সাহেবের বউ

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
চাঁদের আলো পড়েছে পুকুরের জলে, সেই আলো প্রতিফলিত হয়ে এসে যেন ছুঁয়ে যাচ্ছে সাহেববাড়ির উঠোন। বিশাল, থামওয়ালা বারান্দার একপাশে বসে আছেন চেয়ারম্যান মোখলেসুর রহমান—এই এলাকায় সবাই তাঁকে “সাহেব” বলেই জানে। তাঁর বয়স এখন পঁচাত্তর পেরিয়ে গেছে। দুই ছেলে থাকে কানাডায়, মেয়ের বিয়ে হয়েছে ঢাকায়। বাড়িটা আজ অনেকটাই নিঃসঙ্গ, লোকবল আগের মতো নেই। তবুও মোখলেস সাহেব প্রতিদিন একই নিয়মে গরম দুধ খান, ফজরের নামাজ পড়েন, পত্রিকা পড়েন, আর চুপচাপ জানালায় তাকিয়ে থাকেন।

এই গল্পটা শুরু হয় ঠিক এক বছর আগে, যখন হঠাৎ একদিন খবর রটে—“সাহেব আবার বিয়ে করছেন!”

গল্পটা প্রথমে কেউ বিশ্বাসই করেনি। যে মানুষ গত দশ বছর ধরে নিজে বাজারে যান না, একা খাওয়া-দাওয়া করেন, ঘরের বাইরেই বের হন না—তিনি হঠাৎ করে বিয়ে করবেন? এবং সেই বউ হবে মাত্র বিশের ঘরে পা দেওয়া একটি মেয়ে?

মেয়েটির নাম—রাশিদা।

কোনো এক স্থানীয় গরিব পরিবারের মেয়ে, পড়াশোনাও তেমন হয়নি। তার বাবা ছিলেন সাহেবের একসময়কার জমি পাহারাদার। মারা যাওয়ার পর পরিবারে নেমে আসে অভাব। সেই সময় রাশিদার মা সাহেবের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ নেয়, আর সেই সূত্রেই প্রথম দেখা মেয়েটির সাথে।

মোখলেস সাহেবের মধ্যে যেন কিছু একটা জেগে উঠেছিল। চোখে চশমা ঠিক করে তিনি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন—

— “তোর নাম কী বললি?”
— “রাশিদা।”
— “বাহ্, নামটা ভালোই তো।”

এরপর বাড়ির লোক জানে, তিন মাসের মাথায় একদিন হঠাৎ ডেকে আনলেন এলাকার ইমাম সাহেবকে। চুপিসারে কাজি এলেন, সাক্ষী হিসেবে দাঁড়ালেন পুরনো হুজুর আর ড্রাইভার সালাউদ্দিন।

তারপর? হয়ে গেল বিয়ে।

লোকমুখে তখন কেবল দুই ধরনের কথা—“সাহেব পাগল হয়ে গেছেন” আর “মেয়েটা নিশ্চয়ই টাকা-পয়সার জন্য বিয়ে করেছে।”

কিন্তু কেউই সত্যিটা জানে না।

রাশিদা যখন প্রথম রাতটায় সাহেবের ঘরে ঢুকেছিল, তার গায়ে ছিল লাল পাড়ের শাড়ি, হাতে মেহেদির রঙ। তবুও চোখে ছিল একটা ভয়, একটা লজ্জা, আর একরাশ অপমানের আশঙ্কা।

মোখলেস সাহেব তখন বিছানায় বসে শুধু বলেছিলেন—

— “তুই ভয় পাইস না, আমি তোকে কোনোদিন ছুঁবো না যদি তুই না চাস।”

রাশিদা হতভম্ব হয়ে তাকিয়েছিল। একটা সত্তর বছরের পুরুষ, যার চোখে তখন মায়া, কোনো কামনা নেই। সেদিন সে বুঝেছিল, এই বিয়েটা কাগজের হোক বা সমাজের চোখে অশোভন—এই মানুষটা অন্তত তাকে সম্মান করছে।


---

দিন কেটে যায়। রাশিদা সাহেববাড়ির নতুন বউ। তবে সে রাজকীয় জীবন চায়নি। তার নিজের হাতে চা বানায়, বারান্দা ঝাঁটে, গাছে পানি দেয়। ড্রাইভার সালাউদ্দিন প্রথমদিকে খুব অবাক হয়েছিল।

— “আপা, এইটা আপনার কাজ না। আপনি তো এখন বউ মা!”
— “এই বাড়িতে আমি শুধু বউ না, আমি এই বাড়ির মানুষ।”

এই কথা শুনে সালাউদ্দিন একদিন সাহেবকে বলেছিল—“আপনি ঠিক মানুষকেই বিয়ে করসেন হুজুর।”

রাশিদা সাহেবের গায়ে তেল মালিশ করত, পত্রিকা পড়ে শোনাত, খাবারে বেশি লবণ হলে নীরবে মাথা নিচু করত, কম পড়লে মুচকি হেসে বলত—“আবার রান্না করি?” সাহেব শুধু বলতেন, “তুই থাক, আমি ঠিক আছি।”


---

সমাজ কিছুতেই মেনে নিতে পারল না এই বিয়েটা। বাজারে গেলে রাশিদাকে কেউ তাজা মাছ দিত না, পেছনে কটু কথা বলত—“বয়স্ক লোকরে বিয়া কইরা রাজরানী বউ হইছ!”

একদিন রাশিদা কান্না নিয়ে ফিরে এল। সাহেব প্রশ্ন করলেন না, শুধু বললেন—

— “এই সমাজ তো তোর চোখের জল দেখে না রে। তুই আমার চোখের দিকে তাকাস।”

সেই রাতেই রাশিদা প্রথম সাহেবের পাশে বসে তার কাঁধে মাথা রাখল।

তাদের মাঝে যে ভালোবাসা গড়ে উঠেছিল, সেটা কোনো যৌবনের প্রেম নয়। সেটা ছিল সহানুভূতির, সঙ্গের, বুঝতে পারার সম্পর্ক।


---

ছেলেরা কানাডা থেকে এসে যখন জানল বাবার এই বিয়ের কথা, তারা অগ্নিমূর্তি ধারণ করল। বড় ছেলে রিয়াদ একেবারে দেশে এসে হাজির।

— “বাবা, তুমি এই বয়সে কী করছো?”
— “আমি বিয়ে করছি।”
— “এই মেয়েটা তোমার সম্পত্তির জন্য এসছে।”
— “তুইও তো কখনো এই বাড়িতে ফিরে তাকাসনি।”

সাহেবের গলা কাঁপছিল না, কিন্তু চোখে ছিল চিরকালের অভিমান।

ছেলে তখন গিয়ে রাশিদার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল—

— “তুমি বাবাকে পাগল করেছো, আমরা এই বিয়ে মানি না।”
রাশিদা জবাব দিয়েছিল—
— “আপনার বাবাকে আমি সঙ্গ দেই, দয়া করি না। আপনি যদি বাবাকে ভালোবাসতেন, তাহলে উনি এতদিন একা থাকতেন না।”

এই কথা শুনে রিয়াদ চুপ করে গিয়েছিল। সে বুঝেছিল, এই মেয়েটি তার বাবার চেয়ে ছোট বয়সে হলেও—এই সংসারে সবচেয়ে বড় মানুষটা তিনিই।


---

একদিন সাহেব খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। হঠাৎ স্ট্রোক। হাসপাতালে ভর্তি করা হল।

রাশিদা তখন কোরআন পড়ছে তাঁর মাথার পাশে বসে, চোখে অশ্রু নেই—আছে স্থিরতা। যেন তাঁর কান্নার অধিকার নেই, আছে পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব।

ডাক্তার বললেন—“সাহেবের বয়স বেশি, তিনি যদি না বাঁচেন…”

রাশিদা তখন শুধু বলেছিল—“উনি আমার দোয়ার লোক, উনি গেলে আমি কোনো নামহীন ছায়া হয়ে যাব।”

তিনদিন পর সাহেব ধীরে ধীরে চোখ খুললেন, আর প্রথম যে শব্দটি উচ্চারণ করলেন—“রাশিদা…”

তিনিও জানতেন, এই মেয়েটিই তাঁর জীবনের শেষ আশ্রয়।


---

সাহেব ফিরে এলেন বাড়িতে, রাশিদার যত্নে আবার হাঁটলেন বারান্দায়, আবার এক সকালে বললেন—

— “আজ পুকুরে মাছ ছাড়া হইল না তো?”

রাশিদা হেসে বলল—“হইছে, কিন্তু আপনি আগে স্যুপ খান।”

সেই হাসিতে ছিল একটা অদ্ভুত প্রশান্তি। সমাজ চুপ হয়ে গিয়েছিল, ছেলেরাও একসময় মেনে নিয়েছিল। কারণ তারা বুঝেছিল—বাবার যেসব দিন তারা দিতে পারেনি, সেই দিনগুলো রাশিদা ফিরিয়ে দিয়েছে।


---

একটা বছর কেটে গেছে। সাহেব এখনো বেঁচে আছেন, ধীরে হাঁটেন, গল্প বলেন। আর রাশিদা এখন এলাকার সব বাচ্চার ‘আপা’, গরিব মায়েদের ‘মা’, এবং এই সাহেববাড়ির ‘আলো’।

একদিন সাহেব বারান্দায় বসে বললেন—

— “তুই তো আমার জীবন বদলাইয়া দিলি।”
রাশিদা মুচকি হেসে বলল—
— “আমি সাহেবের বউ, এটা কি ছোট কথা?”
18 Views
2 Likes
0 Comments
0.0 Rating
Rate this: