পাকিস্তানি বধু

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
ঢাকার এক সন্ধ্যা। ধীরে ধীরে ল্যাম্পপোস্টের আলো জ্বলে উঠছে, আর তুষারের মনের ভেতর আলো-আঁধারির এক খেলা। আজ ওর বিয়ে। কিন্তু বউটা… বাংলাদেশি নয়, পাকিস্তানি।

তিন বছর আগে মালয়েশিয়ায় পড়তে গিয়ে পরিচিত হয়েছিল নুরিন আহমদের সঙ্গে। করাচির মেয়ে, সোজা চোখে তাকালে একধরনের নরম গর্ব ঝরে পড়ত। মুখে মিষ্টি উর্দু, কিন্তু চোখে যেন কবিতা। তাদের বন্ধুত্বটা ছিল সহজ, কিন্তু অকারণেই যেন গভীর। একই ক্লাস, একই বাসস্টপ, আর ধীরে ধীরে গল্পগুলো একই পথ ধরে চলতে লাগল। তুষার কখনো ভেবেইনি, এত দূরের একজন মানুষ এত আপন হয়ে উঠতে পারে।

একদিন তুষার জিজ্ঞেস করেছিল, “তুমি কি বাংলাদেশের কিছু জানো?”
নুরিন হেসে বলেছিল, “জানি… ১৯৭১ সালের কথা। কিন্তু আমার আম্মা বলে, মানুষ যদি মানুষকে ভালোবাসে, তবে সীমান্ত শুধু মানচিত্রে থাকে।”

তুষারের মন কেমন করে উঠেছিল সেদিন। একটা পাকিস্তানি মেয়ে—যার চেহারায় এত শান্তি, যার কথায় এত মায়া—সে যদি এমন করে ভাবে, তবে ভালোবাসা কেন থেমে থাকবে জাতি, ইতিহাস কিংবা পাসপোর্টে?

দুই বছর পর মালয়েশিয়া থেকে ফিরে এসে অনেক বাধা, অনেক কানাঘুষি পেরিয়ে অবশেষে দুই পরিবারের সম্মতিতে আজ বিয়ে হচ্ছে। সবাই বলছে, “পাকিস্তানি বউ আনছে ছেলেটা!”—কেউ বলছে কটাক্ষ করে, কেউ বলছে মজা করে। তুষারের কানে এসব ঢোকে না। ও শুধু জানে, ওর নুরিন... ওর ভালোবাসা... ওর জীবনসঙ্গিনী আজ ওর ঘরে আসবে।

বিয়ের পর নুরিন সবার সামনে একটু সংকুচিত, একটু চুপচাপ। তুষারের মা প্রথমদিনেই বলেছিলেন, “তুই ভালো থাকিস মা। দেশটা আলাদা হোক, মন যেন আমাদের হয়ে যায়।”
নুরিন কেঁদে ফেলেছিল সেদিন। সে জানত, এই পরিবার তার নিজের নয়, কিন্তু যদি মন থেকে চায়, তবে আপন হয়ে উঠতে কতটা সময় লাগে?

দিন যায়, নুরিন ধীরে ধীরে বাংলা শেখে। রান্নাঘরে তুষারের মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে শিখে ফেলে খিচুড়ি, ভর্তা, আর ইলিশের ঝাল। মাঝেমাঝে অদ্ভুত উচ্চারণে বলে ওঠে, “তুমি খাইছে?” – তখন পুরো ঘরে হাসির রোল পড়ে, আর নুরিন লজ্জা পেয়ে কাঁধে মাথা গুঁজে ফেলে।

তুষার রাতে তার পাশে বসে বলে, “তুমি তো পুরো বাঙালি হয়ে যাচ্ছ।”
নুরিন চুপ করে থাকে, তারপর ধীরে ধীরে বলে, “ভালোবাসা আমাকে ভাষা শিখিয়েছে, রান্না শিখিয়েছে, নতুন পরিবার দিয়েছে। আমি যদি পাকিস্তানি থাকি, তবু আজ মনে হয় আমি তোমারই দেশ।”

তুষার ওর হাত ধরে। নুরিনের চোখে জল জমে। তুষারের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে।

বাইরে তখন হালকা বৃষ্টি পড়ছে। ঢাকার আকাশ ধীরে ধীরে নেমে আসছে মাটির কাছে। আর দুই দেশের দুই সন্তান, এখন এক ছাদের নিচে, এক জীবনে, ভালোবাসা নামের এক অদ্ভুত চুক্তিতে আবদ্ধ।

নুরিন জানে, হয়তো কেউ তাকে "পাকিস্তানি বউ" বলবে সারাজীবন। কিন্তু তুষারের চোখে সে শুধুই নুরিন—একজন স্ত্রী, একজন প্রেমিকা, একজন মনের মানুষ।

আর তুষার? সে প্রতিদিন নতুন করে ভালোবাসে। এক নতুন ভাষায়, এক নতুন কল্পনায়, এক নতুন বাস্তবতায়—যার নাম ভালোবাসা, যার পেছনে আর কোনো দেশের নাম থাকে না।
71 Views
11 Likes
2 Comments
0.0 Rating
Rate this: