ঢাকা শহরটা তখন ব্যস্ত। মোহাম্মদপুরের রাস্তা জ্যামে আটকে, নিউমার্কেটের সামনে চটপটি-ফুচকা গরম, আর আকাশে বিকেলের সোনালি রোদ। সেই সোনালি রোদের মাঝে একটা ছায়া এসে দাঁড়ায়—তাকে দেখে মনে হয়, সময় থমকে গেছে। নাম তার আয়ান হক।
আয়ান খুব বেশি কিছু চায় না জীবনে। শান্ত একটা ক্যাফে, গিটারের টুংটাং, আর নিজের লেখা গানের লাইনগুলো নিয়ে ঘোরাঘুরি করা মানুষ। ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় তার মনে হয়, সেও একটা হারিয়ে যাওয়া গানের মতো—যার সুর কেউ বুঝে না।
কিন্তু হঠাৎ একদিন সেই সুরে আসে নতুন ছন্দ।
গানবাজ ক্যাফেতে তখন অডিশন চলছিল। আয়ান গিটার হাতে গান গাইছিল—
"যদি তোকে চাই, যদি তোকে ছুঁই,
চেনা পৃথিবীটা এক নতুন দৃশ্য হয়..."
কোনো এক কোণায় বসে থাকা মেয়ে হঠাৎ হাততালি দিয়ে উঠেছিল। মাথায় ওড়না ছিল, চোখে কাজলের রেখা, আর ঠোঁটে একরাশ দৃঢ়তা।
“এই গানটা তোমার নিজের লেখা?”
আয়ান মাথা নিচু করে বলে, “হ্যাঁ।”
“তোমাকে গানটা আবার গাইতে হবে, আমার ক্যাম্পেইনের জন্য।”
“ক্যাম্পেইন?”
“হ্যাঁ, আমি মায়া। নারী অধিকার নিয়ে কাজ করি, গানটা আমাদের থিম সং হতে পারে।”
সেই শুরু।
একটি মেয়ের চোরা দৃঢ়তা আর একটি ছেলের নিঃশব্দ প্রতিভার মিলনে গড়ে উঠলো এক অন্যরকম বন্ধন। আয়ান গান গায়, মায়া থেমে শোনে। মায়া বক্তৃতা দেয়, আয়ান ক্যামেরা চালায়। আর এই পুরো জার্নি চলাকালীন তারা কেউ কাউকে ভালোবাসি বলেনি। কিন্তু হাওয়ার মতো সম্পর্কটা থেকে গেছে, সব জায়গায়—অথচ কোথাও নয়।
একদিন মায়া বলে, “আয়ান, তুমি কখনো এমন কাউকে ভালোবেসেছো যে তোমার মতো না?”
আয়ান উত্তর দেয়, “ভালোবাসা মানেই তো নিজের বিপরীতকে বুকে টেনে নেওয়া।”
“তবে?”
“তবে আমি বলি না, কারণ আমি চাই তুমি আগে বুঝো তুমি আসলে কী চাও।”
মায়া চুপ করে যায়।
দিন যায়। ক্যাম্পেইন সফল হয়। ইউএনডিপি থেকে ফান্ড আসে। মায়ার কাজ দেশের বাইরে পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। তার নাম পত্রিকায়, পোর্টালে, মানুষের মুখে মুখে।
আর আয়ান?
সে এখনও গান লেখে। তবে তার প্রতিটি গানের শেষে একটিই বাক্য লেখা থাকে—
"যদি তোকে চাই..."
মায়া এতদিনে বুঝে গেছে, আয়ান কখনোই নিজের ভালোবাসা চাপিয়ে দেবে না। সে দাঁড়িয়ে থাকবে, যেন অপেক্ষার প্রতীক। কিন্তু তবু সে কিছু বলেও না, যায়ও না। তাদের মাঝখানে অদৃশ্য একটা সীমানা গড়ে ওঠে, যেটা পার হতে গেলে দুজনকেই চাই।
একদিন আয়ান তার মিউজিক ভিডিও শ্যুট করছে বনানীর এক ছাদে। সূর্য ডুবে যাচ্ছে, ক্যামেরা রোল করছে।
তখন হঠাৎ পেছন থেকে মায়া এসে বলে, “তুমি আজও গান লিখো আমার জন্য?”
আয়ান বলে না কিছু। শুধু চোখে চোখ রাখে।
“তুমি জানো না, আমি কতবার যেতে চেয়েছি—চলে যেতে, দূরে কোথাও। কিন্তু কোথাও যাই না, কারণ এই শহরের কোন অলিগলি আমার মনে পড়িয়ে দেয়, তোমার চুপ থাকা ভালোবাসা।”
আয়ান একটু হাসে, বলে, “তবে এবার পার হবে?”
মায়া হেঁটে আসে সামনে, গিটারের তারে আঙুল বুলিয়ে বলে—
“যদি তোকে চাই, তাহলে আমি নিজেকে হারাতে রাজি।”
সেদিন সূর্যটা একটু ধীরে অস্ত যায়। যেন আকাশও থমকে দাঁড়ায়, দুজন অপেক্ষার গল্প একসাথে লেখা হয়।
সেই থেকে গানটা আর সবার হয় না—
"যদি তোকে চাই..."
এটা শুধু আয়ান আর মায়ার নিজেদের গল্প।
যদি তোকে চাই
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
22
Views
3
Likes
0
Comments
0.0
Rating