বদ্ধ ঘর

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
রোদ ঝলমল করছে একটা গ্রীষ্মের দুপুরে, কিন্তু ঘরের ভিতর গোধূলির মতো অন্ধকার। জানালা ও দরজাগুলো যেন কঠিন লোহার সেলে বন্ধ। সুরের চোখে যেন আলো ঢুকতেই চাই না। চার দেয়াল থেকে ঘন ধোঁয়া বেরোচ্ছিল, নিঃশ্বাস আটকে রাখার মতো গলায় প্যাঁচা একটা বোঝা। ওটা ছিল বদ্ধ ঘর — একটা সেইরকম ঘর যেখানে কেউ বাইরে থেকে আসতে বা যেতে পারে না। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, ওটা খালি নয়, ওটার ভেতরে একটা মানুষ আটকা।

সুরার জীবনের কাহিনি শুরু হয়েছিল এখান থেকেই।


---

সুরা এক সময় ছিল খুব মেধাবী আর হাসিখুশি মেয়ে। গ্রামের একটা ছোট্ট স্কুলে সে পড়ত, ছিল সকলের প্রিয়। বাবা মা ছিল কৃষক, খুব সাধারণ জীবন, কিন্তু সুরার স্বপ্ন ছিল আকাশ ছোঁয়া। গাড়ি চালানো, বড় শহরে যাওয়া, ভালো চাকরি পাওয়া—সবই তার মাথায় থাকতো।

কিন্তু হঠাৎ একদিন সুরার জীবন বদলে গেল। গ্রামেরই এক বড় লোকের অগোছালো ষড়যন্ত্রে সুরাকে নিয়ে আসা হলো এই বদ্ধ ঘরে। কেউ জানত না এখানে সুরা আছে, কেউ দেখত না তার মুখ, শুধু একটা সময়ে ফুরিয়ে আসা গুঞ্জন শোনা যেত।


---

বদ্ধ ঘরটি ছিল গ্রামের এক পুরানো বাড়ির পেছনের অন্ধকার কক্ষে। দরজা লক করা, জানালা বার করে দেওয়া, আর বাইরে থেকে সুরার কোনো যোগাযোগ ছিল না। সুরা যেভাবে ছিল, তার চারপাশে একটা অদৃশ্য সেল তৈরি হয়েছিল।

দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তার মন খুলে গেলেও বাইরের পৃথিবী থেকে তার দুরত্ব বাড়তে লাগল। বইগুলো ছিল তার একমাত্র সঙ্গী। পাতা উল্টিয়ে সে খুঁজে পেত অন্য জগতের আলো, যেখানে সে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু যেতে পারত না।

“আমি একদিন বের হবো,” সে নিজের সঙ্গে বলতো। “আমি যেন একটা পাখি, যে খাঁচা ভেঙে মুক্তি পাবে।”


---

কিন্তু দিনগুলো ছিল দীর্ঘ, একাকীত্ব বুকে বয়ে চলল এক অদ্ভুত বেদনার মতো। সুরার মনে হয়েছিল, সে যেন ভূতের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। তার চোখে জল জমত, কিন্তু কেউ দেখত না। সে জানত, কেউ যদি তাকে মুক্তি দেয়, তার স্বপ্ন জীবিত হবে।

তখনই, একদিন রাতে একটা ছোট্ট আলো এসে পড়ল তার ঘরের কোণে। প্রথমবারের মতো সে বুঝল কেউ তার জন্য এসেছে।

ঘরের দরজার বাইরে ছিল তার ছোট বোন রিমা। সে রাত জাগা, নীরব বৃষ্টি আর তার চুপিচুপি যাওয়া। রিমা অনেক দিন ধরে পরিকল্পনা করছিল বোনকে মুক্ত করার।

“বোন, আমি এসেছি তোমাকে নিয়ে যেতে,” রিমার গলায় লুকানো ছিল এক গভীর কাঁপুনি, কিন্তু চোখে আশার আলোকচ্ছটা।

সুরার হৃদয় দোলে, সে বুঝতে পারল, তার বাঁচার ইচ্ছা এখনও জেগে আছে।


---

রিমার সাহস ছিল অবিশ্বাস্য। সে রাতের আঁধারে দরজার তালা ভেঙে সুরাকে বাঁচিয়ে নিয়ে গেল। সে রক্ষা পেল অন্ধকার থেকে মুক্তির আলোয়।

গ্রামের মানুষ ধীরে ধীরে বুঝতে পারল সত্যিটা, তাদের চোখ খুলল বদ্ধ ঘরের আতঙ্ক সম্পর্কে। আর সুরার গল্প হলো গ্রামের একটি বিপ্লবের শুরু, যেখানে একাধারে নারীর মুক্তি আর সমাজের নতুন সূচনা হলো।


---

সুরার মুক্তি শুধু একটা ব্যক্তিগত মুক্তি ছিল না, এটা ছিল গ্রামের নারীদেরও মুক্তির প্রতীক। বদ্ধ ঘর গুলো ভেঙে ফেলা হলো, আর সেই বদ্ধ ঘরের অন্তরে আটকে থাকা স্বপ্নগুলো বাস্তব হলো।
21 Views
3 Likes
0 Comments
0.0 Rating
Rate this: