনি... পাগল হয়নি, একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি তো।...কিন্তু কেন করেনি?... কেন মায়ের বিদ্বেষদৃষ্টির সামনে থেকে তাকে আড়াল করে দাঁড়ায়নি? কেন অন্যের রুক্ষকর্কশ হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে নিজের বুকের ভেতর আশ্রয় দেয়নি? কেন চিৎকার করে সারা জগৎকে শোনাতে পারেনি-'খুশি আমার! খুশি আমার। খুশিকে হতশ্রদ্ধা করবার অধিকার তোমাদের নেই।'
অরণব এসে ঢুকলো। পিছন দিকে মিনিট খানেক দাঁড়িয়ে থেকে হতাশ-বিরক্ত কণ্ঠে বলে উঠলো-আবার তুমি একলা একলা বিড় বিড় করে কথা বলছো?
সেদিন প্রতিজ্ঞা করলে না আমার কাছে-আর বলবে না!
নীলা অসহায় দৃষ্টি মেলে বলে-কই, বলিনি তো কথা?
-আর এই যে শুনলাম আমি?
-বলেছি? আচ্ছা আর বলবো না ।...চা খেয়েছো?
-চা? তবু ভালো যে এই তুচ্ছ কথাটাও মনে পড়লো।
-রাগ করেছো?
-রাগ? তোমার ওপর রাগ করলে তো-ওই আকাশের মেঘখানার ওপরও রাগ করতে হয়। ...রাগ নয়-কিন্তু এভাবে আর কতোদিন চলবে? এখনো কি আশা রাখো তুমি?
-আশা রাখবো না? রাখতে বারণ করছো?
-বারণ আমি করছি না নীলা, কিন্তু তুমি বুদ্ধিটাকে একটু পরিষ্কার করে দেখ না।
যদি পাবার হ'তো তাহলে চুঁচড়োতে সেই বুড়ির বাড়িতেই কি পেতাম না আমরা? কয়েকটা দিনের জন্যে চিরদিনের মতো হারাতাম আবার?
নীলা চুপ করে যায় বটে, কিন্তু বেশিক্ষণের জন্যে নয়, আবার একটু পরেই চোখ তুলে বলে-আচ্ছা, পালিয়ে যে গেল, কোথায় গেল? পথে তো বিপদ-
-হয়তো ভাগ্য আবার জুটিয়ে দিয়েছেন নিরাপদ আশ্রয়।... এবার তাকে ভুলতে চেষ্টা করো নীলা, এ খোঁজার পালা শেষ হোক। শেষ পর্যন্ত কি পাগল হয়ে যাবে?
-ভুলতে বলছো? খোঁজার পালা শেষ করে দেবো?-খুশি কিছুক্ষণ যেন অপেক্ষা করে অরণবে উত্তরের আশায়, তারপর আনমনে বলে-তারপর, তারপর কি করবো?
-কি আবার করবে?... অরণব জোর দিয়ে বলে-সাধারণ মানুষে যা করে। হাসবে, গল্প করবে, পাঁচজনের সঙ্গে মিশবে, ঘরসংসার করবে-এই। কতো লোকের তো প্রথম সন্তান মারাও যায় নীলা।
স্বামীর ব্যাকুলতা নীলার হৃদয় স্পর্শ করে না কি?
হয়তো করে। কিন্তু খুশিকে ভুলে গিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘরসংসার করতে হবে? প্রতিনিয়ত বিঁধবে না অপরাধ-বোধের সুতীক্ষ্ণ কাঁটা? তাই সে বলে-মারা গেলে তো সান্ত্বনা থাকে উপরওয়ালা নিয়েছেন।
অরণব ওর পিঠের ওপর হাত রেখে সস্নেহে বলে-তাই মনে করে মনকে সান্ত্বনা দাও নীলা!
চলবে......
নীলা
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
67
Views
0
Likes
0
Comments
0.0
Rating