নিশিগড়ের জমিদার বাড়ি

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
রাতের অন্ধকার যখন চাদরের মত নেমে আসে নিশিগড়ের উপর, তখন জমিদার বাড়ির বিশাল দোতলা বাড়ির কর্ণারে অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়ে। বছর খানেক আগেও জমিদার শাহরিয়ার খাঁর শাসন ছিল গ্রামে — সে ছিলেন জমিদারির শেষ আসল মালিক, একাধারে গরীব ও ধনী মানুষের প্রিয় এবং অপ্রিয়। কিন্তু আজ? জমিদারি ছেড়ে চলে গেছেন অনেকদিন, আর সেই পুরনো রাজত্বের স্মৃতি রয়ে গেছে শুধু বাড়ির ভাঙা দেয়ালে, অবিকল সেই সময়ের ভেতর আটকে থাকা পোকা-মাকড়ের মতো।

শাহরিয়ার খাঁর কনিষ্ঠ পুত্র রিয়াজ আজ সেই বাড়ির একমাত্র বাসিন্দা। অন্যরা সবাই শহরে গিয়ে পড়াশোনা করছে, ব্যবসায় জড়িয়েছে বা দেশে-বিদেশে বেড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু রিয়াজ? সে কেন একাই জমিদার বাড়িতে থাকে? গ্রামের মানুষ জানে না ঠিক কি কারণে সে এই বাড়ির নিঃসঙ্গ চিরচেনা দেয়ালগুলোর মাঝে আটকে আছে। তবে যারা জানে, তাদের চোখে এক মায়ার আভাস, যেন রিয়াজ কোনো এক গভীর স্মৃতির সঙ্গে লড়াই করছে।


---

রিয়াজের জীবনটা খুব সাধারণ ছিল না। ছোটবেলা থেকেই সে ছিল একটু ভিন্ন। তার বাবা জমিদার শাহরিয়ার খাঁ বলতেন, “আমার ছেলে, শুধু ধন-সম্পদ আর জমির মালিকানা দিয়ে মানুষ বড় হয় না, হৃদয় বড় হতে হয়।” কিন্তু সেই হৃদয় বড় হওয়ার পাঠ তাকে দিতে গিয়ে সময়, ঘটনাবলি অনেকগুলো গোলমাল করেছিল।

একদিন ছিল রিয়াজের জন্মদিন। জমিদার বাড়ির গলির পেছনে এক ছোট গোপন বাগান ছিল, যেখানে রিয়াজ ছোটবেলায় ঝুমের মতো ঘুরে বেড়াত। সেই বাগানে একদিন পরিচয় হয়েছিল রুমী নামের এক মেয়ের সঙ্গে। রুমী ছিল গরীব কৃষকের মেয়ে, যার চোখে ছিল এক আশ্চর্য দীপ্তি। রিয়াজের সাথে তার বন্ধুত্ব দ্রুত ঘনিয়ে উঠেছিল। কিন্তু সেই বন্ধুত্ব জমিদার বাড়ির এবং গ্রামের মানুষের চোখে ছিল এক অপছন্দের সম্পর্ক।

জমিদার শাহরিয়ার খাঁ মনে করতেন, “আমার বংশের সম্মান রক্ষা করতে হবে। ধনী ও দরিদ্রের মিলন কখনোই সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়।” তাই রিয়াজের বন্ধুত্বের উপর তিনি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। কিন্তু রিয়াজ? সে তো হৃদয় বড় করতে চেয়েছিল বাবার কথামতোই।

“রুমী, তুমি আমার কাছে অনেক বেশি মূল্যবান,” একবার সে বলেছিল বাগানের একাকী ছায়ায়। কিন্তু সেই সম্পর্কের গোপনীয়তায় থাকতো না গ্রামের পঞ্চায়েতের চোখ। একদিন পঞ্চায়েতের লোকজন রিয়াজের বন্ধুত্বের খবর জমিদার বাড়ির কাছে নিয়ে আসল, আর জমিদার খান সেই রাতে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে উঠল, “এই সম্পর্ক যদি ধরে, তাহলে আমাদের নামের কলঙ্ক হবে।”


---

দিন গড়িয়ে গেল। রুমী আর রিয়াজের মিলন বিচ্ছিন্ন হয়। জমিদার খান রুমীকে গ্রাম থেকে চলে যেতে বললেন, আর রিয়াজকে বাধ্য করলেন শহরে পড়াশোনার জন্য পাঠাতে। কিন্তু তার হৃদয় যেন নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল। শহরের বিশাল পৃথিবীতে সে হারিয়ে যেতে চাইল না, তার মন বরং সেই বাগানে ফিরে যেতে চেয়েছিল, যেখানে ছিল রুমীর হাসি, ছিল শান্তির গুঞ্জন।

শহরে থাকার সময় রিয়াজ বহু কষ্ট পেল। নতুন পরিবেশ, নতুন বন্ধুত্ব কিন্তু সে কখনো পুরোপুরি খুশি ছিল না। হৃদয়ের গভীরে ছিল জমিদার বাড়ির সেই ছায়াময় বাগান এবং রুমীর মধুর স্মৃতি। পড়াশোনার শেষে সে ফিরে এলো নিশিগড়ে, কিন্তু গৃহত্যাগ করে জমিদার বাড়িতেই থাকার সিদ্ধান্ত নিল।

তখন থেকেই জমিদার বাড়ি হয়ে উঠলো এক নিঃসঙ্গ সীমানা, যেখানে কেবল রিয়াজ আর তার স্মৃতিরা বাস করত। রুমীর সঙ্গে আর দেখা হয়নি, সে চলে গেছে অজানা গন্তব্যে। আর রিয়াজ? সে জমিদার বাড়ির দেয়াল আর প্রাচীরের মাঝে হারিয়ে গেছে।


---

একদিন বিকেলে গ্রামের এক মেয়ে সুমাইয়া জমিদার বাড়ির দরজা খুলে প্রবেশ করল। সে ছিল রুমীর ছোট বোন, যার মনে জন্ম থেকে ছিল একটি স্বপ্ন—রিয়াজের কাছে যাওয়া এবং তাদের পরিবারের ওয়ারিশদের প্রতি কিছু বলতে পারা। সে জানত, রিয়াজের হৃদয়ে এখনও রুমীর জন্য একটা খাঁজ আছে।

সুমাইয়া জমিদার বাড়ির ভিতরে ঢুকে রিয়াজকে এক কোণে বসে দেখে। রিয়াজের চোখে তখন ধূসর বিষাদ, কিন্তু সুমাইয়ার উপস্থিতি যেন একটু আলো নিয়ে এলো তার জীবনে। তারা কথা বলতে লাগল, রিয়াজের অবসন্ন মুখে ধীরে ধীরে রঙ ফিরে এল।

“আপনার কি কখনো মনে হয়েছে, এই ঘরটা শুধু পুরনো দেয়ালের জায়গা নয়, এটা আমাদের ইতিহাসের অংশ?” সুমাইয়া জিজ্ঞাসা করল।

“হ্যাঁ,” রিয়াজ বলল, “এই ঘরটাই আমার হৃদয়। এই ঘরে আমার ভালোবাসা, আমার বেদনা, আমার স্বপ্ন—all bundled in these walls.”

সেদিন থেকে রিয়াজ আর সুমাইয়া গোপনে কথা বলতে লাগল। তারা বুঝল, তারা একে অপরের দ্বারা এক নতুন আশা ও শক্তি পাচ্ছে। সুমাইয়া রুমীর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য রিয়াজকে সহযোগিতা করল।


---

সময় যেতে যেতে জমিদার বাড়ির এক নতুন প্রাণ ফিরে এলো। রিয়াজ ও সুমাইয়া মিলে বাড়িটা সংস্কার শুরু করল, তাকে নতুন রূপ দিতে চাইল। তারা বাড়ির পুরনো ঐতিহ্য রক্ষা করে তাকে আধুনিক শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখল।

গ্রামের মানুষ প্রথমে অবাক হয়েছিল, জমিদার বাড়িতে এমন পরিবর্তনের খবর পেয়ে। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা বুঝতে পারল, জমিদার বাড়ি আর শুধু জমিদারদের স্মৃতি নয়, এটি গ্রামবাসীর শিক্ষার মন্দির হতে চলেছে।

রিয়াজ আর সুমাইয়া একসঙ্গে কাজ করল, কষ্ট করল, আর জমিদার বাড়ির অন্ধকার দিনগুলোকে সরিয়ে দিয়ে নতুন আলো ফোটাল। জমিদার বাড়ি যেন নতুন করে জীবিত হলো—একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হল।


---

এক রাতে জমিদার বাড়ির উঠানে, যখন পূর্ণিমার আলো ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন রিয়াজ ও সুমাইয়া একসঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিল। জমিদার বাড়ির প্রাচীর থেকে প্রতিধ্বনি হচ্ছিল নতুন দিনের গান।

রিয়াজ বলল, “এই বাড়ি আর শুধু আমার জন্য নয়, এই বাড়ি আমাদের সবার জন্য। যেখানে প্রেম আর বন্ধুত্বের চিরন্তন সেতু গড়া হবে।”

সুমাইয়া মুচকি হাসল, “হ্যাঁ, নিশিগড়ের জমিদার বাড়ি আর শুধু জমিদার বাড়ি নয়, এটা আমাদের স্বপ্নের ঠিকানা।”


---

নিশিগড়ের জমিদার বাড়ির গল্প এখানেই শেষ হয়নি। এটি হলো ভালোবাসার, বেদনার, আর এক নতুন সূচনার গল্প—যেখানে পুরনো দেয়ালের মাঝে জন্ম নেয় নতুন আশা।
21 Views
4 Likes
0 Comments
0.0 Rating
Rate this: