গহীন অর্ণে কুঞ্জের বিচরণ

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:

সময়টা ছিলো শ্রাবণের শেষের দিক, বর্ষা তার অস্তিত্বকে মলিন করার আগে ভারি বর্ষনের প্রকব চাচ্ছিলো।এই বর্ষনের ফলে চারিদিক টা কেমন আধারের চাদরে ঢাকে গেছে, যে আধারের মাঝে ছিলো বিদ-ধস্ত মন, মস্তিকে শান্ত করার ক্ষতমা, বর্ষা তার ভারি বর্ষন আর ঝোড়ো হওয়া দিয়ে যেনো আকাশের কালো মেঘকে নয় সাথে মনের মাঝে জমে থাকা হাজারো বিষন্নতার কালো মেঘকেও কাটিয়ে তোলার ক্ষমতা রাখে। বর্ষনের এই রিমিঝিম পানি পরার সুরের ধ্বনি যেনো রোদে পোরা মাটিকে নয় দুনিয়ার প্রকপে পুরতে থাকা তপ্ত মানুষের আত্মাকে ভিজিয়ে শান্ত করে। আরো বর্ষা আসলেই প্রকৃতির রূপ যেনো খুলে যাই। এই যেমন আজও গেছে, চাকরিকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ছোট বাচ্চাদের ভিজতে থাকার এক সুন্দর দৃশ্য, ঝড়ো হাওয়াতে দুলতে থাকা কদম জোড়া, বর্ষনের পানিতে ভিজা তৈরি হওয়ায় কাঁদামিটির মিষ্টি গন্ধ, সন্ধ্যা না হতেও দূর থেকে ভেসে এসে কর্ণে বারি দিচ্ছেলে ঝিঝি পোকার ক্ষীণ স্বরের ডাক। ভাঙ্গা রাস্তার গর্ত থেকে মাথা উচিত বর্ষনের গতির সাথে তালে তালমিলিয়ে ডাকতে থাকে ব্যাঙের দৃশ্য। কিন্তুু এই সব কিছু কি খেয়াল করার সময় আছে এই ব্যস্ত শহরের মানুষ গুলোর কাছে..? তারা তো নিজ কর্ম তাগিদে ভারি বর্ষন-কেও হারমানিয়েও ছুটতে ব্যস্ত। সত্যি কি আজব নাহ। কয়দিন আগেও সূর্যের উত্তাপে যখন পুরো শহর পুরে ছাই হয়ে যাওয়ার উপক্রম, তখন এই বর্ষার একফোটা পানির জন্য সকলের কতই না কাকুতিমিনতি। অথচ আজ যখন বর্ষা তার বৃষ্টি সখিকে নিয়ে পুরো দিন শহরটাকে ভেজিয়ে চলেছে তখন তার কপালে ধন্যবাদ নয় বরং অসহ্য বৃষ্টি, বিরক্ত কর কাদা মাখা রাস্তা, সময়ের ১২ টা বাজানোসহ অজশ্র গালাগাল কাপলে জুটলো। কথাটা ভেবেই মিটি হাসে কুঞ্জ। বিকেলে চাকরির আ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে পাওয়ার পরে, হালকা বৃষ্টি মাথার উপরে নিয়েই বাইরে বেরিয়েছিলো কুঞ্জ। বর্ষনের বেগ বারাই পার্কের ভিতরে ছাদ করা বসার জায়গাতে বসে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছিলো কুঞ্জ। এই পার্কে প্রথম এসেছিলো বাবার সাথে, কুঞ্জ ছোটবেলা থেকেই খুবই চঞ্চল টাইপের মেয়ে ছিলো। জনাব করিমুল সাহবে মেয়েকে এই পার্কে নিয়ে আসতেন যাতে সে তার মন মতো ছোটাছুটি করতে পারে। সেই থেকেই এই পার্কটা কুঞ্জের ভালো লাগার একটা অংশ হয়ে উঠে। বাবা মারা গেছেন আজ ৬ মাস, সাথে কুঞ্জের করা সকল প্রকার চঞ্চলিকতাও। করিমুল সাহেবের বাচ্চামো করা মেয়েটা হঠাৎ করেই বড় হয়ে গেছে, এটা যদি করিমুল সাহবে দেখতে পেতেন তাহলে তার কি হতো..? খুশি হতেন নাকি নিজের ছোট বাচ্চামো স্বভাবের মেয়েটাকে খুঁজে বেরাতেন। ফোনের রিংটোনের শব্দে ধ্যান কাটে কুঞ্জের, স্ক্রিনে ভাসোমান ব্যক্তির নামটা এই প্রথম নয়, বিগত ১৫ মিনিট ধরে কম করেও ১০০ বারের উপরে কল করেছে সে। যতবারই ফোন ধরতে হাত বারিয়ে ছিলো কুঞ্জ, ঠিক ততবারই ফোনের পাশে রাখা আ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটার দিকে দৃষ্টি পরতেই বারন্ত হাতটা থেমকে গেছে । এখন আর ফোনের আওয়াজে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।অনবরত ফোনটা বেজেই চলেছে কিন্তুু অপর প্রান্তের মানুষটাও যে হারমানতে নারাজ, তাইতো ক্লান্তহীন ভাবে একের পর এক কল করেই যাচ্ছে। এই পাগলামি নতুন নয়, আগেও কল না ধরা পর্যন্ত কল করেই গেছে সেই ব্যক্তি। আর ফোন না ধরলে বাসাই এসে হাজির। আজও আসতো কিন্তুু সে জানেনা কুঞ্জ ঠিক কথাই আছে,জানলে হয়তো এখানেও এসে উপস্থিত হতো।

"অনেক ভাবার পর ফোনটা হাতে তোলে কুঞ্জ, ফোনের স্ক্রিন অন করতেই ভসমান ২০৫ টা মিস কলের নোটিফিকেশন চোখে ভেসে কুঞ্জের, ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে মেসেজ অপশেনে গিয়ে, কাঁপা কাঁপা হাতে দুইটি লাইন টাইপ করে সে, কারণ কথা বললার ক্ষতমা তার আজ নেই

~ তুমি কানাডাতে চলে যাও শ্রাবণ। আমি চকারি পেয়েছি।

শুধু দুটো বাক্য, কিন্তুু তার ভার ও মানে দুটোই অধিক ভারি। এতটাই ভারি যে তাদের চাপে পরে কুঞ্জের দমবন্ধ হয়ে আসছে। বড় বড় শ্বাস টেনে ফোনটা বন্ধ করে দেই কুঞ্জ কারণ মেজের প্রতি উত্তর দেখার ক্ষমা নেই তার। নিজের ভিতরে জ্বলতে থাকে আগুনের তাপে ছোট নয়ন জোড়া থেকে কপল বেয়ে গরিয়ে পরা শীতল অশ্রুকে ঢাকতে, শ্রাবণের শেষ বর্ষনের মাঝে নিজেকে মিলে ধরলো কুঞ্জ। উদ্দেশ্য একটাই এই শীতল বর্ষনের পানিতে নিজের ভিতরে জ্বলতে থাকা আগুকে নিবার করা।

কুঞ্জ বাবা-মায়ে একমাত্র মেয়ে, তার একটা বড়ভাই এবং তার থেকে বয়সে ছোট আর একটা ভাই আছে। মধ্যবিত্তপরিবারের মেয়ে সে। বড়ভাই আর বাবা ব্যবসা সামলাতেন। ছোট খাটো একটা ব্যবসা ছিলো কুঞ্জের বাবা ওহ ভাইয়ের। বড় ভাই বিয়ে করছে ১ বছর, ছোট ভাই ক্লাস ৮ পরিক্ষা দিবে, আর কুঞ্জ সেতো ভার্সিটি বাংলা বিভাগের ৩য় বর্ষের ২১ বছর বয়সী ছাত্রী। সব কিছুই ভালো গুছানো ছিলো, যেনো এ এক সুন্দর স্বপ্ন। সুন্দর স্বপ্নটা আরো সুন্দর হয়ে উঠে যখন এই স্বপ্নে শ্রাবণ নামের রাজপুত্রের আগমণ ঘটে। শ্রাবণ কুঞ্জের ভার্সিটির সিনিয়র ছিলেন, নবীন বরণে তাদের দেখা, তারপর ভালো লাগে। ভালো লাগা থেকে তা ধীরে ধীরে ৩ বছরের সম্পর্কে পরিবর্তন হয়। শ্রাবণ মাস্টার্স করার পর পরই বিদেশে একটা চাকরীর অফার পাই। শ্রাবণে পরিবার বড়লোক, শ্রাবণ তার বাবা মার একমাত্র ছেলে। চাকরিটাও তার কাকার কোম্পানিতে পেয়েছিলো বাকি পড়াশোনা আর চাকরি দুইটাই বাইরের দেশে করবে। কুঞ্জ আর শ্রাবণের পরিবার তাদের সম্পর্কের বিষয়ে জানতো, এতে তাদের কোনো আপত্তিও ছিলো না। কথা ঠিক ছিলো যে বিয়ের পরে কুঞ্জ আর শ্রাবণে একসাথে কানাডাতে পারি জমাবে এবং তাদের পড়াশোনা ওহ ক্যারিয়ার সবকিছু ওখানেই গুছিয়ে নিবে, বিষয় গুলো এগোচ্ছিলো সেই ভাবেই।

"কিন্তুু সবতো আর স্বপ্নের মতো সুন্দর হয় না। যদি তুমি সব কিছুকে স্বপ্নের মতো সুন্দর ভালো তাহলে এটা জেনে রাখো.. এটা বাস্তব মাটি এখানে স্বপ্ন নয় বাস্তবতা বিরাজ করে" তাই তো কুঞ্জের সাজানো স্বপ্নটা কাঁচে চুরির মতো ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাই।

" সময়টাছিলো ৬ মাস আগে কুঞ্জের আন্টি বদলের দিন, দুই পরিবার এক নতুন সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে উঠে। খুশির কোনো কমতি ছিলো না সেদিন। কুঞ্জের বাবা ওহ ভাই অনুষ্ঠান শেষে নতুন আত্মাীয়দের তাদের বাড়ি পৌছে দিতে যান, কিন্তুু পূনোরাই নিজ বাড়ি আর ফেরা হয় না তাদের। নিজের সাজানো পরিবারটাকে একটু একটু করে শেষ হতে দেখেছে কুঞ্জ, বাবা-ভাই রোড এক্সিডেন্ট মারা যান। নিজ সন্তান ও স্বামীকে হাড়িয়ে মানসিক ভারসাম্য হারান কুঞ্জের মা। ওদিকে স্বদ বিবাহীত নারীর শরীর বিধবার দাগ লাগে, তাও তখন যখন সে ২ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। ছোট ভাইটাও কেমন জানি গুটিয়ে পরেছে। এই সকল কিছু মধ্যে খুব একা হয়ে পরে কুঞ্জ। বাবা-ভাইয়ের এক্সিডেন্টের পরে ব্যবসাটাও বন্ধ হয়ে যাই। মাও মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পরে। ওদিকে শ্রাবনের পরিবার, তারা তো পরিষ্কার ভাবে বলে দিয়েছিলেন তুমি শ্রাবণের সাথে চলে যাবে, আর তোমার পরিবাকে তোমার আত্মীয়রা দেখবে তাদের ওহ তো দায়িত্ব আছে। আর শ্রাবণ ওহ কুঞ্জের পাশে থাকবে কিন্তুু কুঞ্জর চাকরি করাতে ওর দ্বীমত আছে। শ্রাবণের পরিবারে বলা কথাটা কথাটা যেনো জলন্ত শিশা মতো কাণে বিধেছিলো কুঞ্জের। কুঞ্জ ভালো করে বুঝতে পারে এখন সে যদি শ্রাবণকে পাশে চাই তাহলে শ্রাবণকে তার পরিবারের বিরুদ্ধে যেতে হবে আর অন্য দিকে নিজ পরিবারকে ছেড়ে যাওয়ার মতো স্বার্থপরও কুঞ্জ হতে পারবে না। নাতো স্বার্থপর মেয়ে আর নাতো অন্য ছেলেকে তার পারিবার থেকে ছিনিয়ে নেওয়া নারী কোনোটাই হতে পারবে না সে। তাই নিজেই গুটিয়ে নেই সে। ধীরে ধীরে দ্রুত্ব বারিয়ে দেই শ্রাবণের আর নিজের মধ্যে, শক্ত করে নিজেকে গোরে আর তারপর... সবশেষে বড় সিদ্ধান্ত জানিয়েই দিলো শ্রাবণকে আজ।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যায় পা দিতে চলেছে ধরনী। শ্রাবণের শেষ বর্ষন কিছুক্ষণের জন্য বিরতি নিয়েছে। একটু পরে হয়তো আরো জোড়ে নামবে। বাড়ি ফিরতে হবে কুঞ্জের, এতসহজে হাড়মানলে চলবে না এখনো জীবনের অনেকটা পথ বাকি। ভেজা শরীরে ওড়নাটা চাদরের মতো জড়িয়ে ফুটপাত ধরে হাটা ধরলো কুঞ্জ। কিছু দূর যেতেই একটা রিক্সার পাই। আজ কোনো দামা দামী করেনা রিক্সারওয়ালা মামার সাথে অন্য দিন হলে হয়তো করত। বর্ষার বৃষ্টি বিরতি ভেঙ্গে আবার পুরো আকাশ থেকে ধরনীর বুকে নামতে শুরু করে। বৃষ্টি জন্য রিকশাওয়ালা বলে উঠে..

~ মা বৃষ্টি আরো জোড়ে নাবো, সামনের দিকে দিয়া না নিইয়া বাম দিক দিয়া নেই,, এইডা শর্ট কাট..

~ নেন মামা সমস্যা নেই। বাসাই পৌঁছাতে পারলে হবে।

রিকশার-ওয়ালা এবার নিজ গতিতে গন্তব্যে পৌছানোর উদ্দেশ্য ছুটতে থাকে। বর্ষা যেনো আজ পন করছে নিজের বৃষ্টির দাপটে সবাইকে নোয়াবে। তাই তো না থেমে উল্টো বেরেই চলেছে। বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়ার বেগ সমান তালে বারছে। আর এর মধ্যেই ঘটে এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। রিক্সশা মাঝ রাস্তাই ছিলো, তখনি কোথা থেকে একটা বাইক ঝড়ের বেগে এসে রিক্সশাতে তাল মারতেই যাচ্ছিলো তখনি রিকশা চালক, রিকশাটা ঘুড়িয়ে নেই। এতে বাইকে তাল খাওয়া থেকে বেঁচে গেলেও রিকশা টা উল্টে যাই। আর বাইকটাও তাল সামলাতে না পেরে মাটিতে লুটিয়ে পরে। রিকশা থেকে পরে জ্ঞান হারাই কুঞ্জ। জ্ঞান হারানোর আগে ঝাপসা চোখে ওর দিকে মানুষকে এগিয়ে আসতে দেখে, লোকজনের সকল কথপোকথনের শব্দ ওর কানে আসে কিন্তুু কিছু বুঝতে পারে না ওহ, চোখ দুটি ধীরে ধীরে আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যাই।

জ্ঞান ফিরে সাদা সিলিং চোখে পরে কুঞ্জের। কিছুক্ষণ নিজেকে ধাতস্ত করার পর বুঝতে ওহ হাসপাতের বেডে শুয়ে আছে । মাথায় ও পায়ে সামান্য চট পেয়েছে, হাতে স্যালাইয়েন ক্যানেলা পরানো। কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকে তার মধ্যে একজন নার্স এসে হাতের ক্যানেলা খুলে দিয়ে যাই। মাথা ঘোরা বন্ধ হলে উঠে বসে, "কয়টা বাজে বাসায় ফিরতে হবে " এই চিন্তাই বেড থেকে নামতে গেলেই পেছন থেকে একজন মধ্যে বয়সী নার্স ভারি কন্ঠে বলে উঠে

~এই যে কোথাই যাচ্ছেন..এক্সিডেন্ট কেস আপনার, পুলিশ আছে, ওনাদের সাথে দেখা করুন আগে। যতসব...

নার্সের কথাই কুঞ্জের মনে পরে, তার তো এক্সিডেন্ট হয়েছিলো একটা বাইকের সাথে। কথাটা মনে হতেই নার্সকে জিজ্ঞাসা করে উঠে

~ আচ্ছা রিকশা চালক আর বাইকের লোকটার কি হয়েছে...

কুঞ্জের কথা মধ্যে বয়সী নার্সটা বিরক্ত হয়ে বলে উঠেন

~ রিকশা চালকের কিছুই হয়নি, উনি রিকশা নিয়ে চলে চম্পাট, আপনার চট গেলেছিলো তাই রাস্তার লোক হাসপাতালে দিয়ে গেছেন। আর এই ছেলের..! ওর আর কি হবে যা হওয়ার তাই হয়েছে..? এই বয়সে মরার ইচ্ছে হয়েছিলো মরতে তো পারেনি তবে পা ভেঙ্গে, মাথা ফাঁটি ঐ কেবিনে পরে আছে।

কথা বলতে বলতে সামনে থাকা কেবিনের দিকে চোখ দিয়ে ঈশা করলেন নার্সটি। পাশের বেডে রোগীকে দেখা শেষ করে নার্সটি চলে যান। কুঞ্জ বাইরে অপেক্ষারত পুলিশের কাছে যাওয়ার আগে নার্সের দেখানো কেবিনে ডোকে। বেডে শুয়ে থাকা পায়ে ওহ মাথাই ব্যান্ডেজ করা ছেলেটিকে দেখে কুঞ্জ চমকে উঠে। একি এতে কোনো ১৬/১৭ বছরের কিশোর ছেলে। কুঞ্জ ধীরে ধীরে অজ্ঞান ছেলেটার দিকে এগিয়ে যাই, গায়ের সাদা রং গোলাপী ঠোঁট চুলের রং সবকিছুই বলে দিচ্ছে এই লোকো বাঙালী নয়। কেনো যানি না ছেলেটাকে দেখে খুব মায়া হলো কুঞ্জের, হয়তো একই বয়সী একটা ভাই আছে তাই।

~ একি আপনি এখনো যান নি। যান পুশিল অপেক্ষা করছে যান বলছি... এখানে কি আপনার..?

ধমকের সুরে বলা কথাগুলোতে চমকে উঠে কুঞ্জ। পিছনে ফিরে নার্সটাকে দেখতে পাই যে রাগি চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সরকারি হাসপাতালে নার্স, এরা চিকিৎসা কম কথা বেশি শোনাই। তাই আর সময় নষ্ট না করে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে কুঞ্জ।

কুঞ্জের যাওয়ার ৯/১০ মিনিট পর ছেলেটির জ্ঞান ফেরে। জ্ঞান ফিরে নিজেকে হাসপাতালে বেডে পা ভাঙ্গা অবস্থা পরে থাকতে দেখে ইংরেজি ভাষাই গালাগালি আওড়াতে থাকে ছেলেটা।

~ এছেলে জ্ঞান ফিরেছে তোমার, নাম কি..? বাসা কই..? বাইরে পুলিশ আছে তাদের সাথে কথা বল।

ছেলেটাকে এক ভ্রু উচিয়ে না বোঝার ভাঙ্গিতে নার্সের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে, আরো বিরক্ত হয় নার্সটি, রাগে গজগজে কন্ঠ বলে উঠেন

~ ভাব দেখো। বলি নবাব পূত্র আপনার জন্য কি এখন আমি ইংরেজি কথা বলবো..? বাইরে পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা ভালো দেখে কেস করেনি নাহলে এতখন পুলিশ ইংরেজি শোনা তো তোমাকে। এই ছোট বয়সী মরার পাখনা গজিয়েছে।

কথা শোনার পর কিছু একটা ভেবে ছেলেটা শোয়া থেকে লাফিয়ে উঠে বসে।বড় বড় করে তাকিয়ে নার্সকে প্রশ্ন করে..

~Are the people I had an accident with alive?

ছেলেটার কথাই আরো বিরক্ত হয় নার্স, এই ব্রিটিশ পুত্রকে এখন কে বোঝাবে। নাক মুখ কুঁচকে ওখান থেকে চলে যাই নার্সটি। আর তার পিছন পিছন "ওয়েট" বলতে বলতে ছেলেটাও ভাঙ্গা পা-নিয়ে খুড়িয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে। কেবনি থেকে কিছু দূরে হাসপাতালের ফার্মেসি থেকে ঔষুধ নিচ্ছিলো কুঞ্জ। ঔষুধ নিয়ে পিছনে ঘুরে দেখে এই কান্ড। ছেলেটা নার্সটির পছনে ভাঙ্গা পা নিয়ে খুঁড়ি খুঁড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে আর কিছু একটা জিজ্ঞাসা করছে। নার্সটি একবার এদিকে আর একবার ওদিকে ঘুরছে, একটু দুরে কুঞ্জকে দারিয়ে থাকতে দেখে, পিছনে ঘুরতে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে কুঞ্জের দিকে ঈশা করে নার্সটি বলে উঠে

~ ঐ যে মেয়ে, That girl you accident.

কথাটা বলেই নার্সটি এক প্রকার পালিয়ে যাই, নার্সের ভাঙ্গা ইংরেজি ছেলেটা বুঝতে পেরেছে কিনা কে জানে, তবে নার্সের করা ঈশাকে অনুসরণ করে কুঞ্জকে দেখতে পাই ছেলেটা, তারপর খোঁড়ানো পায়ে কুঞ্জের সামনে এসে দাড়াই । কুঞ্জ ছেলেটিকে দেখে বলে উঠে

~ Are you ok..? ( তুমি ঠিক আছো..?)

ছেলেটা কিছুই বলে না, চুপচাপ দাড়িয়ে কুঞ্জের দিকে তাকিয়ে আছে, ছেলেটিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কুঞ্জ আবারও কিছু বলতে যাবে তখনি ছেলেটা বলে উঠে..

~ I did the accident with you ..?( আমি কি তোমার সাথে এক্সিডেন্ট করেছিলাম..?)

~ yes

~ So you have told the police ( তো পুলিশকে জানিয়েছো তুমি..)

~ No

~ but why..? ( কিন্তুু কেনো)

ছেলেটার বিরক্তকর চেহারা দেখে হাসি পাই কুঞ্জের। আসলেও ছেলেটা বাচ্চা, কেমন বাচ্চার মতো ছোট ছোট প্রশ্ন করছে, কুঞ্জ মুচকি হাসে। ছেলেটার কপালে এলোমেলো ভাবে পরে থাকা চুলগুলো দেখে হাত দিতে খুব ইচ্ছে হলো কুঞ্জের, এভাবেই তো ছোট আর বড় ভাইটার চুল ঠিক করে দিতো সে, তাই নিজের অজানতেই ছেলেটার চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করে দিতে দিতে বলে উঠে

~ Because I have a younger brother like you. So I didn't make any case in your name. There are police standing outside, I am telling them, you will give them your identity then they will deliver you in your home ( কারণ তোমার মতো আমার একটা ছোট ভাই আছে, তাই তোমার নামে কোনো পুলিশ কেস করিনি, বাইরে পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে, আমি তাদের বলে যাচ্ছি, তুমি তাদেকে তোমার ঠিকানা দিলে তখন তারা তোমাকে তোমার বাড়ি পৌছে দিবে)

হাতটা নামিয়ে, একটা মিষ্টি হাসির রেখা টেনে বিদায় নেই কুঞ্জ। ছেলেটা এখনো খালি কুঞ্জের চলে যাওয়া পানে চেয়ে রইল।

হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত ৯:৩০ বাজে গেছে। বাড়িতে ঢুকে সর্বপ্রথম যেটা কুঞ্জের বুকে বিধলো সেটা হলো শূন্যতা, কুঞ্জের মাকে দিনের বেশির ভাগ সময় ঘুম পারিয়ে রাখা হয়, নয়তো তাকে সামলানো সম্ভব হয় না। ছোট ভাইটাকে মামাবাড়ি পাঠিয়েছে, মায়ে এমন পাগলামো ছেলেটা সহ্য করতে পারছে না। আর ভাবিকে তো তার পরিবারের লোক নিয়ে গেছেন। মাঝখানে একবার যোগাযোগ করেছিলো কুঞ্জ, তখন তাকে স্পষ্ট ভাবে বলে দিয়েছিলো বাচ্চা নষ্ট করা হবে আর তাদের মেয়ের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই কুঞ্জের পরিবারের তাই যেনো আর কোনো যোগাযোগ না করে।

মাকে বিকালে খাইয়ে ঘুম পারিয়ে বাইরে গেছিলো কুঞ্জ, পিরে দেখে এখনো ঘুমিয়ে আছেন আসমা বেগম। কুঞ্জ মায়ের পায়ে কাছে এসে মেঝেতে বসে পরে, এরপরে মায়ের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে সব কথা বলতে থাকে, জানে মা শুনতে পাবে না তাও নিজের মনকে শান্ত করার বৃথা চেষ্টা

~ জানো মা আজকে না আমি শ্রাবণকে ফিরিয়ে দিয়েছি। আর কখনো পাবো না ওকে। আমি জানি আমার কষ্ট হবে হয়তো না মরে বাঁচে থাকবো কিন্তুু আমার আত্নার কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। খালি শরীর টাই বেঁচে থাকবে মা।

কুঞ্জের কপল বেয়ে গরিয়ে শীতল অশ্রু মায়ের পায়ে ঠাই নিলো। কুঞ্জ আর কিছুক্ষণ ওখানে বসে থাকে। তারপর কখন যে ঘুমিয়ে গেছে নিজেও জানে না।

ক্ষত যতই গভীর হক না কেনো, সময় দিলে তা ঠিকই শুকিয়ে যাই। কষ্ট হবে, কখনো তো এটা মনে হবে "এই কষ্ট থেকে মৃত্যু শ্রেয় "কিন্তুু সময় গড়ালে তাও ঠিক হয়ে যাবা, খালি সময়ের শ্রোতে নিজেকে নিজের মতো ছেড়ে দিতে হবে ।

আজ শ্রাবণের দেশ ছাড়ার দিন, ঐ দিন মেসেজের পরে ১ সপ্তাহ হয়ে গেছে। ঐ দিন মেসেজ দেওয়া পরে ফোন আর চালু করেনি কুঞ্জ। তারপরে দিন দুপুরের দিকে শ্রাবণ সোজা কুঞ্জের বাড়িরতে চলে আসে...

~ সমস্যা কি তোমার ..? ফোন বন্ধ কাল সারাদিন বাসা থেকে গায়েব ছিলে, আর কি..? কি জানি মেসেজ করেছিলেন..? বলি সাহস বেরে গেছে না,, ৪ মাস ধরে তোমার নাটক দেখছি, অনেক হয়েছে আর না ..এসব চাকরি-টাকরি বাদ দিয়ে আমার সাথে চল। তোমার মা ভাই আমাদের সাথে থাকবে।

শ্যাম বর্ণের লম্বা অগ্নিময় রক্তিম চোখে কুঞ্জের দুইবাহু শক্ত করে চেপে ধরে দাঁতে দাঁত পিশে কথা গুলো বলে উঠে..

~ হাত ছাড় শ্রাবণ, তোমাকে তো বলেছি কাডাতে চলে যেতে

~ আগে আমার কথার উত্তর দাও, বলো আমার সাথে যাবে তুমি.. আরো শোনো আমি কোথাও যাচ্ছি না কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে নাও, আাগেও বলেছি এখনো বলছি কোথাও যাচ্ছি না আমি,,বুঝেছো..?

~ আস্ত কথা বলো শ্রাবণ, পাশের রুমে মা শুয়ে আছে

~ আস্তে কথা বলবো..? এতকিছুর পরে তুমি আমাকে আস্তে কথা বলতে বলছো

~ তো কি করবো আমি তোমার দয়া নেবো আমি তোমার দয়াই বাচবো..? শ্রাবন তোমার আমার সম্পর্ক টা এখন ভাঙ্গা কাঁচের চুরির মতো যেটাকে আমি কখনো হাতে পরতে পারবো না, যদি পরতে যাই তাহলে সেটা আমাকে খালি আঘাত দিবে আর কিছুই না।

"দয়া" নিজের প্রিয়সীর মুখ থেকে নিজের ভালোবাসাকে দয়া নামক শব্দে অখ্যায়িত করা টা শ্রাবণ কে ভিতর থেকে ক্ষতবিক্ষত করে দেই। কুঞ্জকে ছেরে একটু দূরে সরে গিয়ে মলিন স্বরে বলে

~ দয়া... আমার ভালোবাসা, যন্ত, দায়িত্ব বোধকে দয়া বলছো তুমি..?

~ তুমি তোমার মতো থাকো শ্রাবণ, আর আমাকে আমার মতো ছেড়ে দাও

হাতের অনামিকা আঙ্গুলে থাকা ছোট আংটিটা খুলে শ্রাবণের হাতে ধরিয়ে দিতে দিতে কথাটা বললো কুঞ্জ। এই কাজটা যেনো শ্রাবণকে পাগল করার জন্য যথেষ্ট ছিলো। শ্রাবণ রাগে উম্মাদের মতো দিকবেদিক দিশা হারিয়ে ঘরের সকল জিনিস ভাঙ্গতে শুরু করে। কুঞ্জ ওকে বাঁধ দিতে গেলে কুঞ্জকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেই শ্রাবণ। এই হিংস্রতা কখনই দেখি কুঞ্জ শ্রাবণের মধ্যে। ভাগিস মাকে ঘুমের ঔষুধ খাওয়ানো হয়েছিলো নয়তো মা থাকলে কি হতো। শ্রাবণ বিদ ধস্ত অবস্থা কুঞ্জের পায়ের কাছে বসে কাদতে কাদতে বলতে থাকে

~ কুঞ্জ প্লিজ চলো আমার সাথে প্লিজ কুঞ্জ। আমি কথা দিচ্ছি তোমার ভাই মায়ের কোনো কষ্ট হতে দিবো না আমি। প্লিজ কুঞ্জ... আমি মরে যাবো..

কুঞ্জ নিজের চোখের জল মুছে উঠে দাড়াই, শক্ত কন্ঠে বলে উঠে

~ দরজাটা ঐ দিকে শ্রাবণ।

শ্রাবণ নিষ্প্রাণ ভাবে তাকিয়ে ছিলো কুঞ্জের দিকে। ওর দৃষ্টি স্পষ্ট বলে দিচ্ছলো যে " তুমি এত কঠিন কিভাবে হতে পারলে কুঞ্জ "। এরপরে শ্রাবণ খালি একটা কথাই বলে চলে গেছিলো

~ আমাকে ফিরে দিলে তো কুঞ্জ.. আমার ভালোবাসাকে তুচ্ছ্য করলে, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তোমাকে একলা থাকতে হবে, মিলিয়ে নিও।

কুঞ্জ কোনো কথাই বলেনি, মনতো চাচ্ছিলো শ্রাবণকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলতে

~ আমাকে একা ফেলে যেওয়া না শ্রাবণ, আমার পাশে থাকো।

কিন্তুু কিছুই বলেনি কুঞ্জ। চুপছিলো, ক্ষত তো আগেই পেয়েছিলো কিন্তুু শ্রাবণের কথাগুলো যেনো সেই ক্ষতকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে থকথকে ঘাতে রূপন্তর করেছে, শ্রাবণে এলোমেলো করে যাওয়া ঘরে বসে মুখ চিপ কান্না করছে কুঞ্জ সারাদিন সারারাত।

তারপর কেটে গেছে একসপ্তাহ আগের কথা গুলোই ভাবছিলো কুঞ্জ পার্কের বেঞ্চে বসে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে। দুইদিন পরে অফিস শুরু হবে, মায়ের শরীর টা এই একসপ্তাহে একটু ভালো হয়েছে। ডাক্তার বলেছে আর একটু যন্ত করলে তারাতাড়ি সুস্থ হবেন তিনি, ভাইটাকেও নিয়ে আসবে কুঞ্জ। মা ওহ ভাইকে শক্ত হাতে সামলাতে হবে কুঞ্জকে, আজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বলা একটা কথা খুব মনে পড়ছে কুঞ্জের,
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন

"জীবন হলো এক কঠিন সত্য যে সত্যকে সবাই ভালবাসে "

আসলেও, সব হারিয়েও এই কষ্ট জীবন নিয়ে বেঁচে আছে সে, চাইলেও জীবনের মায়া ত্যাগ করতে পারছে না ।

তার সকল চিন্তার মাঝে একটা ছোট বাচ্চা ছেলে এসে কুঞ্জের হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দেই, ছেলেটাকে কাছে ডেকে চিঠিটা কে দিয়েছে জিজ্ঞাসা করলে বলে..

~ জানি না একটা ভাইয়া তোমাকে দেখিয়ে বললো এটা দিতে

~ ভাইয়া.... আচ্ছা সে দেখতে কেমন ছিলো বলতে পারবে ..?

~ মুখ দেখি নাই মার্স পরা ছিলো, তয় অনেক লম্বা

"শ্রাবণ " নামটা উচ্চারণ করেই চিঠিটা খোলে কুঞ্জ, ঠিক কুঞ্জের পাঠানো দুই বাক্যের মেসেজের মতোই চিঠিতেও দুইটি বাক্য লেখা ছিলো চিঠিতে

~" হয়তো অনেক সময় লাগ কিন্তু আমাকে ভুলো না রমনী, কথা দিলাম আমি ফিরবো,
ফিরে আসবো তোমার কাছে। খালি একটু অপেক্ষা করো আমার জন্য। "

চারকোণের কোকরানো কাজটা শীতল অশ্রুতে ভিজতে শুরু করে, আচ্ছা এটা কি কোনো পুরোনো সম্পর্কের বিচ্ছেদের কষ্টের অশ্রু, নাকি এক প্রিয়সীর অনিশ্চিত সম্পর্কের অপেক্ষাই প্রহর গুনার সম্মতি জানিয়ে মন থেকে ঝড়ানো ভালোবাসার কোনো এক দুফোটা অশ্রু ...?

চলবে.......✍️
99 Views
1 Likes
0 Comments
0.0 Rating
Rate this: