ভালোবাসা.কম

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
রাজশাহী শহরটা নিজেই একটা কবিতা। পদ্মা নদীর ধারে দাঁড়িয়ে থাকা চুপচাপ সৌন্দর্য, আমের ঘ্রাণে ভরা গ্রীষ্ম, আর বিকেলের নরম আলোয় লালচে রঙের শহরটা যেন নিজের মধ্যেই বুনে চলে গল্পের পাতা। আর সেই পাতার একটা কোণে লেখা ছিল রাহাত আর সাদিয়া নামের দুটো চরিত্র।

রাহাত ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইটি বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র। একরোখা, গম্ভীর, কিন্তু ভেতরে জমে থাকা আবেগ এতটাই নিঃশব্দ ছিল যে কেউ চাইলে তাকেও পাঠ্যপুস্তকের চেয়ে বেশি বোঝা কঠিন হয়ে যেত। ছোটবেলা থেকেই সে একটাই স্বপ্ন দেখে—একটা এমন প্ল্যাটফর্ম বানাবে যেখানে মানুষ শুধু যোগাযোগই করবে না, মনের কথাও ভাগ করে নিতে পারবে। কিন্তু এ ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম—সবই যেন কৃত্রিম। তাই তার স্বপ্নের নাম সে রেখেছিল ভালোবাসা.কম।

সামান্য একটা ওয়েব পোর্টাল, যেখানে মানুষ নিজেদের গল্প লিখে জমা দেবে, কেউ চাইলে সেই গল্প পড়বে, মন্তব্য করবে, চাইলে চিঠির মত উত্তর দেবে। ভিডিও নেই, ছবি নেই, রিল নেই—শুধু লেখার ভিতর দিয়ে অনুভব।

অন্যদিকে সাদিয়া—একজন বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী। রঙিন শাড়ি পরে পদ্মার ধারে হেঁটে বেড়ানো, দুপুরে রবীন্দ্রসংগীত শোনা আর প্রতিদিন ডায়েরিতে ছোট ছোট গল্প লেখা ছিল তার নেশা। সে বিশ্বাস করত, ভালোবাসা মানে শুধু কাছাকাছি থাকা নয়—ভালোবাসা মানে কাউকে শব্দের ভিতরে খুঁজে পাওয়া। কিন্তু বাস্তবে এমন কাউকে সে খুঁজে পায়নি।

একদিন এক বান্ধবীর মুখে শোনে—
"একটা অদ্ভুত সাইট আছে রে, নাম ভালোবাসা.কম। সেখানে শুধু লেখা যায়, কেউ কাউকে ফলো করে না, কিন্তু মানুষজন খুব মন খুলে কথা লেখে।"

সাদিয়া প্রথম দিনেই একটা গল্প পোস্ট করে। নাম—“অপেক্ষা”।
একটা মেয়ের একলা দুপুর আর অপেক্ষার মধ্যে ডুবে থাকা একটা পুরনো প্রেমের কাহিনি। সে ভাবেনি কেউ পড়বে। কিন্তু গল্পটা পাবলিশ করার ৪ ঘণ্টার মধ্যেই একটা মন্তব্য আসে—

"তোমার অপেক্ষার শব্দগুলো যেন আমার জীবনের পাতাগুলো... আমি কি আরও পড়তে পারি?"

এই ছোট্ট লাইনটার নিচে সাইন ছিল—Rahaat.

সেদিন থেকেই শুরু।

সাদিয়া প্রতিদিন একটা করে গল্প পোস্ট করে। আর রাহাত প্রতিদিন মন্তব্য করে। কখনও গল্পের শেষ লাইন নিয়ে আলোচনা, কখনও প্রশ্ন—"এই চরিত্রটা আসলে হারিয়ে গেল কেন?", কখনওবা নিঃশব্দ প্রশংসা। আর সাদিয়া তাতে উত্তর দেয়, গল্পের মাঝেই।

মাঝে মাঝে দুজনের মন্তব্য এত দীর্ঘ হয়ে যেত যে সেটা একটা আলাদা গল্প হয়ে দাঁড়াত।

একদিন সাদিয়া সাহস করে সাইটের “আননোন ইনবক্স” অপশন ব্যবহার করে লিখে বসে,
“তুমি যদি প্রতিদিন আমার গল্পের নিচে মন্তব্য না করো, আমার দিনটা অসম্পূর্ণ লাগে।”

রাহাত একঘণ্টা পর উত্তর দেয়—
“তোমার শব্দগুলো ছাড়া আমার দিনটাই শুরু হয় না। কিন্তু তুমি কি জানো, এই ভালোবাসা.কম এর পিছনে যে ছেলেটা আছে, সে নিজেও তোমার গল্প পড়ে গভীর রাতে ঘুমাতে যায়।”

সাদিয়া থমকে যায়। এতদিন ধরে যার মন্তব্যে সে মুগ্ধ, সে-ই কি সাইটের ফাউন্ডার?

কিন্তু এরপর দুজনের মধ্যে আসল গল্পটা শুরু হয়।
তারা কেউ কারো নাম চায় না, ছবি চায় না, ফোন নাম্বার তো দূরের কথা—তারা চায়, শুধু প্রতিদিন শব্দের ভিতর ডুবে যেতে।

একদিন সাদিয়া লেখে—
“ভালোবাসা কি তাহলে এমনই? যেখানে স্পর্শ নেই, ছবি নেই, কণ্ঠ নেই... তবু মন বলছে, ‘এই তো, সে-ই!’?”

রাহাত লেখে—
“ভালোবাসা আসলে একটা ঠিকানা নয়, একটা অনুভব। আমি প্রতিদিন সেখানে ফিরে আসি, শুধু তোমার গল্প পড়তে।”

এরপর দিন যায়।
সাইটটা ধীরে ধীরে রাজশাহীর গণ্ডি ছাড়িয়ে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। ভালোবাসা.কম-এর জনপ্রিয় লেখক তালিকায় উঠে আসে SadWords (সাদিয়ার ছদ্মনাম) আর ByteBoy (রাহাত)। কিন্তু এখনো তারা কেউ কাউকে দেখে না, জানে না।

একদিন হঠাৎ করে সাদিয়া আর কিছু পোস্ট করে না। একদিন, দুইদিন, সাতদিন—পুরো সাইট যেন নিঃশব্দ হয়ে যায়।

রাহাত সেই রাতে একটা লাইন লেখে—

“SadWords, তুমি কি হারিয়ে গেলে?”

এর পরদিন একটা ছোট্ট গল্প আসে। শিরোনাম—“শেষ চিঠি”।

সেখানে সাদিয়া লিখে—
"আমি জানি না তুমি কে, কোথা থেকে, কী করো। শুধু জানি, তুমি আমার অনুভবের একমাত্র সঙ্গী ছিলে। আমি চলে যাচ্ছি। শহর বদলাচ্ছি, জীবন বদলাচ্ছে। কিন্তু যদি কোনোদিন রাজশাহীর পদ্মার ধারে হেঁটে যাও, একটা পুরনো কাঠের বেঞ্চ পাবে। সেখানে আমি একটা চিঠি রেখে যাবো... শুধু তোমার জন্য।”

রাহাত তৎক্ষণাৎ দৌড়ে যায় পদ্মা পাড়ে। সন্ধ্যা নেমে এসেছে।
আর সত্যিই, সেই বেঞ্চের নিচে এক মোটা খামে লেখা—“ByteBoy”।

চিঠিটা খুলে পড়ে—
"আমার নাম সাদিয়া। আমি কখনো তোমার ছবি চাইনি, কণ্ঠও না। শুধু চাইনি হারিয়ে যাক এই গল্প। তুমি যদি আজও আমাকে চাই—তাহলে আমাকে খুঁজে নিও, না ভার্চুয়াল জগতে, না ইমেইলে—একদম সত্যি জীবনে। আমি আজ রাত ৮টা ৪৫-এ সেই বেঞ্চেই বসে থাকবো। যদি আসো—জানবো, ভালোবাসা.কম আসলে শুধু একটা ওয়েবসাইট নয়, একটা বাস্তব অনুভব।”

ঘড়ি তখন ৮:৪২।

রাহাত দৌড়ায়।

আর ঠিক ৮:৪৫-এ, পদ্মার বাতাসের মাঝে সেই বেঞ্চে বসে ছিল এক মেয়ে, গাঢ় নীল শাড়ি, খোলা চুল, আর চোখে অপেক্ষার জল।

রাহাত গিয়ে বসে। কিছু বলে না।

সাদিয়া হেসে ফেলে, “তুমি দেরি করছো…”
রাহাত বলে, “ভালোবাসা.কম-এ আজ একটা নতুন গল্প পোস্ট হয়েছে।”
“কি নাম?”
“তোমাকে খুঁজে পেয়েছি।”

সেদিন রাজশাহীর পদ্মা পাড়ের বাতাসে একটা অদৃশ্য চুম্বন ভেসে বেড়াচ্ছিল। আর ভালোবাসা.কম-এ নতুন একটা গল্প আপলোড হয়—

“যদি অনুভবে থেকো, তবে বাস্তবের অপেক্ষা করো। কারণ সত্যি ভালোবাসা কখনো লগআউট করে না।”
26 Views
2 Likes
0 Comments
0.0 Rating
Rate this: