দ্বিতীয় বসন্ত

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
প্রথম বসন্তের মতোই, আবারও তখন বাগানের রূপ নেয় অন্যরকম একটা রঙে। গাছে গাছে লাল, হলুদ, গোলাপী ফুল ফোটে, আর মাটির গন্ধে মিশে থাকে বৃষ্টির স্পর্শ। প্রথম বসন্ত ছিলো একরকম উদ্বিগ্ন, অনিশ্চিত, একে অপরকে বুঝে নেওয়ার প্রথম যন্ত্রণার সঙ্গে। কিন্তু এই দ্বিতীয় বসন্ত, এই বার কতকিছু বদলে গেছে, কতটা নিঃশব্দ হয়ে এসেছে অন্তরে।

সুমন বাগানে বসে তার হাতে থাকা বইটা রেখে দিলো। চারিদিকে ফুলের সুবাস আর পাখির কুজন, আর তার মনের গভীরে একটা মিশ্র অনুভূতি ঘুরপাক খাচ্ছিলো। তিনি জানতেন, আজকের দিনে আজেবাজে কথা, পুরনো স্মৃতির গল্প যেন আর চলে না। আজকের দিনে ছিলো তার জীবনের এক বড় মোড়।

দু'বছর আগে, একই বাগানের এই বেঞ্চেই তার পরিচয় হয়েছিলো রিমার সঙ্গে। রিমা, যে ছিলো শহরের এক অজানা রূপ। নিজের মতো একটা আলো, যার মধ্যে গোপন স্বপ্ন আর ভাঙা আশা লুকিয়ে ছিলো। প্রথম বসন্তে তাদের ভালোবাসা যেনো ছিলো বৃষ্টির ফোঁটার মতো—হালকা, নরম, কিন্তু মিষ্টি।

তারা দুজনেই জানতো না ভালোবাসা মানে ঠিক কী। জানতো না সময়ের সাথে সাথে সেটা কেমন বদলে যাবে। হয়তো ভালোবাসা মানে ছিলো একসাথে বসে হাসি ভাগাভাগি করা, অথবা আকাশের তারা গোনা। কিন্তু সময়ের কাছে ভালোবাসা হলো নিজের আঁচলটা গুটিয়ে রাখা, নির্জন হয়ে যাওয়া।

সুমন চোখ বন্ধ করে এক একটা মুহূর্ত মনে করলো—রিমার সঙ্গে কাটানো সেই দিনগুলো, যখন তারা একসাথে বৃষ্টি ভেজা রাস্তার ধারে হাঁটতো, কখনো কখনো তর্ক করতো, আবার কখনো চুপচাপ শুধু একসঙ্গে বসে থাকতো। কিন্তু সেই সব দিন, যেখানে তারা একে অপরের চোখে স্বপ্ন দেখতো, এখন তা যেনো মেঘের আড়ালে হারিয়ে গেছে।

সে দিন রিমা হঠাৎ করেই চলে গিয়েছিলো, কোন ঘোষণা ছাড়া, কোন ব্যাখ্যা ছাড়া। শুধু একটা চিঠি রেখে গিয়েছিলো, যেখানে লেখা ছিলো, "আমি আর সেই মানুষ নই, যে তুমি চিনেছো। আমার পথ এখন ভিন্ন। আমি তোমাকে আর দুঃখ দিতে চাই না।"

সুমন পড়ে ফেলেছিলো সেই চিঠি অনেকবার, কিন্তু বুঝতে পারেনি কীভাবে সব শেষ হয়ে গেলো। হয়তো ভালোবাসার শুরুটা যেমন ছিলো অগোছালো, তেমনই শেষটা ছিলো নিস্তব্ধ।

এবার দ্বিতীয় বসন্তে, সুমন ঠিক করেছিলো এই বাগানের এই বেঞ্চে বসে শেষবারের মতো রিমাকে খুঁজে পাবে নিজের মনের ভেতর থেকে। সে হাত বাড়িয়ে বাতাসের একটা ফুল ছুঁয়ে ধরল, মনে করল, হয়তো রিমাও আজ কোনোটা ফুলের মতো কোথাও আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।

এখন আর কিছু বলার ছিলো না। শুধু একাকীত্বের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে রাখা।

বসন্তের হাওয়া আবার নতুন গান গাইছে। পাখিরা আবার নতুন আকাশে উড়ে যাচ্ছে। আর সুমন বুঝতে পারলো, জীবনে অনেকবার বসন্ত আসে, কিন্তু প্রতিবার নতুন কিছু শেখায়—ভালোবাসার মানে, হারানোর মানে, বাঁচার মানে।

সে দিনের শেষে সুমন উঠে দাঁড়ালো, একটা নতুন সিদ্ধান্ত নিয়ে। হারানো ভালোবাসাকে আর তার কষ্টকে নিজের উপর চাপিয়ে রাখবে না। বরং নিজের জন্য একটা নতুন বসন্ত শুরু করবে। যেটা হয়তো পুরনো দিনের স্মৃতির থেকে একটু আলাদা হবে, কিন্তু তার অন্তরে নতুন আলো জ্বালাবে।

যখন বাগানের গাছগুলো ফুল ফোটাবে, তখন সুমনও ফুলের মতো তার জীবনকে নতুন রঙে রাঙাবে। সে জানে, দ্বিতীয় বসন্ত সবসময় প্রথম বসন্তের মতো একই রকম হয় না, কিন্তু সে আবারও ফুল ফুটাতে পারে নিজের জীবনের বাগানে।

তার চোখে অশ্রু এলো, কিন্তু এবার তা বিদায়ের নয়, বরং নতুন আশা আর জীবনের প্রতি বিশ্বাসের। বসন্ত এসেছে নতুন রূপে, নতুন রঙে, নতুন জীবনে।

সুমন হাঁটতে থাকলো, বাগানের পথ ধরে, ফুলের মধুর গন্ধ নিয়ে, নতুন সূর্যের আলোকে বুকে নিয়ে।

দ্বিতীয় বসন্ত যেন এক নতুন গল্প বলছে — জীবনের, ভালোবাসার আর আবার শুরু করার।
30 Views
4 Likes
0 Comments
0.0 Rating
Rate this: