অলক্ষ্মী

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
বৃষ্টি পড়ছে আজও। পাথরের উপর থোকা থোকা জলের দাগ পড়ে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। আকাশ কালচে ধূসর, ঘরে বাতি জ্বালিয়েও যেন আলো হয় না। এই আলোআঁধারির ঘরটাতেই বসে আছে সে—অলক্ষ্মী।

নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তোমার চোখ কুঁচকে যাবে, তাই না? "অলক্ষ্মী"—এ নামে কেউ সন্তানকে ডাকে? দুর্ভাগ্যের প্রতীক, অভিশপ্ত এক উচ্চারণ, যেন যাকে ডাকা মানেই ঘরে অমঙ্গল ডাকা। কিন্তু এই নামটাই তার জন্মের পর মা মুখে এনে ফেলেছিলেন। কাকিমারা তখনই বলেছিল,
“এই মাইয়্যারে নিয়া বিপদ বইলব!”

বিপদ এসেছিল। দশদিনের মাথায় বাবার কারখানায় আগুন লেগে সব ছারখার। মা চুপচাপ হয়ে গেলেন, কিছুদিন পরেই হারিয়ে গেলেন নিঃশব্দে, একদিন সকালে রান্নাঘরে গিয়ে ঝুলতে দেখা গেল তাঁকে। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল কথা—এই মেয়েই অলক্ষ্মী! ঘরে অমঙ্গল এনেছে!

সেই শুরু তার—এক অদৃশ্য দায়ের জীবন।


---

গ্রামের ঘরের উঠোন থেকে ঢাকা শহরের টিনের চালার ঘর পর্যন্ত, কোথাও সে নিজের ঠাঁই খুঁজে পায়নি। মামার বাড়িতে আশ্রয় পেলেও, কথায় কথায় তাকে মনে করিয়ে দেয়া হতো—
“তোরে না রাখলে বংশের কলঙ্ক হতাম!”

পড়াশোনার শখ ছিল, বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে থাকতে ভালো লাগতো অলক্ষ্মীর। কবিতা ভালোবাসতো, শব্দ দিয়ে জগৎ বানাতে চাইতো। কিন্তু সংসারে সে ছিল একটা বাড়তি বোঝা। ক্লাস নাইনের পর আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। মামার বউ সাফ জানিয়ে দিলেন,
“পড়ে কী হইবি? লেখাপড়া তোর কপালে নাই!”

এরপর সেলাই শেখা, ছোটখাটো ঘরের কাজ, অন্যের বাচ্চা সামলানো—সব করেই বড় হতে হয়েছে। কিন্তু বয়স যতই বাড়তে থাকে, মানুষ যেন তার নামের অভিশাপকে আরও বেশি বিশ্বাস করতে শুরু করে।

“ওর সাথে হাত দিও না, মুখ খারাপ!”

“ও যেদিন কাজে আসে, দোকানের বেচাবিক্রি কমে যায়!”

“মেয়েটার মুখে হাসি নাই—নজর খারাপ হয় বুঝি!”

হ্যাঁ, হাসি ছিল না তার মুখে। কীভাবে থাকতো? যাকে জন্মের প্রথম দিন থেকেই দোষী বানানো হয়, সে হাসবে কোন সাহসে?


---

একদিন সন্ধ্যায়, যখন ঘরের সব কাজ শেষ করে ছাদে গিয়ে একটু বাতাস নিচ্ছিল সে, হঠাৎ পেছন থেকে কেউ ডাকল,
"আপা, একটু সাহায্য করবেন?"

একটা ছেলেমানুষ, মাঝবয়সী, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, হাতে কিছু ফাইল।
"এই ঠিকানাটা খুঁজছি। তেজকুন্নিপাড়ার কোথায় পড়বে?"

ঠিকানাটা চেনা লাগলো। সে বলল,
“আমার পাশের গলিতেই। চলেন, দেখিয়ে দিই।”

ছেলেটির নাম ছিল আহনাফ। সমাজবিজ্ঞানের গবেষক, গ্রামে-শহরে নানা রকম মানুষের জীবনের গল্প নিয়ে কাজ করেন। অলক্ষ্মীকে দেখে তার কৌতূহল জন্মালো। পরদিন এসে বলল,
“আপনার সাথে একটু কথা বলতে পারি?”

প্রথমে সে চমকে উঠেছিল, কারণ কোনো পুরুষ তাকে এইভাবে কখনো সম্মান দিয়ে কথা বলেনি। তবু সায় দিল, কারণ আহনাফের চোখে ছিল আগ্রহ, করুণা নয়।

সেইদিন থেকে গল্প শুরু। সে জানালো নিজের জীবন—কেমন করে তার নামটাই হয়ে উঠেছে সবচেয়ে বড় অভিশাপ। আহনাফ শুনে গেল—মন দিয়ে, চোখে জল এনে। মাঝে মাঝে বলত,
“তুমি জানো, অলক্ষ্মী নামে ইতিহাসে অনেক শক্তিশালী নারীর নাম ছিল। তোমার নাম দুর্ভাগ্য নয়, শক্তির প্রতীক হতে পারে।”

তবে কথাগুলো বিশ্বাস করা তার পক্ষে কঠিন ছিল। কারণ সে জানত, এই দুনিয়ায় নাম পাল্টালেও ভাগ্য পাল্টায় না।


---

দিন চলছিল। সে এখন ছোটখাটো সেলাইয়ের কাজ করে। নিজের একটা মেশিন কিনেছে কিস্তিতে। আহনাফ মাঝে মাঝে আসে, নতুন নতুন গল্প শোনে। একদিন হঠাৎ বলল,
“তুমি চাও তো, আমি তোমার গল্পটা লিখে দিতে পারি?”

সে অবাক।
“আমার জীবনের দাম আছে?”

“তোমার জীবনের চেয়ে বড় গল্প কমই আছে।”

অলক্ষ্মী সেদিন কোনো উত্তর দেয়নি। শুধু জানালার ধারে বসে ছিল অনেকক্ষণ। বাইরে বৃষ্টি পড়ছিল, মনে হচ্ছিল সেই প্রথম কোনো বৃষ্টি তার জন্য।


---

বছর খানেক কেটে গেছে।

এখন অলক্ষ্মী একা থাকে না। পাশের ফ্ল্যাটে একটা ছোট অফিস ভাড়া নিয়ে আহনাফ একটা প্রজেক্ট শুরু করেছে—“নামহীন গল্প”। সমাজের অবহেলিত, অপমানিত, অবজ্ঞাত নারীদের গল্প লিপিবদ্ধ করে। অলক্ষ্মী সেখানে কাজ করে, টাইপ করে, কিছু গল্প নিজেও লেখে। নিজের জীবন থেকে কিছু কিছু অংশ তুলে আনে—তবে নামটা রাখে না। শুধু ইঙ্গিত দেয়।

আস্তে আস্তে সে বুঝতে শিখছে—মানুষ নাম দিয়ে বিচার করে, কিন্তু একসময় কাজ দিয়ে সেই নামকেই বদলে দেয়া যায়।


---

তবু সমাজ তাকে বদলায়নি একটুও।

একদিন বাজার থেকে ফেরার পথে এক বুড়ি বলল,
“এই দেখো, অলক্ষ্মী আইছে। চোখ মাইলা রাহো!”

অলক্ষ্মী সেই কথায় কাঁপে না এখন। দাঁড়িয়ে পড়ে, চোখে চোখ রাখে বুড়ির।
“চোখ খুলেই থাকেন মা, অলক্ষ্মীকে দেখলে হয়তো আপনার অন্ধ বিশ্বাস একটু কমবে।”

বুড়ি কিছু বলতে পারেনি।


---

এখন অলক্ষ্মীর একটা পরিচয় আছে—"গল্পকার অলক্ষ্মী"। হ্যাঁ, নামটা সে বদলায়নি। বদলাতে চায়নি। কারণ সে জানে, জগতে অনেক লক্ষ্মী আছেন, কিন্তু অলক্ষ্মী একটাই—যে অপমানকে আশীর্বাদে বদলে দিতে পারে।

আহনাফ একদিন বলেছিল,
“তুমি যদি কখনো নিজের গল্প লেখো, নাম কী দেবে?”
সে বলেছিল,
“‘অলক্ষ্মী’—এই নামটাই তো আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়।”


---

গল্পের শেষে একদিন আকাশ পরিষ্কার হয়েছিল।

বৃষ্টির দিন শেষ। রোদ ঝলমলে একটা সকাল।

অলক্ষ্মী নতুন কাপড় পড়েছে। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, চোখে এক চিলতে কাজল। আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, সে সুন্দর। বাহ্যিক নয়, এক গভীর, সাহসী সৌন্দর্যে।

রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ছোট একটা মেয়ে দৌড়ে এসে বলল,
“আপু, আপনি অলক্ষ্মী আপু না? যিনি গল্প লেখেন?”

সে হাসল। মাথায় হাত রেখে বলল,
“হ্যাঁ মা, আমি অলক্ষ্মী। তুমি কী পড়তে ভালোবাসো?”

মেয়েটি চুপচাপ বলল,
“আমি বড় হয়ে আপনার মতো হতে চাই।”

সে আবার হাসল। এই প্রথম অলক্ষ্মী বুঝতে পারল—তার অভিশপ্ত নামটা কারো অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছে।


---

নাম বদলায় না, ভাগ্যও নয়—
কিন্তু মানুষের মন বদলায়, চোখের দৃষ্টি বদলায়।
অলক্ষ্মীর জীবনও সেভাবেই বদলে গেছে।

তাই তার গল্পের নাম এখন শুধু “অলক্ষ্মী” নয়,
এই নামটাই—একটা বিপ্লব।
21 Views
3 Likes
0 Comments
0.0 Rating
Rate this: