বৃষ্টি ছিল সেদিন। কলেজের শেষ দিন। ছাতা ভাঙা ছিল শ্রাবণীর, আর শিরাজের হাতে ছিল একটা পুরোনো কালো ছাতা, যেটা সে তার বাবার কাছে পেয়েছিল। দুজন দাঁড়িয়ে ছিল কলেজ গেটের সামনে। শ্রাবণী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল, শিরাজ কিছু বলতে চাইছিল, কিন্তু শব্দেরা তখনও পথ খুঁজে পায়নি।
চার বছর ধরে একসাথে ক্লাস করেছে ওরা, শত শত ক্লাস নোট শেয়ার, স্টাডি গ্রুপ, গ্রুপ প্রেজেন্টেশন, ক্যান্টিনের আড্ডা, ঈদের চিঠি, পহেলা বৈশাখের হুটহাট দেখা—সব মিলিয়ে যেন বন্ধুত্বের শিরোনামে গোপনভাবে জমে উঠেছিল অন্য এক শব্দ… "ভালোবাসা"।
কিন্তু কেউই বলেনি কখনো।
শেষ দিনের বৃষ্টি যেন সেই অপ্রকাশ্য অনুভবকে আরও ঝাপসা করে দিল।
শিরাজ ছাতা ধরতে ধরতে বলল,
— “শ্রাবণী, এখন তো কলেজ শেষ… এখন থেকে হয়তো এমন করে দেখা হবে না…”
— “হবে না, শিরাজ… আসলে, আমাদের সম্পর্কটা কোথাও নাম পায়নি, তাই তার কোনো ঠিকানাও নেই।”
শিরাজ চমকে তাকায়।
শ্রাবণী আবার বলে,
— “আমি কখনো জোর করিনি, কিন্তু আজ না বললেই নয়, শিরাজ… আই লাভ ইউ। অনেকদিন ধরে বলিনি, ভাবছিলাম—তুমি হয়তো বুঝবে। কিন্তু তুমি তো...”
শ্রাবণী কিছু বলতে পারল না। চোখ ছলছল করে উঠল।
শিরাজ গলার স্বর নামিয়ে বলল,
— “তুমি জানো, আমি বলিনি মানে এই নয় যে আমি অনুভব করিনি। আমি ভয় পেতাম। ভেবেছিলাম যদি আমি বলি, আর তুমি সরে যাও? আমি তোমাকে হারাতে চাইনি, শ্রাবণী।”
— “কিন্তু এখন তো হারাচ্ছোই। না বলা ভালোবাসার শাস্তি তো হারিয়ে ফেলার মধ্যেই সবচেয়ে বেশি।”
— “তুমি কি এখনো বলো, আই লাভ ইউ?”
— “হ্যাঁ।”
— “তাহলে আমিও বলি… আই লাভ ইউ, শ্রাবণী। চিরকাল ভালোবাসবো।”
কিন্তু হঠাৎ সেই মুহূর্তে শ্রাবণীর ফোনে একটা কল আসে। সে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, চোখ ফেলে দেখে শিরাজের মুখ, তারপর ধীরে ধীরে বলে,
— “আমার বাবা অসুস্থ। আমাদের দেশের বাইরে যেতে হবে, আজ রাতেই ফ্লাইট।”
শিরাজ যেন কাঁপে, কিন্তু বলে,
— “তুমি যাবে, ফিরে এসো। আমি অপেক্ষা করব।”
— “শিরাজ, অপেক্ষা করো না। আমি জানি না কবে ফিরব, ফিরতেও পারব কি না। অপেক্ষার চেয়ে কষ্টকর আর কিছু নেই।”
সে চলে যায়। আর শিরাজ সেই বৃষ্টির নিচে দাঁড়িয়ে থাকে একা, ছাতাটা তখনও মেলে আছে, অথচ তার চোখে নামছে এক অন্যরকম বৃষ্টি।
---
পাঁচ বছর পর।
শিরাজ এখন একটি বিজ্ঞাপন সংস্থার আর্ট ডিরেক্টর। শহরের আলো-ঝলমলে ব্যস্ত জীবনে সে নিজের ভালোবাসার ছায়া মিশিয়ে রেখেছে প্রতিটি ডিজাইনে, প্রতিটি ক্যাম্পেইনে। সহকর্মীরা জানে, ওর কাজ নিখুঁত, ওর চোখে গল্প আছে। কিন্তু কেউ জানে না, সে এখনো রোজ রাতে এক চিঠি লেখে—শ্রাবণীর নামে, যেটা কোনোদিন পোস্ট করে না।
এক সন্ধ্যায়, একটি কর্পোরেট মিটিংয়ের জন্য অফিসে আসে একটি নতুন আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের টিম। শিরাজ কনফারেন্স রুমে ঢুকে দেখল—টেবিলের এক মাথায় বসে আছে সেই মুখ, সেই চুলের ঢেউ, সেই চোখ—শ্রাবণী।
কিছুক্ষণ কেউ কিছু বলে না।
শেষে শ্রাবণীই বলে,
— “হ্যালো শিরাজ।”
— “তুমি... তুমি এখানে?”
— “হ্যাঁ, বাবা মারা যাওয়ার পর ফিরে এসেছি। নতুন জীবন শুরু করছি।”
— “তুমি জানো, আমি প্রতিদিন ভেবেছি, তুমি কোথায়, কেমন আছো…”
— “আর আমি প্রতিদিন ভেবেছি, তুমি এখন অন্য কাউকে ভালোবাসো কিনা।”
শিরাজ ধীরে ধীরে হাসে।
— “তুমি চলে যাওয়ার পরে কাউকে ভালোবাসা আসেনি, শ্রাবণী। ভালোবাসা একবারই হয়। তার নাম যদি কেউ নিয়ে যায়, সেটা আর বদলায় না।”
শ্রাবণী একটু থেমে বলে,
— “আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাইনি। কিন্তু ভেতরে কোথাও জানতাম, হয়তো তুমি এখনো ভালোবাসো।”
— “তাহলে তুমি এসেছো বুঝে নিতে, আমি এখনো ‘আই লাভ ইউ’ বলি কিনা?”
— “হ্যাঁ। বলো, এখনো বলো?”
— “আই লাভ ইউ, শ্রাবণী। আমি কোনোদিন থামিনি।”
— “তাহলে আমাকে আরেকবার ভালোবাসো, শিরাজ।”
— “আমি তো আজও থামিনি… তুমি শুধু হাতটা ধরো। আর কোনোদিন ছাড়বে না প্রতিশ্রুতি দাও।”
শ্রাবণী হাত বাড়িয়ে দেয়।
ওরা হাঁটতে শুরু করে একসাথে—এইবার আর কোনো ঝড় নেই, নেই বিদায়ের ট্রেন, নেই দূরের ফ্লাইট। আছে শুধু একটাই বাক্য, যা ওদের হৃদয়ে লেখা চিরকাল—
“আই লাভ ইউ।”
---
দুই বছর পর।
একটা ছোট্ট বাড়ি। জানালার পাশে ছোট টেবিল, টেবিলের ওপরে একটা চিঠির খাম। শিরাজ চিঠিটা হাতে নিয়ে শ্রাবণীকে দেয়।
— “এই চিঠিগুলো আমি লিখেছিলাম, যখন তুমি ছিলে না। প্রতিদিন লিখতাম, আজও লিখি। কোনোদিন পোস্ট করিনি। এখন তুমি এগুলো পড়ো, তারপর বলো—আমি কি ভালোবাসতে পেরেছিলাম?”
শ্রাবণী একটার পর একটা খাম খোলে, পড়ে, কাঁদে, হাসে… আর একসময় শিরাজকে জড়িয়ে ধরে বলে,
— “তুমি যে শুধু ভালোবেসেছো না, তুমি আমাকে একটা কবিতা বানিয়ে ফেলেছো… একটা চলমান প্রেমের উপন্যাস, যার নামই হতে পারতো—আই লাভ ইউ।”
আই লাভ ইউ
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
28
Views
4
Likes
0
Comments
0.0
Rating