হুজুরের চোখে প্রশ্ন

সবুজ-শ্যামল ঘেরা একটি নদী গ্রাম চর জাঙ্গালিয়া।
পাখির কিচিরমিচির, গোধূলির ছায়া, আর কুয়াশা ভেজা ভোরে ভেসে আসে ফজরের আজান।
গ্রামের দক্ষিণ পাশে দাঁড়িয়ে আছে একটুকরো নিরবতা,
আল বারাকা নূরানী মাদ্রাসা।
টিনের ছাউনি, মাটির মেঝে, আর অল্প কয়েকটা বেঞ্চ।
এই মাদ্রাসাই যেন গ্রামের এক অবিচ্ছেদ্য হৃদস্পন্দন।
হুজুর, পুরো নাম জানা নেই অনেকের, সবাই তাকে শ্রদ্ধাভরে হুজুর বলেই ডাকে।
সাদা পাঞ্জাবি, কাঁধে একটুকরো চাদর, আর চোখে নীরবতা।
তাঁর স্ত্রীর কথাও খুব বেশি কেউ জানে না,
শুধু এটুকু বোঝে,
তিনি নিজেই একজন নীরব সংগ্রামী, যিনি হুজুরের সঙ্গে ভাগ করে নেন প্রতিটি অব্যক্ত অভাব।
সেদিন চর জাঙ্গালিয়ার চায়ের দোকানগুলো একটু বেশি সরব।
রেডিও আর মোবাইলে ঘুরে ঘুরে আসে একটাই খবর,
নয় হাজার স্কুল জাতীয়করণ হয়েছে।
বাজারে আনন্দের জোয়ার।
কারও মুখে হাসি, কারও গলায় নতুন আশার সুর।
কিন্তু হুজুর চুপচাপ বসে থাকেন,
কানে শব্দ ঢোকে ঠিকই, হৃদয়ে দোলা দেয় না।

মনের ভেতরে জমে থাকা প্রশ্ন আজ যেন একটু বেশি স্পষ্ট,
আল বারাকা নূরানী মাদ্রাসা কি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়?
আমার ছাত্রদের স্বপ্ন কি রাষ্ট্রের চোখে অদৃশ্য?

রাতে ঘরে ফিরে স্ত্রীর চোখের ভাষা পড়তে পারেন তিনি,
না বলা কথা, চাপা দীর্ঘশ্বাস।
পরদিন মাদ্রাসায় তিনি ছাত্রদের বলেন,
আজ তোমাদের গল্প বলি...
এই দেশে নয় হাজার স্কুল সরকারি হয়েছে,
আর কিছু মাদ্রাসা আজো তালিকার বাইরে দাঁড়িয়ে,
যেমন দাঁড়িয়ে আছে আমাদের আল বারাকা।
একটি শিশু হাত তুলে বলে,
হুজুর, আমরা কি রাষ্ট্রের সন্তান না?
হুজুর থেমে যান, তারপর বললেন,
আমরা সন্তান, তবে এখনও স্বীকৃত না।
তবে মনে রেখো, পরিশ্রমের আলোকে অন্ধকার ঢেকে যায়।
হুজুর জানেন, সত্য সব সময় গর্জে ওঠে না,
কখনো কখনো সে নীরবতায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
তবুও তিনি স্বপ্ন দেখান তাঁর ছাত্রদের,
ভবিষ্যতের, মর্যাদার, সমতার।

রাত গভীর হলে চর জাঙ্গালিয়া ঘুমিয়ে পড়ে।
শুধু একটি মাটির ঘরে আলো জ্বলে থাকে,
হুজুর নামাজ শেষে সিজদায় মাথা রাখেন,
কাঁপা কণ্ঠে বলেন,
হে আল্লাহ, আল বারাকাকে তুই রাষ্ট্রের দৃষ্টি দে।

মাদ্রাসাও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,
স্বপ্ন সেখানে জন্মায়, ঘাম সেখানে ঝরে,
তবুও যদি রাষ্ট্র তাদের উপেক্ষা করে,
তাহলে তা শুধু অবহেলা নয়, একটি জাতির একপাক্ষিকতা।

চর জাঙ্গালিয়ার বাতাসে প্রশ্নটা এখনো ঘোরে
নয় হাজার স্কুলের আলো যখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে,
তখন আল বারাকা নূরানী মাদ্রাসার মতো কত শত প্রতিষ্ঠান
কেনো আজও অন্ধকারে?

বার্তা

শিক্ষা কেবল পাথরের দালানে সীমাবদ্ধ নয়।
টিনের চালা, মাটির মেঝে, মাটির মানুষ,
তারাও গড়ে তোলে জাতির ভবিষ্যৎ।
রাষ্ট্রকে মনে রাখতে হবে,
চর জাঙ্গালিয়ার আল বারাকা নূরানী মাদ্রাসাও বাংলাদেশেরই সন্তান।