বর্ষার ধুন্ধুমার বিকেল ছিল সেটা। ঢাকা শহরের জ্যাম তখনও শহরের শিরায় শিরায় জমে আছে, আর বৃষ্টি যেন আকাশের অভিমান ঝরিয়ে দিচ্ছে একটানা। কিন্তু এই গল্পটা ঢাকার নয়, অনেক দূরের এক ছোট শহরের, যেখানে এখনো রাস্তার পাশে ছাতা বিক্রি হয় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, যেখানে ছোট ছোট চায়ের দোকানে এখনো বৃষ্টির সময় গান চলে বাজনাবিহীন কণ্ঠে।
ওই শহরের এক কোণায় দাঁড়িয়ে ছিল তাসনিম। চোখে স্পষ্ট বিরক্তি, কপালে চিন্তার রেখা, আর পাশে একটা ছাতা যেটার কোনো কাজ হচ্ছিল না। কারণ ছাতার থেকে পানি ঝরছিল আরও বেশি। ছাতার চেয়ে বরং তার হাতের মোবাইলটাই বেশি ভিজে যাচ্ছিল।
— “এই যে বলেছি না, আমি আর তোমার সঙ্গে কোনো কথা বলবো না! Enough is enough!”
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। নাম তার রাফি। নিঃশব্দ দাঁড়িয়ে থাকা মানে তার অপরাধ স্বীকার নয়, বরং সে জানতো, এই মেয়েটার রাগ ঠান্ডা হতে হলে তাকে আগে তার মনের ঝড়টা চলতে দিতে হবে।
তাসনিম কথা বলছে, চিৎকার করে, মাঝেমধ্যে কাঁদছে, মাঝেমধ্যে হাত তুলে দেখাচ্ছে রাফির অযোগ্যতা।
— “তুমি জানোই না আমি কেমন ফিল করি! সবার সামনে আমাকে ছোট করো, আর তারপর এসে বলো, ‘আমি তো মজা করছিলাম!’ মজা না, এটা অপমান!”
রাফি তবুও চুপ। শহরের লোকেরা তাকিয়ে দেখছে। রিকশাওয়ালা হাসছে। দোকানদার একটু ঘাড় ঘুরিয়ে শুনছে, যেন নাটক চলছে। বৃষ্টির ভেতরেও এই নাটকটা জমে উঠেছে।
তাসনিম হঠাৎ থেমে গেলো। পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু সেটা বৃষ্টি না, নাকি চোখের পানি — বোঝা যাচ্ছে না।
রাফি তখন ধীরে ধীরে কথা বললো, গলায় মৃদু কাঁপুনি, কণ্ঠে গভীরতা—
— “তুমি জানো, আমি কেমন করে তোমায় ভালোবাসি? জানো না। কারণ আমি সেটা ঠিক মতো বলি না। আমি অভ্যস্ত না এসব বলতে, আমি যে ধরনের পরিবারে বড় হয়েছি, সেখানে আবেগ দেখানো মানে দুর্বলতা। তাই ভুল হতেই পারে।”
তাসনিম কাঁদছিল, মুখ ঘুরিয়ে নিলো।
— “তুমি চাও আমি নাটক না করি? আমি নাটক করবো না, কিন্তু তুমি যদি ভালোবাসা বুঝতে না পারো, তাহলে কিছুই করার নেই।”
তাসনিম ধীরে ধীরে তার ছাতা বন্ধ করে ফেললো। রাফির চোখের দিকে তাকিয়ে বললো—
— “ভালোবাসি না বললেও চলে, কিন্তু আমি চাইলেই আর ভালোবাসবো না— এটা তুমি ভাবো না। আমি থাকবো না আর।”
এই বলে সে চলে গেলো। হেঁটে, ভিজতে ভিজতে, ছাতা ছাড়াই।
সেই বিকেল থেকে রাফির মাথার মধ্যে একটাই শব্দ গুঞ্জন করে— "আমি থাকবো না আর"।
তারা প্রেম করছিল চার বছর ধরে। কলেজের সাইন্স ফেয়ারে দেখা, এরপর একসাথে প্রজেক্ট বানানো, সেই থেকে শুরু। রাফি ছিল চুপচাপ ছেলে, সহজে কিছু বলে না, কিন্তু চোখে তার কিছু একটা ছিল যেটা তাসনিমকে সব কিছু ছেড়ে তার পাশে দাঁড়াতে বাধ্য করেছিল।
তাসনিমের চরিত্রটা ছিল আগুনের মতো। প্রতিবাদী, তর্কপ্রিয়, আবেগপ্রবণ। কিন্তু ভালোবাসলে সেটা সর্বস্ব দিয়ে করে। আর এই চার বছরে যতবার রাফি তাকে বুঝতে না পেরে কিছু বলেছে, তাসনিম নিজেকে ভেঙেছে, শুধরে নিয়েছে। কিন্তু আজকের অপমানটা— সবার সামনে — সে নিতে পারেনি।
রাফির ভেতরে একটা কাঁটা বিঁধে রইলো।
পরদিন সে কলেজে গেল না। ফোন করলো না তাসনিমকে। ফেসবুকে ঢুকে দেখলো তার প্রোফাইল পিকচারটা সরানো, কভার ফটো কালো রঙে, আর স্টেটাস: “বাঁচতে হলে কাঁটা এড়িয়ে চলতে হয়।”
রাফির বুকটা হঠাৎ ভারী হয়ে উঠলো।
কয়েকদিন কেটে গেল। একদিন, হঠাৎ তাসনিমের বান্ধবী ফাইজা এসে বললো—
— “রাফি, তুই জানিস, তাসনিম চট্টগ্রাম চলে যাচ্ছে?”
— “কোথায়? কেন?”
— “তার বাবা বদলি হয়েছে। ওরা স্থায়ীভাবে চলে যাবে। আর তাসনিম তোদের শহরেই আর পড়বে না।”
এই কথা শুনে রাফি যেন চেয়ারে বসে থাকার পরও পড়ে যাচ্ছিল। মাথা ঝিমঝিম করছিল। একটা কথাও সে আর জিজ্ঞেস করতে পারলো না। শুধু ফাইজার চোখে দেখে বুঝে গেল— সত্যি।
সেদিন রাতে রাফি কল করলো।
— “তাসনিম…”
— “কে?” গলার স্বর ঠান্ডা, দূরত্বভরা।
— “আমি রাফি।”
— “তুমি ভুল নম্বরে ফোন করেছো।”
— “তাসনিম, প্লিজ… এমন করো না। আমি তো ভালোবাসি তোমায়। ভুল হয়েছিল, স্বীকার করছি। কিন্তু এমন করো না।”
— “ভালোবাসলে প্রমাণ করতে হয়। মুখে বললেই হয় না। তুমি তো সেটা কখনো করোনি। চার বছরে একটা চিঠিও দিলে না।”
চুপ।
— “চিঠি লিখে লাভ কী? এখন তো সব মোবাইলে হয়।”
— “আর এটাই তোমার ভুল ছিল রাফি। ভালোবাসা ডিজিটাল না, ভালোবাসা কাগজে লেখা শব্দ, কাঁপা হাতে আঁকা ভালোবাসার স্বাক্ষর। তুমি সেটা কোনোদিন বুঝোনি।”
— “তাসনিম… আর দেখা হবে না আমাদের?”
— “হবে। খুব দরকার হলে দেখা হবে, কোনো এক অচেনা স্টেশনে, দুইটা আলাদা ট্রেন থেকে নামা যাত্রী হয়ে, তুমি ডানদিকে যাবে, আমি বাঁদিকে…”
ফোন কেটে গেল।
তারপর সত্যি তাসনিম চলে গেলো। স্কুলে রাফির মন বসে না। খাওয়া-দাওয়া প্রায় বন্ধ। রাত জেগে ঘুমহীন চোখে শুধু ভাবতো — “আমি কেন কিছু বলতে পারলাম না আগে?”
অথচ ভালোবাসা তার ছিল। গভীর। নিঃশব্দ। কিন্তু সব ভালোবাসা যদি নিঃশব্দ হয়, তাহলে ভালোবাসা বোঝে কে?
দিন কাটে, মাস যায়। এক বছর পেরিয়ে যায়।
এদিকে রাফি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। ক্লাস, প্রেজেন্টেশন, পার্টি— সব চলছে, কিন্তু ভিতরটা ফাঁকা। চোখে একটাই ছবি— বৃষ্টিভেজা বিকেল, একটা ছাতা ভাঙা, আর মুখ ঘুরিয়ে চলে যাওয়া এক মেয়ে।
একদিন ফেসবুকে একটা ছবি দেখে থমকে যায় সে। তাসনিম। অষ্টম মার্চে একটা পোস্ট—
“Women’s Day — celebrating strength, silence, and second chances.”
ছবিতে দেখা যাচ্ছে তাসনিম একটা স্কুলে পড়াচ্ছে। হাতে সাদা চূড়িদার, চোখে সেই পুরনো দীপ্তি। মনে হলো, কিছু বলছে ছবির ভাষায়, কিন্তু শব্দে নয়।
সেই রাতেই রাফি লিখতে বসলো।
না, মেসেজে নয়। চিঠিতে।
সাদা পৃষ্ঠা, নীল কালির কলম, আর অনেক দিনের ভেতরে জমে থাকা কথা—
*"তাসনিম,
তুমি বলেছিলে ভালোবাসা কাগজে লেখা হয়। আজ আমি সেই কাগজে শব্দ রাখছি।
তুমি যদি কখনো ফিরে চাও, আমি থাকবো ঠিক আগের মতো। বদলে গেছি অনেক, কিন্তু ভালোবাসাটা রয়ে গেছে একই রকম।
তুমি ছিলে আমার আকাশে সেই বৃষ্টির মেঘ— যতই কাঁদাও, তবুও প্রশান্তি দাও।
রাফি।”*
চিঠিটা সে ডাকযোগে পাঠায় সেই পুরনো ঠিকানায়— যেখানে এক বছর আগে তাসনিম থাকতো। জানতো, হয়তো পৌঁছাবে না। হয়তো কেউ ফেরত পাঠাবে। তবুও পাঠায়।
এক সপ্তাহ পর সে একটা খাম পায়। নিজের নাম লেখা। খুলে দেখে, একটা সাদা কাগজে মাত্র দুই লাইন—
"ভালোবাসা শব্দে নয়, প্রমাণে বোঝাতে হয়।
তুমি চিঠি লিখে প্রমাণ দিলে। দেখা হবে, পুরনো বইয়ের গন্ধে ভরা সেই লাইব্রেরিতে।”
তারপর?
দুজনের দেখা হয় পুরনো পাবলিক লাইব্রেরিতে। dusty বইয়ের মধ্যে, নীরব কক্ষে, চোখে চোখ রাখা এক মুহূর্তে।
তাসনিম তাকিয়ে বলেছিল—
— “রাফি, এইবার যদি ভুল করো, আমি কিন্তু আর চলে যাবো না। আমি থেকে যাবো, তোমার ভুলগুলোকে ঠিক করতে।”
রাফি হেসেছিল।
— “ভুল হলে হাত ধরে ঠিক করে নিও, যাবার কথা বলো না আর কখনো।”
বৃষ্টি পড়ছিল বাইরে, কিন্তু এবার ছাতা ছিল তাদের দুজনের মাথার ওপরে— ঠিকভাবে ধরা, ঠিকভাবে ভাগ করে নেওয়া।
মন রাগে অনুরাগে
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
19
Views
1
Likes
0
Comments
0.0
Rating