লক্ষ্মী

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
মাধবপুর গ্রামের মানুষজন সবাই জানত লক্ষ্মীকে। সে মন্দিরের পুরোহিত শ্রীশ্রীরামের একমাত্র কন্যা, যিনি লক্ষ্মী দেবীর পূজা পরিচালনা করতেন। লক্ষ্মী ছোটবেলা থেকেই ছিল শান্ত, নিবেদিত, আর মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল। তার চোখে ছিল বিশ্বাস আর ভালোবাসার দীপ, যা সে তার চারপাশের মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাইত। সে কখনো ধর্মের আনুষ্ঠানিকতায় আটকে থাকত না, বরং ধর্মকে জীবনের সব দিক থেকে উপলব্ধি করত—মন্দিরের প্রাচীরের বাইরে, গ্রামের মাঠ-ঘাট, মানুষের হৃদয়ে।

মাধবপুর ছিল নদীর তীরে একটি ছোট গ্রাম। চারদিকে ধানক্ষেত আর পুকুর-জলাভূমি। বর্ষাকালে বন্যা এলেই ক্ষতি হতো ফসলের। গ্রামের বেশিরভাগ লোক কৃষিকাজে নিয়োজিত হলেও তারা ছিল অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেকটা দুর্বল। বছর ঘুরে ঘুরে আবারো ফসল নষ্টের খবর আর দারিদ্র্যের মতো অসহনীয় বাস্তবতায় জর্জরিত হত মাধবপুরের মানুষ।

সেই বছর বর্ষা ছিল অনিয়মিত। বৃষ্টির অভাবে ফসল বেশিরভাগই নষ্ট হয়ে গেল। ধানক্ষেত শুকিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ধান কাটা শুরু হলো হতাশায়। গ্রামের মানুষদের মুখে হাসি মলিন হয়ে এল। অনেকেই ঋণের বোঝা নিয়ে চিন্তায় ভুগছিল। বড়লোক জমিদারদের কাছে ঋণের চাপ বাড়ছিল। মন্দিরের আর্থিক অবস্থা ও ভালো ছিল না, কারণ সাধারণ গ্রামীণ মানুষদেরও অর্থিক সংকট বেড়ে যাচ্ছিল।

পুরোহিত শ্রীশ্রীরাম এই সব দেখে মনের গভীরে দুঃখ পেতেন, আর লক্ষ্মীও তার বাবার মত করেই হতাশার সাগরে ভাসছিল। কিন্তু তার মন বলল, “শুধু দুঃখে বসে থাকা যাবে না। আমাদের উচিত একসাথে এসে এই দুঃখ কাটিয়ে উঠা।”

একদিন মন্দিরে বসে লক্ষ্মী ভাবছিলেন, কিভাবে গ্রামের মানুষের মধ্যে আবার নতুন করে আশা ফিরিয়ে আনা যাবে। সেই সময় গ্রামের বড়লোকেরা মন্দিরে জড়ো হয়। তারা ঠিক করে মন্দিরের চাঁদা বাড়ানোর ব্যাপারে। তাদের মতে, “মন্দিরে বেশি অর্থ আসলে আমরা সবাই ভাগ্যবান হবো।” কিন্তু যাদের আর্থিক সামর্থ্য কম, তারা এই নতুন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। তাদের অনেকেই ডরায় যে, এই চাঁদা দিতে না পারলে তারা সমাজে কলঙ্কিত হবেন।

লক্ষ্মী সেই বিষয়টি জানতে পেরে মন খারাপ করে। সে জানত, ধর্ম কখনো মানুষের ভাগাভাগি করতে পারে না, বরং মানুষকে একত্রিত করতে হয়। কিন্তু বড়লোকেরা ঠিক করেছিল দরিদ্রদের উপেক্ষা করে নিজেদের সুবিধার কথা ভাববে।

লক্ষ্মী তখন গ্রামের যুবক-যুবতীদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। সে বলল, “আমাদের ধর্ম মানে মানুষের মধ্যে ভালোবাসা ও সেবা। যদি আমরা একসাথে না থাকি, তাহলে আমাদের গ্রামের মুখে হাসি ফিরবে না। আমাদের উচিত সবার পাশে দাঁড়ানো, দরিদ্রদের সাহায্য করা, তাদেরকে মর্যাদা দেওয়া।”

গ্রামের তরুণেরা তার কথা শুনে উচ্ছ্বসিত হলো। তারা সম্মত হল, মন্দিরের আনুষ্ঠানিকতাকে ছাড়িয়ে একটা সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা হবে, যেখানে সবাই মিলেমিশে গ্রামের সমস্যা সমাধান করবে।

লক্ষ্মী নেতৃত্ব দিল, আর গ্রামের সবাই মিলে একটা সেবা সংঘ গঠন করল। তারা দরিদ্রদের জন্য বীজ ও খাদ্য সরবরাহ শুরু করল, ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষেতের মেরামত করল, শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করল। এসব কাজ করতে করতে গ্রামের মানুষদের মধ্যে একাত্মতার বন্ধন তৈরি হতে লাগল।

কিন্তু বড়লোকরা এই পরিবর্তন পছন্দ করল না। তারা বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো। কিছু লোক লক্ষ্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা কথা ছড়াল, তাকে গ্রাম থেকে বিতাড়িত করার চেষ্টা করল। কিন্তু লক্ষ্মী তার আদর্শ থেকে পিছিয়ে আসেনি। সে বলল, “ধর্ম মানে সাহস, সত্য এবং মানবতার সেবা। আমি কখনো অন্যায়ের সামনে মাথা নাড়ব না।”

গ্রামের একাংশ মানুষ লক্ষ্মীর প্রতি আস্থা হারিয়েছিল, কিন্তু তার ছাত্র-সমর্থকরা আরও দৃঢ় হলো। তারা একসঙ্গে মিলে গ্রামে শান্তি ও উন্নয়নের জন্য কাজ করে গেল।

তারপর বন্যার সময় এলো। নদীর জল বাড়তে লাগল, অনেক ক্ষেত inundated হলো। এই সময় লক্ষ্মীর নেতৃত্বে গ্রামের সবাই একসঙ্গে কাজ করল। তারা দুর্ভোগ পোহানো মানুষদের সাহায্য করল, ধানের ক্ষেত শুকানোর ব্যবস্থা করল, এবং মন্দিরে আশ্রয় নেওয়া মানুষদের জন্য খাদ্য ও পানি সরবরাহ করল।

বন্যা কাটিয়ে উঠার পর, গ্রামবাসী বুঝতে পারল, প্রকৃত লক্ষ্মী দেবীর আশীর্বাদ আসে সবার মধ্যে ভালোবাসা, একতা এবং সেবার মধ্য দিয়ে। ফসল ভালো হল, ধানের ফলন বেড়ে গেল।

গ্রামের মানুষ লক্ষ্মীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলো, আর সে দেখল তার সারা জীবনের স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে—একটি সুসংগঠিত, ঐক্যবদ্ধ, সেবামূলক সমাজ।

একদিন মন্দিরে ভোরবেলা, লক্ষ্মী যখন প্রার্থনা করছিল, মন্দিরের প্রাচীরে সোনালী রোদের ঝলকানি যেন ঐ দেবীর সান্নিধ্যের প্রতীক হয়ে এল। গ্রামবাসী বিশ্বাস করল, এই বার্তাই ছিল প্রকৃত লক্ষ্মী দেবীর আশীর্বাদ।

লক্ষ্মী তখনই বলল, “প্রকৃত লক্ষ্মী দেবী তখনই আমাদের হৃদয়ে বাস করে যখন আমরা একে অপরকে ভালোবাসি, একে অপরের পাশে দাঁড়াই, আর ধর্মের নাম করে বিভেদ না করি।”
20 Views
4 Likes
0 Comments
0.0 Rating
Rate this: