নন্দিনী

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
ছোটবেলা থেকেই নামটা শুনলেই কেউ না কেউ বলত, "নন্দিনী মানেই সৌন্দর্যের প্রতীক, তাই না?"
কিন্তু কেউ জানত না, নন্দিনীর সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য ছিল তার নীরবতা।

ঢাকার একটি পুরোনো গলির ভেতরে, একতলা একটা ঘর। চারদিকে যেন শহরের কোলাহল বেমানান। সেখানেই থাকত নন্দিনী—নিঃশব্দ, অদ্ভুত এক মেয়ে। কথা বলত না, হাসত না, কাঁদতও না। তবু তার চোখে ছিল একরাশ কথা, একরাশ প্রতীক্ষা।

নন্দিনীর মা সালমা বেগম, একটি প্রাইভেট স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। বাবা গত হয়েছেন সেই কবে, মাত্র ছয় বছর বয়সে। সেই থেকেই মা-ই সব, মা-ই জগৎ। স্কুল শেষে সালমা বেগম নন্দিনীর হাত ধরে ফিরতেন বাসায়, খেয়াল রাখতেন যেন সে বাইরের জগতে ভয় না পায়।

কিন্তু বাইরের জগৎ কি কাউকে ভয় না পাইয়ে থাকতে দেয়?

স্কুলজীবনে সহপাঠীরা প্রথম বুঝেছিল, নন্দিনী 'আলাদা'। তার কথা না বলা, কারও চোখে কৌতূহল জাগাত, কেউ করত হাসি-ঠাট্টা, কেউ বলত "ও বোধহয় বোবা।" কিন্তু নন্দিনী বোবা ছিল না। সে নিজে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সে কথা বলবে না।

এই সিদ্ধান্তের পেছনে ছিল এক পুরোনো ভয়—এক গ্রীষ্মের বিকেলে দেখা এক বিভীষিকা। মাত্র আট বছর বয়সে, এক প্রতিবেশী কাকু তাকে ছাদের কোণে চেপে ধরেছিল। মুখ চেপে রেখেছিল হাতে, আর বলেছিল, "একটু চুপ কর, কাউকে বলিস না, তাহলে মা তোকে ছুঁয়ে দেখতেও ভয় পাবে।"

সেদিনের পর নন্দিনী কথা বলা বন্ধ করে দেয়। সে বুঝে গিয়েছিল, কথার চেয়ে নীরবতাই বেশি নিরাপদ।

বয়স যখন ষোলো, মা একদিন বলল, "তুই তো কত কিছু আঁকিস খাতায়। একটা আর্ট স্কুলে ভর্তি হবি?"
নন্দিনী চোখে একবার তাকাল, তারপর হালকা মাথা নেড়ে রাজি হয়ে গেল।

সেই প্রথম, নিজের জন্য একটা রাস্তা খুলে দিল সে।
ঢাকার ধানমণ্ডিতে একটা ছোট্ট আর্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি হল সে। প্রতিদিন মেট্রোবাসে গিয়ে ফিরে আসে। একা। কারও চোখে চোখ রাখে না, কারও সঙ্গে বন্ধুত্বও করে না। তবে প্রতিদিন একটা ছেলেকে দেখে—তার নাম রায়ান।

রায়ান, লাল টি-শার্ট, কাঁধে স্কেচব্যাগ, হাসি মুখে সবার সঙ্গে গল্প করে। কিন্তু একদিন হঠাৎ সে চোখ পড়ল নন্দিনীর দিকে। সে লক্ষ্য করল, মেয়েটা কাউকে কিছু বলে না, শুধু বসে বসে ছবি আঁকে, যেন তার তুলিতে কথা।

এক বিকেলে রায়ান নন্দিনীর পাশে এসে বসল, বলল,
"তোমার আঁকা ছবিগুলো আমি দেখেছি। প্রতিটা ছবিতে এমন ব্যথা, এমন নিঃশব্দ কান্না—তুমি কিভাবে এঁকো?"

নন্দিনী কিছু বলল না। শুধু তার খাতার এক পৃষ্ঠা খুলে ধরল—সেখানে একটা ছোট্ট মেয়ে আঁকা, কোণায় মুখ গুঁজে আছে, আর পেছনে এক ছায়ামূর্তি।

রায়ান স্তব্ধ হয়ে গেল।

সেই থেকেই রায়ান প্রায় প্রতিদিন নন্দিনীর পাশে বসে। সে কথা বলে, গল্প বলে, নিজের ব্যথাও শোনায়।
একদিন সে বলল,
"আমি জানি, তুমি কেন চুপ।
কিন্তু তোমার নীরবতা আমাকে বেশি কিছু বলে। আমি শুনি, নন্দিনী। আমি সব শুনি।"

নন্দিনী তাকিয়ে থাকে রায়ানের দিকে। বহুদিন পর কেউ যেন তার বোঝা একটু লাঘব করে দিল।

রায়ানের বাবা-মা ছিল না, সে থাকত খালার বাসায়। ছোট থেকেই আর্টই তার আশ্রয়। দুই নিঃসঙ্গ প্রাণ একসঙ্গে বসে রঙে রঙে গল্প বুনত।

একদিন, ইনস্টিটিউটে বার্ষিক প্রদর্শনী হলো। সবাই নিজের আঁকা ছবি জমা দিল প্রদর্শনীর জন্য। রায়ান বলল,
"নন্দিনী, এবার তোমার ছবিটাও রাখো। মানুষের দেখা দরকার তোমার চোখের ব্যথা।"

প্রথমে রাজি ছিল না সে।
কিন্তু শেষে রায়ানের অনুরোধে একটি ছবি দিল—নাম রাখল "নির্বাক"।

ছবিটা ছিল এক বালিকার, যার মুখে কাপড় বাঁধা, আর চোখ দুটো ফেটে পড়ছে অশ্রুতে।
প্রদর্শনীতে সেই ছবি সবাইকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল।
এক বৃদ্ধা এসে বলেছিলেন,
"এই ছবিটা আমি কিনে নিতে চাই, কিন্তু তার চেয়েও বেশি জানতে চাই—কে এঁকেছে?"

সে রাতে ইনস্টিটিউটের সবাই জানল, নন্দিনী শুধু একজন নিঃশব্দ মেয়ে নয়, সে একজন শিল্পী।

রায়ান বলল,
"তুমি আজ যা করেছো, সেটা সাহস। শব্দ না থাকলেও, তুমি নিজের কথা বলেছো। আমি গর্বিত।"

নন্দিনীর চোখে অশ্রু টলমল করে উঠল। বহুদিন পর, একদম প্রথমবার, সে ফিসফিস করে একটা শব্দ বলল,
"ধন্যবাদ।"

রায়ান হতবাক হয়ে গেল, তারপর হেসে বলল,
"তুমি তো কথা বলতে পারো! অনেকদিন ধরে ভাবছিলাম, আমি শুধু তোমার কল্পনায় কথা বলছি কিনা।"

নন্দিনী হেসে ফেলল।
সে হাসি ছিল অদ্ভুত, শান্ত, অনেকটা যেন মুক্তির মতো।

বছর তিনেক পর...

নন্দিনী এখন একজন পেইন্টিং ইনস্ট্রাক্টর। সে এখনও খুব কম কথা বলে, কিন্তু এখন তার চারপাশে শিশুরা ঘিরে থাকে। সে তাদের আঁকা শেখায়, তাদের বোঝায় যে শব্দ ছাড়াও জীবন চলে, কিন্তু ভয়কে চিরকাল সঙ্গে রাখা যায় না।

রায়ান এখন দেশের বাইরে। প্রতিমাসে একটা করে চিঠি পাঠায়, আর প্রতিবার শেষে লেখে—
"তুমি বলেছো, তাই আমি জানি তুমি পারো। একদিন আবার কথা হবে, একসাথে।"

নন্দিনী জানে, সব গল্প প্রেম দিয়ে শেষ হয় না।
কখনও তা শুরু হয় সাহস দিয়ে।
আর সাহস, একা হাতে গড়ে নিতে হয়।
19 Views
4 Likes
0 Comments
0.0 Rating
Rate this: