ছায়া

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
যখন আমরা ‘প্রতিশোধ’ শব্দটা বলি, তখন আমাদের চোখে ভেসে ওঠে সিনেমার মতো দৃশ্য—বীরের মতো আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়া, শত্রুকে ধ্বংস করা, কিংবা শেষ দৃশ্যে ন্যায়ের জয়।
কিন্তু লিজেনের প্রতিশোধ ছিল শব্দহীন।
সে কারো কাছে যায়নি, পুলিশের কাছে অভিযোগ করেনি, টকশোতে কথা বলেনি।
সে শুধু নিজেকে বদলাতে শুরু করেছিল—একটা সাধারণ, সাদামাটা মানুষ থেকে এমন একজন হয়ে ওঠার পথে পা বাড়াল, যার সম্পর্কে কেউ কিছু জানবে না, শুধু তার কাজগুলো দেখবে আর আঁতকে উঠবে।

লিজেন প্রথমে বুঝতে চেয়েছিল আয়াত কাকে নিয়ে কাজ করছিল। আয়াতের গবেষণার মূল তথ্যগুলো ছিল ‘GovTech Biolab’ নামে একটি গবেষণাগারে সংরক্ষিত। এটি একটি সরকার অনুমোদিত, কিন্তু বেসরকারি মালিকানাধীন ল্যাব, যেটা অত্যন্ত গোপনে কাজ করে।

লিজেন সেই ল্যাবের কিছু তথ্য অনলাইনে খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করে যে, প্রতিষ্ঠানটি G-9 ফাউন্ডেশন দ্বারা তহবিল পায়। আর এই G-9 ফাউন্ডেশন হলো এমন একটি সংগঠন, যাদের মূল উদ্দেশ্য হলো "বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে জাতীয় নিরাপত্তা জোরদার করা"। কথাটা শুনতে ভালো লাগলেও, বাস্তবে এই সংগঠনটি বিতর্কিত—তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তারা এমন অনেক প্রযুক্তি তৈরির চেষ্টা করে যেগুলো মানবাধিকারের জন্য হুমকি।

এই G-9 ফাউন্ডেশনকে আয়াত একবার একটি টিভি ইন্টারভিউতে প্রশ্ন করেছিলেন—

> “আপনারা যে ধরনের প্রযুক্তি বানাচ্ছেন, সেটা মানুষকে সাহায্য করবে না, বরং নিয়ন্ত্রণ করবে। এটা কি বিজ্ঞান না নতুন দাসত্বের হাতিয়ার?”



এই প্রশ্নের পর থেকেই আয়াতকে বিভিন্ন জায়গায় নজরদারিতে রাখা হচ্ছিল। লিজেন এসব তথ্য সংগ্রহ করছিল ধীরে ধীরে—নিউজের পুরোনো ফুটেজ, আয়াতের বন্ধুবান্ধবের ফেসবুক পোস্ট, পুরোনো ব্লগ। একটা নিখুঁত চিত্র তৈরি হচ্ছিল তার মাথায়।


---

তবে এখানেই আসে সেই স্টেশন—ছায়ার স্টেশন।

এই স্টেশনটা সরকারি রেলওয়ের তালিকায় নেই। ম্যাপে থাকলেও, সাধারণ ট্রেন কখনো সেখানে থামে না।
পুরো স্টেশনটাই অবহেলায় পড়ে আছে, একপ্রকার ‘পরিত্যক্ত’ বলা যায়।

তবে কিছু লোক বলেন, সেখানে প্রতি মাসে একবার, ঠিক ৩টা ১৫ মিনিটে, এক অদ্ভুত ট্রেন আসে। কোনো শব্দ ছাড়াই চলে আসে, পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর চলে যায়। এই ট্রেনকে বলে "ঘুমের ট্রেন"—কারণ বলা হয়, যারা এতে চড়ে, তারা আর ফিরে আসে না বা ফিরে এলেও আগের মানুষ থাকে না।

আয়াত তার মৃত্যুর আগের সপ্তাহে এই স্টেশনে গিয়েছিল—এটা নিশ্চিত। সে একটি USB ড্রাইভ পাঠাতে চেয়েছিল তার এক পরিচিত বিজ্ঞানীর কাছে, যিনি চট্টগ্রামে থাকেন। কিন্তু সে কোন মাধ্যমে পাঠিয়েছিল, তা কেউ জানে না।

লিজেন মনে করে, আয়াত এই ট্রেনের মাধ্যমেই কিছু পাঠাতে চেয়েছিল—কারণ সে কাউকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। আর সেই ট্রেনেই হয়তো আসছিল মুখোশধারী কেউ, যে আয়াতকে "চিরতরে চুপ" করিয়ে দিতে চেয়েছিল।


---

লিজেন তার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ছায়ার স্টেশন ঘুরে দেখতে শুরু করল। দিনে সেখানে যাওয়া নিরাপদ, কারণ তখন কোনো ট্রেন আসে না, শুধু পুরোনো কাঠের বেঞ্চ, ভাঙা জানালা, আর ঘন গাছপালায় ঢাকা প্ল্যাটফর্ম দেখা যায়।
কিন্তু রাতে?
রাতে স্টেশনটা পুরো অন্যরকম।

এক রাত, ২টা ৪৫ মিনিট। লিজেন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে, ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে আছে।

হঠাৎ সে টের পায়, বাতাসে একটা শব্দ—মৃদু গর্জনের মতো, যেন কিছু দূর থেকে এগিয়ে আসছে।
ঠিক ৩টা ১৩ বাজে। লিজেনের শরীর জমে যায়।
৩টা ১৪...

ট্রেনটা আসে।
নীরব। কোনো লাইট নেই, কোনো শব্দ নেই।
কিন্তু সে জানে এটা ট্রেন, কারণ লোহার চাকার ঘর্ষণ মাটির সঙ্গে একটা ছায়া তৈরি করছে।

ট্রেনটা থামে। দরজা খোলে না, কিন্তু ভিতরে আলো জ্বলছে—নীলচে আলো।
আর তখনই এক পাশে একটা দরজা খুলে যায়, আর সেখান থেকে একজন মুখোশধারী মানুষ নেমে পড়ে। তার মুখে কালো মাস্ক, চোখে সানগ্লাস, হাতে একটা পাতলা ব্যাগ।

সে কিছুক্ষণ স্টেশন চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকে।
তারপর হঠাৎ করেই মুখ ঘুরিয়ে লিজেনের দিকে তাকায়।
তাদের চোখে চোখ পড়ে।

স্টেশনের বাতাস থেমে গেছে। লিজেনের হৃদস্পন্দন যেন কানে শোনা যাচ্ছে—ধক… ধক… ধক…।
মুখোশধারী মানুষটা শুধু তাকিয়ে আছে। কোনো শব্দ নেই, কোনো অঙ্গভঙ্গি নেই।
সেই এক দৃষ্টিতে এমন এক চাহনি, যেন সে লিজেনকে আগে থেকেই চিনে।

লিজেন ভয় পায়নি, বরং তার শরীরের ভিতর একধরনের ঠান্ডা আগুন জ্বলে উঠল। সে নিজেকে বলে,

> “এই লোকটা জানে কিছু। এই ট্রেন, এই স্টেশন, আয়াতের মৃত্যু—সব কিছুই এর সঙ্গে জড়িত।”



মুখোশধারী লোকটা ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে আসে। হাতে থাকা ব্যাগটা মাটিতে রাখে, তারপর নীরবে একটা কাগজ বের করে লিজেনের দিকে বাড়িয়ে দেয়।

লিজেন কাগজটা নেয়। কোনো শব্দ নেই।

কাগজে বড় হরফে লেখা—

> “তুমি যদি সত্যি খুঁজতে চাও, তাহলে রাত ৪টায় এই ব্যাগ খুলো। আগে না।”



লোকটা এরপর ঘুরে দাঁড়ায়, আবার ট্রেনের দরজায় উঠে পড়ে।
ঠিক ৩:২০—ট্রেনটা আবার নিঃশব্দে চলে যায় অন্ধকারের মধ্যে।


---

লিজেন বসে পড়ে সেই ব্যাগটা নিয়ে।
৪টার অপেক্ষা করতে করতে তার মস্তিষ্কে একের পর এক প্রশ্ন ছুটে আসতে থাকে:

আয়াত কি সত্যিই এই ট্রেন ব্যবহার করেছিল?

মুখোশধারী লোকটা তাকে চিনল কীভাবে?

ব্যাগে কী এমন আছে যা এখনই দেখা যাবে না?

সবচেয়ে বড় কথা—কে এই G-9?


ঘড়ি টিকটিক করে এগোতে থাকে।
৩টা ৪৫...
৩টা ৫৮...

ঠিক ৪টা বাজতেই সে ব্যাগটা খোলে।

ভিতরে:

1. একটা ছোট ড্রাইভ—আধা-স্বচ্ছ, আয়াতের তৈরি প্রযুক্তির মতো দেখতে।


2. একটা ছবি—আয়াত, ল্যাবের ভিতরে দাঁড়িয়ে আছে, পাশে দুজন মানুষ, যাদের মুখ অস্পষ্ট।


3. আর একটা কাগজ—হাতের লেখা, আয়াতেরই।



কাগজে লেখা:

> “যদি আমি বেঁচে না থাকি, তাহলে এই ড্রাইভটা সেই লোকটার হাতে দিও, যাকে চোখ দেখে তুমি চিনতে পারবে। তুমি যদি তাঁকে চিনে ফেলো, তার মানে তুমি সত্যিকারের অনুসন্ধানকারী। ভয় পেও না, লিজেন। এই পথ সহজ নয়, কিন্তু তুমি পারবে। আমি জানি।”
— আ য়াত


লিজেন থমকে যায়।
আয়াত তার নাম জানত?

কখন? কিভাবে?

সে কীভাবে জানত, যে একজন অচেনা যুবক একদিন তাকে অনুসরণ করবে?
সে কী আগে থেকেই কিছু আঁচ করেছিল?

লিজেনের মাথার ভিতর একটা ঘূর্ণি শুরু হয়। এখন প্রশ্ন নয়, বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার সময়।


---

বুঝিয়ে দিচ্ছি এই অংশের মূল বিষয়ের ব্যাখ্যা:

মুখোশধারী মানুষ: সে G-9-এর কেউ হতে পারে, অথবা আয়াতের গোপন সহকারী। তার আচরণে কোনো হুমকি ছিল না, বরং সে কিছু একটা বোঝাতে এসেছিল।

ব্যাগে থাকা জিনিস:

ড্রাইভটি সম্ভবত আয়াতের গবেষণার মূল তথ্য।

ছবিটি ইঙ্গিত করে যে, আয়াত জানত তাকে কেউ মেরে ফেলবে এবং এর সঙ্গে কিছু পরিচিত মুখ জড়িত।

আয়াতের হাতে লেখা চিঠি প্রমাণ করে, সে আগে থেকেই লিজেনের উপস্থিতি আন্দাজ করেছিল।


“চোখ দেখে চিনে ফেলো” লাইনটি বোঝায়—একজন মানুষকে তার চাহনি বা ভেতরের সত্যতা দিয়ে চেনা যাবে, শুধু বাইরের চেহারা দেখে নয়।

চলবে
55 Views
1 Likes
0 Comments
0.0 Rating
Rate this: