পবিত্র ভালোবাসা

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
ঘড়ির টিকটিকানি শুনতে শুনতেই ভোরের স্নিগ্ধ আলোটা আস্তে আস্তে রায়ান আর মাহিরার ছোট্ট দোতলা বাড়ির কোণে এসে মিশে যায়। উঠোনে তুলসী গাছের পাতায় বৃষ্টির ছোট ছোট বিন্দু ঝপজপ করে পড়ছে। রান্নাঘরের দরজা খোলা, আর সেখানে মাহিরা বসে আছে এক প্যালে লালচে চায়ের কাপ নিয়ে। রায়ান উঠে এসে জানালার পাশে দাঁড়ায়। বৃষ্টির ঠাণ্ডা বাতাস তার চুল ঝড়াচ্ছে, তবু মুখে একটা সান্ত্বনার হাসি।

“চা কেমন হয়েছে?” মাহিরা চোখে চশমা রেখে জিজ্ঞেস করলো, মুখে লেগে থাকা হালকা লাজের খোঁজ নিয়ে।

“যেমন তোমার হাতের চায়ের গন্ধ, তেমনই,” রায়ান বলল, “তোমার চা ছাড়া আমার সকালটা অসম্পূর্ণ।”

মাহিরার চোখে ঝলমল করে সুখের জলে ভেজা সে হাসি। তাদের মধ্যে এমন কত রকম কথা হয়, যা উচ্চস্বরে বলা হয় না, কিন্তু বুঝতে পারা যায় মাত্র।
বিয়ে হয়েছে ছয় বছর, তবু তারা যেন একে অপরের চোখে প্রতিদিনই নতুন কিছু খুঁজে পায়। দিনের শুরু থেকে শেষ অবধি তাঁদের ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই এক পবিত্র ভালোবাসার গল্প।

দুপুরে অফিস থেকে ফিরে আসা রায়ানের ভেজা জামা দেখে মাহিরার গায়ে একটু ক্ষোভের হাসি ফোটে। “আবার ছাতা নিয়ে যাসনি?” সে মিষ্টি গলায় বলল।

“জানিস, আমি তোমার জন্যই তো একটু অবুঝ হয়ে যাই,” রায়ান বলল এবং আঙুল দিয়ে মাহিরার কপালে হালকা ঠেলা দিল।

“আমি তো চাই তুমি সবসময় সাবধানে থাকো,” মাহিরা গলা নরম করে বলল।

বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল। তারা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখল কলকাতার রাস্তা ঘাসফুলের মতো ঝকঝকে হয়ে উঠেছে। রায়ান হাতে হাত দিয়ে মাহিরাকে টেনে নিয়ে বলল, “আমি জানি, জীবনে অনেক ঝড় আসবে। কিন্তু তোমার সঙ্গে আমি সবকিছু পার করবো।”

মাহিরার চোখ ভিজে গেল। “আমার সঙ্গে থাকার জন্য ধন্যবাদ,” সে বলল, “তুমি আমার সবথেকে বড় আশ্রয়।”

তাদের ভালোবাসার মধ্যে এইটা সবচেয়ে বড় সত্য—যে যতই ঝামেলা আসুক, দুজন একসঙ্গে থাকলেই সব কিছু পার হওয়া যায়।

তবে ভালোবাসার পথে তাদেরও ভুল বোঝাবুঝি আসেনি কেন? একদিন মাহিরার ফোনে কাজ নিয়ে জরুরি কল এলো। সে সারা রাত অফিসে ছিল। ফিরে এসে সন্ধ্যায় রায়ান অপেক্ষা করছিলো, কিন্তু না বুঝে রাগ করল, “তুমি কি আর আমার কাছে সময় দিতে পারো না?”

মাহিরা কেঁদে বলল, “রায়ান, আমি তোমাকে ভালোবাসি, কিন্তু আমার কাজও আমার পরিচয়।”

সেই রাতে তারা অনেক কথা বলল, হাসল, কেঁদে শান্ত হলো। বুঝল, ভালোবাসা মানে শুধু কাছাকাছি থাকা নয়, বিশ্বাস আর সহানুভূতির বন্ধন।

বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলো, জীবনের ওঠাপড়া অনেক। কিন্তু একদিন রায়ানের অফিসে এমন একটি সংকট এলো, যা মহীরার চোখের সামনে ছায়া ফেলে। এক দুর্ঘটনায় তার কর্মক্ষেত্রের এক সহকর্মী গুরুতর আহত হল। রায়ান ভেঙে পড়লো। তখন মাহিরাই তার হাতে হাত রেখে বলল, “তুমি একা নও, আমরা একসঙ্গে এই ঝড় পাড় করবো।”

এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলো তাদের ভালোবাসার গভীরতা বুঝিয়ে দেয়। তাদের ভালোবাসা শোনা যায় না উচ্চ শব্দে, তবু স্পষ্ট আর গভীর।

তাদের পবিত্র ভালোবাসা শুধু রোমান্টিক নয়, সেটা একে অপরের আত্মার কাছে থাকা বিশ্বস্ততার নাম। একে অপরের চোখে দুঃখ, কষ্ট দেখেও ছাড়ার নয়, বরং দুজনের এক অঙ্গিনীত প্রতিজ্ঞা — জীবনটা যত কঠিন হোক, সঙ্গ ছাড়বো না।

অবশেষে, এক সন্ধ্যায় রায়ান হাতে এক ছোট্ট দুল নিয়ে মাহিরার কাছে এসে বলল, “যেভাবে আমি তোমার পাশে আছি, তোমার জীবনটাও আমার হাতেই থাকবে। সারাজীবন।”

মাহিরা সেই দুলটি হাতে নিয়ে বলল, “আমার জীবন তুমি, রায়ান। এই ভালোবাসা পবিত্র, অটুট আর অম্লান।”

বৃষ্টির ফোঁটা ঝরছে বারান্দার উপর, মৃদু বাতাস বইছে, আর সেই ছোট্ট দোতলা বাড়িতে এক জোড়া হৃদয় ধীরে ধীরে এক হয়ে যাচ্ছে—একটা পবিত্র ভালোবাসার গল্পে।
70 Views
7 Likes
1 Comments
0.0 Rating
Rate this: