জীবনের একটা সময় আসে, যখন মানুষ আর নতুন কিছু চায় না, শুধু একটা মুখ চায় পাশে থাকার জন্য। একজোড়া চোখ, যেগুলো ক্লান্তি বোঝে, না বলা কথাগুলো পড়ে নিতে পারে। আবিরের জীবনে ঠিক এমন একটা মুহূর্ত এসেছিল।
চল্লিশ ছুঁইছুঁই আবির এখনো বিয়ে করেনি। শহরের বড় ফার্মে চাকরি করে, প্রতিদিন সকাল নয়টায় বের হয়ে রাত দশটায় বাড়ি ফেরে। ফ্ল্যাটে ঢুকেই জুতো খুলে থোথো পায়ে চলে যায় বারান্দায়, নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে শহরের বাতি আর কুয়াশায় মোড়া সন্ধ্যায়। তারপর মাইক্রোওয়েভে রাখা খাবার খেয়ে টিভি চালিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
এভাবেই কাটছিল তার জীবন।
আবিরের মা মারা গেছেন বহু বছর আগে, বাবা গ্রামে থাকেন, মাঝে মাঝে ফোন করেন— “বিয়েটা করিস কবে?” — এই কথাটুকু বলার জন্যই যেন।
আবির হাসে। বিয়ে... এখনো কেন যেন ভয় পায়। মনে হয়, কেউ যদি চলে যায়? যদি ভালোবেসে ফেলি, আর সে দূরে সরে যায়? এত বছরেও সে প্রেমে জড়াতে পারেনি। কাউকে ভালো লেগেছে, সেটা বলতে পারা হয়নি। হয়তো সাহস ছিল না, হয়তো সময়।
একদিন, অফিস থেকে ফেরার পথে, ফুটপাতে হঠাৎ একটি কুকুরছানাকে দেখে থেমে যায় আবির। ছোট্ট, মলিন, কাঁপছে ঠান্ডায়। লোকজন পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে, কেউ একবারও নিচে তাকাচ্ছে না। আবির দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর তার লাঞ্চ বক্স খুলে সামান্য কিছু খাবার দেয় ছানাটাকে। ছানাটা খেতে শুরু করে, যেন বহুদিন পর খাবার পেয়েছে।
সেদিন রাতে আবির বাড়ি নিয়ে আসে ছানাটাকে।
নাম দেয়— "মিষ্টি"।
এরপর প্রতিদিন কাজ থেকে ফিরেই সে মিষ্টির সঙ্গে সময় কাটায়। ওকে স্নান করানো, খাবার দেয়া, একসাথে বারান্দায় বসে থাকা— যেন একাকীত্বের মধ্যে একটা নরম জ্যোৎস্না নেমে আসে।
একদিন আবির অফিস থেকে ফিরে দেখে, মিষ্টির চোখ লাল হয়ে আছে, নিঃশ্বাসে কষ্ট। ঘাবড়ে যায় সে। দৌড়ে ভেটেরিনারি ক্লিনিকে নিয়ে যায়।
সেখানে দাঁড়িয়ে দেখা হয় রূপার সঙ্গে।
রূপা সেখানে একজন ভেট ডাক্তার। সাদা কোট পরা, গলায় স্টেথো ঝুলছে, চোখে ভারী চশমা। প্রথমে কথা বলেনি বেশি। রোগী দেখে বলেছিল—
— “ঠান্ডা লেগেছে। ইনজেকশন দেব, দুদিন দেখুন, ঠিক হয়ে যাবে।”
আবির অবাক হয়ে তাকিয়েছিল তার দিকে। কণ্ঠে ছিল মমতা, কিন্তু চোখে ছিল শৃঙ্খলা। একজন সঙ্গীর জন্য যা যা দরকার, সব যেন ওই মেয়েটার চোখে ছিল।
তারপর থেকে মিষ্টির চিকিৎসার অজুহাতে বারবার যেতে থাকে আবির। রূপা বুঝতে পারে। মুচকি হেসে বলে—
— “কুকুরটা তো এখন সুস্থ। আপনি না, বেশি অসুস্থ!”
আবির হেসে ফেলে।
— “হয়তো। আমি আসলে একা থাকি অনেকদিন ধরে। মিষ্টির পর থেকেই আমার দিনটা কিছুটা আলাদা হয়েছে।”
রূপা চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে—
— “একাকীত্ব বড় অদ্ভুত রোগ। ঔষধ নেই। কিন্তু পাশে কেউ থাকলে ঠিক হয়ে যায়।”
এই কথার পর, তাদের দেখা হওয়া নিয়মিত হয়। মাঝে মাঝে কফি, কখনো বই মেলা, আবার কখনো শুধু হাঁটাহাঁটি। আবির ধীরে ধীরে অনুভব করে, রূপা একা নয়, কিন্তু নিঃসঙ্গ। ছোটবেলায় মা মারা গিয়েছিল, বাবা আরেকটা পরিবার গড়েছে। রূপা থেকে গিয়েছে দাদীর কাছে। এখন একাই থাকে। আবিরের গল্প শুনতে শুনতে একদিন সে বলে—
— “তুমি খুব অদ্ভুত একটা মানুষ। নরম, কিন্তু নিজেকে আড়াল করো।”
আবির উত্তর দেয়—
— “ভয় পাই। ভেঙে যেতে ভয় পাই।”
রূপা বলে—
— “সব কিছু ভাঙে না। কিছু কিছু সম্পর্ক গড়ার জন্যই তৈরি হয়।”
এরপর একদিন, এক বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায়, রূপা বলে—
— “তুমি কি জানো, সঙ্গী কাকে বলে?”
আবির তাকায়।
— “যে মানুষটা তোমার ক্লান্ত চোখ দেখে বলে, ‘চলো, এক কাপ চা খাই।’ যাকে দেখে বোঝা যায়, জীবনের সব কষ্ট সহ্য করেও সে হাসতে জানে। আমি তেমন কাউকে চাই।”
আবির ধীরে ধীরে বলে—
— “তুমি হলে আমার সেই মানুষ, রূপা। আমি কখনো বলিনি, কিন্তু আমি ভালোবাসি তোমাকে। তুমি চাইলে সারা জীবন পাশে থাকবো।”
রূপা চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে—
— “আমি চাই, আমার জীবনের গল্পে তুমিই হও শেষ অধ্যায়ের নাম— সঙ্গী।”
সেদিন রাতে মিষ্টি তাদের দুজনের মাঝখানে বসে ছিল, মাথা গুঁজে ঘুমোচ্ছিল। বাইরে বৃষ্টি থেমে গেছে। জানালার ওপাশে নরম আলো পড়ছিল রূপার চুলে।
আবির জানতো, আজ থেকে সে আর একা নয়।
তার পাশে একজন আছে, যাকে সে চোখে চোখ রেখে বলতে পারে— “তুমি আমার সঙ্গী।”
সঙ্গী
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
23
Views
2
Likes
0
Comments
0.0
Rating