অধিকার

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
সন্ধ্যাবেলার আলোটুকু জানালার ফাঁক দিয়ে ধীরেধীরে ঘরে ঢুকছিল। বুকের মাঝখানে একরাশ চাপা ব্যথা নিয়ে চুপচাপ বসে ছিল রুহান। ঘরটা নিস্তব্ধ, চারদিকে যেন একটা ভারী স্তব্ধতা জমে উঠেছে। বাইরে রিকশার ঘণ্টা, ডাকে ওঠা পাখি কিংবা রাস্তায় চলা মানুষের পদচিহ্ন—কিছুই যেন ওর কানে পৌঁছাচ্ছিল না।

এই শহরটা ওদের ভালোবাসার সাক্ষী। ছয় বছর আগেও এই শহরের এক ঘন বর্ষার দিনে দেখা হয়েছিল ওদের—রুহান আর তাসনিমের।

তাসনিম, চুপচাপ এক মেয়ের নাম। চুলগুলো ঘাড় অব্দি, পরিপাটি করে বাঁধা। চোখে ঘন ফ্রেমের চশমা, কিন্তু চোখদুটো ছিল যেন গোধূলির মত—নরম, মায়াভরা। রুহান তখন সদ্য ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। ইংরেজি সাহিত্য বিভাগে ক্লাস করতে করতে তাসনিমকে প্রথম দেখেই এক অদ্ভুত টান অনুভব করেছিল।

তাসনিম ছিল ঠিক উল্টো ধাঁচের মানুষ—শান্ত, হিসেবি, পরিবারের প্রতি অসম্ভব দায়িত্ববান। বাবা অসুস্থ, ছোট দুই ভাইবোন পড়াশোনার তাগিদে ওর ওপর নির্ভরশীল। আর তাই জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্তে তাকে পরিমিত থাকতে হতো।

রুহান প্রেমের কথা তুলেছিল তৃতীয় সেমিস্টারে।
— "তাসনিম, তুমি জানো, আমি তোমায় ভালোবাসি। অনেক দিন ধরেই বলতে চাচ্ছিলাম। তুমি যদি না বলো, আমি হাঁটতেই পারব না সামনে।"

তাসনিম একটু হেসেছিল। সেই হাসি যেন ওর বুকের ভেতরে মেঘ ডেকে উঠেছিল।
— "ভালোবাসা মানেই তো চাওয়া নয়, রুহান। তবুও... আমিও তোমায় আলাদা করে দেখি।"

তাদের প্রেমের শুরুটা ছিল সাদামাটা। কোনো বাহুল্য ছিল না, ছিল না ফুল, চকলেট, কিংবা দিনে তিনবার ‘আই লাভ ইউ’ বলা। তারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পড়াশোনা করেছে, লাইব্রেরির ছায়ায় বসে কবিতা পড়েছে, একসাথে রিকশায় চড়ে ফার্স্ট বেঞ্চে গিয়ে ক্লাস ধরেছে।

তবে জীবনের মোড় তো কখনোই সোজা থাকে না। ভালোবাসা কি শুধু একে অপরকে চাওয়াই? নাকি তার চেয়েও বড় কিছু—সমান অধিকার?

চতুর্থ বর্ষে উঠতেই রুহানের পরিবার থেকে চাপ আসতে শুরু করল। চাকরি, বিয়ে, সংসার—সব যেন একেকটা অধ্যায় হয়ে গলার কাছে ধরা দিল। রুহান চাকরির জন্য প্রিপারেশন নিতে শুরু করল, আর তাসনিম আরও বেশি করে পড়াশোনায় মন দিল।

তাসনিম বলেছিল একদিন,
— "তুমি কি জানো, আমি বিসিএস দিতে চাই? নারী হিসেবে অনেক কিছুই প্রমাণ করতে চাই আমার মা-বাবার জন্য।"

রুহান কপাল কুঁচকে বলেছিল,
— "আমাদের বিয়ে হলে এত কিছুর কী দরকার তাসনিম? আমি তো আছি। চাকরি করো না, সংসার সামলাও।"

তাসনিম অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলেছিল,
— "আমার ভালোবাসার জন্য আমাকে নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দিতে হবে, এইটা কেমন কথা রুহান?"

সেদিন প্রথমবার রুহান বুঝেছিল, তাসনিমকে ভালোবাসা মানে শুধু তাকে কাছে চাওয়া নয়, বরং তার স্বপ্নে সঙ্গী হওয়াও ভালোবাসার অধিকার।

কিন্তু রুহান তখন সেই গভীরতা বুঝতে পারেনি। তার মনজুড়ে ছিল একটাই চিন্তা—তাসনিম যেন তার হয়ে যায়, পুরোপুরি।

তারপর একদিন ঝগড়া হলো, ছোট্ট এক ব্যাপার নিয়ে। তাসনিম একটা সেমিনারে যাবে, ওর স্বপ্নের একজন লেখক আসছেন। কিন্তু রুহান বলল, "তোমার এসব লেখালেখি, সেমিনার—এসব বাদ দাও। একদিন না একদিন সংসারেই আটকে পড়বে, তাহলে এখন এত তাড়াহুড়ো কেন?"

তাসনিম চুপ করে তাকিয়েছিল অনেকক্ষণ। তারপর বলেছিল,
— "তুমি যদি আমায় ভালোবাসো, তবে আমাকে আমার মতো থাকতে দাও। আমার নিজের মতো করে গড়ে উঠতে দাও। ভালোবাসা মানে অধিকার খাটানো না, অধিকার দেওয়া।"

তারপর ওরা আলাদা হয়ে যায়। কারও মধ্যে ব্লক, আনফ্রেন্ড, দোষারোপ কিছুই ছিল না। ছিল শুধু একটা বোবা নীরবতা।

পাঁচটা বছর কেটে গেছে।

এই পাঁচ বছরে রুহান একটা কর্পোরেট অফিসে চাকরি পেয়েছে। আর তাসনিম? সে এখন একজন নামকরা শিক্ষিকা, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়, সাহিত্যে পিএইচডি করছে।

আজ হঠাৎ করেই ওরা দেখা করেছে—এক সাহিত্য অনুষ্ঠানে।

তাসনিম এখনো সেই আগের মতোই—তবে যেন আরও আত্মবিশ্বাসী, আরও গাঢ় আলোয় জ্বলা। ওর হাতে ছিল নিজের লেখা বই, যেখানে প্রথম পাতায় ছিল একটি উক্তি:

“ভালোবাসা মানে দাবি নয়। ভালোবাসা মানে—দুইজন মানুষ একে অপরকে নিজের মতো করে বাঁচতে দিতে শেখে। অধিকার মানেই একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং সম্মান।”

রুহান বইটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল। তাসনিম পাশেই দাঁড়িয়েছিল। তাদের মাঝে তখন আর কোনো অভিযোগ ছিল না, ছিল না ‘তুমি কেন পাল্টে গেলে’ জাতীয় কোনো কষ্ট। বরং ছিল বোঝাপড়া, পরিণতি।

রুহান আস্তে করে বলল,
— "আমি বুঝতে শিখেছি, তাসনিম। অধিকার মানে কারো ডানা কেটে রাখা নয়। আমি ভুল করেছিলাম।"

তাসনিম হেসে বলল,
— "আমরা দুজনেই শিখেছি, রুহান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভালোবাসাও শিখতে হয়।"

বৃষ্টি পড়ছিল বাইরে। হঠাৎ যেন সেই ছয় বছর আগের দিনের প্রতিধ্বনি।

রুহান বলল,
— "তুমি এখন কী চাও?"

তাসনিম বলল,
— "তুমি?"

রুহান চোখ মেলে তাকাল, তারপর বলল,
— "তুমি যেভাবে চাও, সেইভাবে পাশে থাকতে চাই। তোমার সমান হয়ে।"

তাসনিম একটা হালকা হাসি দিল। তারপর ছাতা খুলে এগিয়ে গেলো বৃষ্টির মধ্যে। রুহানও এগিয়ে গেল। তাদের পায়ের ছাপ মিলেমিশে গেলো জলে।

আর হয়তো এই গল্পের শেষ নেই—হয়তো নেই সাদা জামা আর সিঁদুরের বিয়ে। কিন্তু একটা গল্প আছে, যেখানে ভালোবাসা মানে অধিকার দাবি নয়, বরং সম্মানের চুক্তি।
যেখানে ভালোবাসা মানে,
"আমি যেমন আছি, তেমন করেই আমাকে ভালোবাসো। আর আমি যেমন তোমাকে দেখি, সেই আলোয় জ্বলতে দিই তোমাকে।"
27 Views
4 Likes
0 Comments
0.0 Rating
Rate this: