মনের মণিকোঠায়

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
কলকাতার এক অলস দুপুর। বাইরে হালকা রোদ, ছাদে রঙিন জামা শুকোচ্ছে, আর বাড়ির ভেতর চলছে তীব্র ঝগড়া।

– "একটা মেয়ে হয়ে এইসব ছেলেদের মতো কাজ করতে তোর লজ্জা করে না রে ঈশানী?"
– "কেন মা? আমি কি ব্যাংক ডাকাতি করছি নাকি?"
– "তুই সাইবার ক্রাইম নিয়ে কাজ করিস মানে তোর মাথায় কিছু নেই। সারাদিন ছেলেদের মতো ল্যাপটপ ঘাঁটিস, পুলিশ অফিসে যাস, কোর্টে যাস…! তোর এই সব কাজের জন্যই তো আজ অব্দি একটা পাকা সম্বন্ধও হলো না!"
– "তোমরা সবাই শুধু বিয়েটাকেই লক্ষ্য বানাও, মা। আমি নিজে দাঁড়াতে চাই, বুঝো না?"

ঈশানী বসু — বয়স সাতাশ, পেশায় একজন সাইবার ফরেনসিক এনালিস্ট। কলকাতা পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চে কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করে। হ্যাকার, ব্ল্যাকমেইলার, ডার্ক ওয়েবের অপরাধীরা যার ভয়ে কাঁপে, সেই ঈশানী তার নিজের বাড়িতেই এক চিরস্থায়ী অপরাধী — কারণ সে ‘মেয়ে’ হয়েও ‘অন্যরকম’।

বাবা হেমন্ত বসু, অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ক কর্মকর্তা। যিনি এখন একমাত্র কর্তব্য মনে করেন—মেয়ের বিয়ে দেওয়া।
মা, সীতা বসু, চিরকাল সংসারের খাঁচায় থেকে শিখে গেছেন—মেয়ে মানেই সংসারের মেয়ে, অন্য কিছু না।
ঈশানীর একমাত্র বোন পিউ, সদ্য বিবাহিত, যাকে মা প্রতিদিন উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন।

কিন্তু ঈশানীর জগৎ অন্য।

তার মনের মণিকোঠায় রয়েছে এক ভয়ংকর দৃশ্য – নিজের কলেজ জীবনে এক সহপাঠিনীর ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হওয়া, সাইবার হ্যারাসমেন্ট, আর পুলিশের কাছে গিয়ে উপেক্ষিত হওয়ার অভিজ্ঞতা। সেই যন্ত্রণাই তাকে আজকের ঈশানী করেছে।


---

সে দিন দুপুরে, হঠাৎ করে অফিস থেকে কল আসে।

– “ম্যাম, এক হাই-প্রোফাইল সেলিব্রিটির ফোন হ্যাক হয়েছে। ব্যক্তিগত কিছু ছবি লিক হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আপনাকে ইনভেস্টিগেট করতে হবে।”
– “ঠিক আছে, এখনই রওনা হচ্ছি।”

ঈশানী বাইকটা স্টার্ট করে রাস্তায় নামল। হেলমেটের ভিতর মুখ দেখা যায় না, শুধু চোখ জ্বলজ্বল করে। যেন বাঘিনীর চোখ।

সেলিব্রিটি বাড়িতে পৌঁছে সে দেখে মিডিয়ার ভিড়, দেহরক্ষীদের ব্যারিকেড, আর এক অসহায় মেয়ে — জনপ্রিয় নায়িকা আর্ণবী সেন। চোখে জল, মুখে আতঙ্ক।

– “আমার ফোনটা কেউ হ্যাক করেছে, ঈশানী দি। আমার প্রাইভেট ফটো… ওরা এটা ভাইরাল করে দেবে বলে হুমকি দিচ্ছে। আমার জীবন শেষ হয়ে যাবে।”
– “চিন্তা করো না। যারা ওটা করেছে, তাদের আইডেন্টিটি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তুলে আনব। আমি দোষীদের ছেড়ে কথা বলি না।”

ঈশানী সঙ্গে সঙ্গে ফোনের এনক্রিপশন রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং শুরু করে দেয়। সে জানে, একবার এই ব্ল্যাকমেইলার ধরা পড়লে কতজনের জীবন রক্ষা পাবে।


---

রাত তখন সাড়ে দশটা। ঈশানী অফিসে বসে কোড অ্যানালাইসিস করছে। পাশে কফির কাপ, আর সামনে ছড়ানো সার্ভার লগ, এনক্রিপশন ডেটা।
হঠাৎ এক সিকিউরিটি ক্যামেরা ফুটেজে সে দেখতে পেল একটা পরিচিত মুখ – তন্ময় দত্ত, ঈশানীর প্রাক্তন প্রেমিক।
সে-ই ছিল এই হ্যাকিং সিন্ডিকেটের মূল মাস্টারমাইন্ড।
কয়েক বছর আগে হঠাৎই সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়েছিল ঈশানীকে, কারণ সে ঈশানীর পেশাকে “পুরুষালী অহংকার” বলত।
আর আজ… সে-ই এই অপরাধের পেছনে?

ঈশানীর মাথায় তখন বিস্ফোরণ। কিন্তু সে ভেঙে পড়ে না।
সে জানে, এই কেস এখন শুধু প্রফেশনাল নয় — এটা তার নিজের সম্মান, আত্মসম্মান, অতীতের প্রতিশোধ।


---

পরের দিন ভোরে, পুলিশের সাইবার স্কোয়াড অভিযান চালায়। তন্ময় গ্রেফতার হয়।

মিডিয়ার হেডলাইন:
"সেলেব ব্ল্যাকমেইল কাণ্ডে মূল অভিযুক্ত গ্রেফতার, সাইবার এনালিস্ট ঈশানী বসুর সাফল্য"
"একজন মেয়ের হাতেই ধরা পড়ল সিস্টেমের শত্রু!"

ঈশানী বাড়ি ফেরে। মা চুপচাপ বসে, বাবা কিছু বলতে চায়, কিন্তু ভাষা খুঁজে পায় না।
শুধু ছোট বোন পিউ এসে বলে —
– “দিদি, তুই আমার অহংকার।”

ঈশানী তখন শুধু একবার মায়ের চোখের দিকে চায়।

– “দেখলে মা? আমি শুধু একজন মেয়ে নই, আমি ঈশানী। আমি নিজের পায়ে দাঁড়ানো একজন মানুষ। আর এটাই আমার বিয়ে, আমার সংসার, আমার পরিচয়। আমি আমার মনের মণিকোঠায় আলো জ্বালাতে পেরেছি। তুমি যদি আমাকে না বোঝো, অন্তত ভালোবাসো।”

মা প্রথমবার মাথা নিচু করে। অশ্রু গড়িয়ে পড়ে ঠোঁটের কোণে। হয়তো সে আজ বুঝতে শিখেছে —
মেয়েরা শুধু কারোর ঘরের নয়, তারা নিজের ঘরের আলোও হতে পারে।
44 Views
6 Likes
0 Comments
0.0 Rating
Rate this: