বর্ষার রাত। জানালার কাঁচ ঘেঁষে টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছে। শহরের বুকে যেন এক আবছা সুর ছড়িয়ে দিচ্ছে এই শব্দ। ঠিক যেন কোনো দূরের বাঁশির মতো, যেটা খুব আপন, আবার ঠিকঠাক চেনাও নয়। রুদ্রর বুকের ভিতরেও আজ তেমনই সুর বাজছে। বাইরে বৃষ্টি, আর তার ভেতরে ঝরছে অন্য একরকম সোহাগ জল।
তার হাতের ফোনে এখনো সেই পুরোনো নাম্বারটাই ঘুরে ঘুরে আসে। অথচ সে জানে, নীলা ফোন তুলবে না। অনেক বছর হয়ে গেছে, অনেকটা সময়, অনেকগুলো ঋতু পেরিয়ে গেছে। তবুও এই একেকটা রাতে তার মনে হয়, যদি একবার শুধু "হ্যালো" বলত, তাহলেই বুঝি বুকের এই চাপা কষ্টটা একটু কমে যেত।
নীলা, যে ছিল রুদ্রর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী। প্রথম দিন ক্লাসে ঢুকে যে মেয়েটা সাদা সালোয়ার কামিজে বসে ছিল জানালার ধারে, তাকে দেখে রুদ্রর মনে হয়েছিল—এটা যেন কোনো কবিতার চরিত্র। এমন নরম চোখ, এমন কোমল হাসি… সে কেমন চুপচাপ বসে ছিল, অথচ চোখ যেন কথা বলত।
ক্লাস শেষে রুদ্র ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে বলেছিল,
— "তুমি কি নীলা?"
নীলা একটু হাসল, বলল,
— "তুমি কি রুদ্র?"
দুজনেই অবাক! এতটা সরল শুরু, অথচ সেই শুরুটাই হয়ে গেল এক অনন্ত প্রেমের বীজ।
প্রথম দিকে বন্ধুত্ব ছিল। খুব গুছিয়ে বলা যায় না ঠিক কোনদিন থেকে প্রেমের অনুভব জমে উঠল, কিন্তু যখন বুঝেছিল—তখন তা তীব্র, গভীর আর ছুঁয়ে যাওয়া। তারা বৃষ্টি ভালোবাসত। তারা বই পড়ত দুজনে বসে—একই কবিতার পাতা ধরে। নীলা মাঝে মাঝে বলত,
— “রুদ্র, আমাদের গল্পটা যেন কোনোদিন না থেমে যায়।”
রুদ্র হাসত, বলত,
— “আমাদের গল্পে থেমে যাওয়া নেই, আছে শুধু প্রবাহ। একধারা সোহাগ জল। জানো না?”
নীলা সেই নামটাতেই মুগ্ধ হয়ে যেত—"সোহাগ জল"। তারা নিজেদের প্রেমকে বলত সোহাগ জল। যেন একটানা বয়ে চলা শান্ত নদী, কোথাও কোনো হাহাকার নেই, শুধু স্নিগ্ধতা।
তবে জীবনের নদীতে হঠাৎ হঠাৎ খরা এসে যায়, তাই না?
বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষে হঠাৎ করেই নীলার পরিবার থেকে জানিয়ে দেয়, তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। পাত্র দেশের বাইরে থাকে, সচ্ছল, পছন্দ পরিবারের। নীলা কাঁদে, ছুটে আসে রুদ্রর কাছে।
— "রুদ্র, আমি কী করব?"
রুদ্র নিশ্চুপ। তার ভিতরে ঝড়, কিন্তু বাইরে সে নীরব।
— "চলো পালিয়ে যাই রুদ্র।"
— "না, নীলা। পালিয়ে গিয়ে ভালোবাসা প্রমাণ হয় না। আমি আসব তোমার বাড়ি। কথা বলব তোমার বাবা-মায়ের সাথে।"
রুদ্র সত্যিই গিয়েছিল, কিন্তু কোনো কথাই শোনেনি কেউ। তার পর দিনই নীলাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকার বাইরে। ফোন বন্ধ। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।
সে রাতের বৃষ্টিটাও ছিল আজকের মতো। রুদ্র বৃষ্টির ভেতরে হাঁটছিল একা, ভাবছিল—এই যে এতটা ভালোবাসা, এতটা প্রতিজ্ঞা, এতটা বিশ্বাস, সব কি জল হয়ে গেল?
তারপর... দীর্ঘ ছয় বছর।
রুদ্র এখন একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক। বেস্টসেলার উপন্যাস লিখে ফেলা এক তরুণ সাহিত্যিক। তার বইয়ের পাতায় পাতায় লেখা থাকে এক মেয়ের গল্প, যে হারিয়ে যায়, কিন্তু ফেলে যায় তার ঘ্রাণ। সে ঘ্রাণে ভিজে থাকে রুদ্রর সব লেখা—সেই সোহাগ জল।
একদিন, এক সাহিত্যসভায় দেখা হয়ে যায় হঠাৎ।
নীলা।
একটা শাড়ি পরা নারী, চোখে একরাশ কষ্ট, ঠোঁটে একটুখানি অভিমান, আর হাতে রুদ্রর লেখা বইটা—"সোহাগ জল"।
রুদ্র তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। যেন বিশ্বাস হচ্ছে না।
নীলা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বলল,
— "ভালো আছো রুদ্র?"
— "ভালো থাকতে চেয়েছি। পারিনি। তুমি?"
— "ভালো থাকতে হয়। সন্তান আছে। সংসার আছে। কিন্তু..."
কথা থেমে যায়।
রুদ্র জানত না কী বলবে। এত বছর পর একটা মলিন অথচ আত্মিক মুখোমুখি।
নীলা হঠাৎ বলল,
— "তোমার লেখা এই বইটা আমি অনেকদিন আগে পড়েছিলাম। বুঝেছিলাম, তুমি কোনোদিন আমাকে ছাড়োনি। আমি আমিও তো ছাড়িনি, রুদ্র। আমি তো তোমারই লেখা খুঁজেছি ভিড়ের মধ্যে।"
রুদ্র বলল,
— "তবে ফিরে এলে?"
— "ফিরিনি। এসেছি শুধু দেখে যেতে, তুমি এখনো সেই আগের মতো আছ কিনা।"
— "আমি এখনো সোহাগ জলেই বাঁচি, নীলা। শুধু সেই জল এখন সিক্ত করে না, শুধু জ্বালিয়ে যায়।"
নীলা চোখ সরিয়ে নেয়। ওর চোখে জল, কিন্তু সেটা কোন অনুভবের—তা ঠিক বোঝা যায় না।
রুদ্র জিজ্ঞেস করল,
— "তুমি সুখী তো?"
— "সুখী হইনি, রুদ্র। কিন্তু তোমাকে হারানোর সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল, এটাও বলতে পারিনি। কারণ, কারো স্ত্রী হয়ে কোনোদিনও প্রেমিকার সত্য বলা যায় না।"
ও চলে যায় ধীরে ধীরে। বৃষ্টির শব্দে হারিয়ে যায় পায়ের শব্দ।
রুদ্র বসে থাকে একা। তার বুকের মধ্যে আবার ঝরে পড়ে একফোঁটা সোহাগ জল। কিন্তু এবার তা বাইরের নয়, একেবারে মনের ভেতরের। ভালোবাসা, প্রতীক্ষা, অভিমান—সব কিছুর নাম একটাই: সোহাগ জল।
সে বইয়ের পাতার শেষ বাক্যটা লেখে সেদিন রাতেই:
"সব প্রেম পূর্ণতা চায় না, কিছু প্রেম শুধু থেকে যায় সোহাগ জলের মতো। ছুঁয়ে যায়, কিন্তু মুছে দেয় না।"
সোহাগ জল
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
30
Views
3
Likes
0
Comments
0.0
Rating