ভুতের বাড়ীর বিয়ের প্রস্তাব
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
একদা এক গভীর জঙ্গলঘেরা গ্রামের প্রান্তে এক বিশাল পুরোনো বাড়ি ছিল। লোকমুখে প্রচলিত ছিল, সে বাড়িতে ভূতের বাস। সন্ধ্যা নামলেই নাকি অদ্ভুতুড়ে আওয়াজ শোনা যেত—কখনও ক্যাকটাসের মটমট শব্দ, কখনও বা দরজার চিঁহিঁহিঁ করে খোলার শব্দ, আর জানালা দিয়ে দেখা যেত ছায়া মূর্তি। গ্রামের কেউই সে বাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেঁষতো না, এমনকি দিনের বেলাতেও না। বলা হত, ভূতেরা নাকি এতটাই শক্তিশালী যে সূর্যের আলোতেও তাদের ক্ষমতা কমে না।
কিন্তু আমাদের গল্পের নায়ক, তিন্নি, ছিল এক্কেবারে ব্যতিক্রম। তার মাথায় ভূতের ভয় তো ঢোকেনি, উল্টে তার ছিল অসম্ভব কৌতুহল। ভূত আছে কি নেই, সেটা নিজের চোখে না দেখলে সে বিশ্বাস করবে না, এই ছিল তার প্রতিজ্ঞা। একদিন তার এক মামাতো ভাই, ফাজিল ফজলু, তিন্নিকে চ্যালেঞ্জ করে বসল। ফজলু বরাবরই তিন্নির পিছনে লাগত আর এমন সব অদ্ভুত চ্যালেঞ্জ দিত যা কেউ পূরণ করতে পারবে না। সে বলল, "যদি ভূতের বাড়িতে গিয়ে একটা ভূতের সঙ্গে সেলফি তুলতে পারিস, তাহলে আমি তোকে একটা আস্ত রসগোল্লার হাঁড়ি দেব! শুধু তাই নয়, সারা জীবন তোকে আমার বাইকের পেছনে চড়িয়ে ঘুরতে দেব।"
রসগোল্লার নাম শুনে তিন্নি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। সে তো মহা রসগোল্লাভক্ত! উপরন্তু ফজলুর বাইকে চড়ার লোভ তাকে আরও উসকে দিল। সে এককথায় রাজি হয়ে গেল। পরদিন রাতে, যখন আকাশে নতুন চাঁদের ফালি উঁকি দিচ্ছিল, তিন্নি ভূতের বাড়ির দিকে রওনা হল। হাতে একটা টর্চ, আর পকেটে সদ্য কেনা নতুন মোবাইল ফোন, যার ক্যামেরা নাকি রাতের বেলাতেও স্পষ্ট ছবি তোলে।
বাড়ির ফটকটা ক্যাঁচকোঁচ শব্দে খুলতেই তিন্নি দেখল, ভেতরে অন্ধকার আর স্যাঁতসেঁতে একটা গন্ধ। দেয়ালগুলোয় শ্যাওলা জমেছে, আর কোথাও কোথাও দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়েছে। মনে হচ্ছিল যেন বাড়িটা বহু যুগ ধরে কারও স্পর্শ পায়নি। ভয়ে তার বুকের ভেতর ধুকপুক করলেও, রসগোল্লার লোভ তাকে এগিয়ে নিয়ে চলল। সে সাবধানে পা ফেলে ভেতরে ঢুকল। হঠাৎ একটা ঠাণ্ডা বাতাস তার গা ছুঁয়ে গেল। মনে হল যেন অদৃশ্য কেউ তার পাশ দিয়ে হেঁটে গেল। তিন্নি টর্চ জ্বেলে দেখল, একটা পুরোনো ভাঙা সোফার ওপর একটা সাদা কাপড় পরা মূর্তি বসে আছে! মূর্তিটা এতই স্থির ছিল যে প্রথমে মনে হল যেন কোনো ভাঙা পুতুল।
তিন্নি সাহস করে সামনে এগিয়ে গেল। "হ্যালো! আপনি কি ভূত?" তার গলাটা একটু কাঁপা কাঁপা শোনাল।
মূর্তিটা ধীরেসুস্থে মাথা তুলে তাকাল। ধুলো আর মাকড়সার জালে ঢাকা তার মুখটা আবছা দেখা যাচ্ছিল। তার চোখ দুটো যেন গভীর অন্ধকারের দুটি গর্ত। হঠাৎ সে একটা ফ্যাসফেসে গলায় বলল, "কে তুমি? আর এত রাতে এখানে কী করছ? তুমি কি আমাকে বিরক্ত করতে এসেছ, নাকি আমার পুরোনো জিনিসপত্র চুরি করতে এসেছ?" তার গলায় একটা বিরক্ত আর হতাশ ভাব স্পষ্ট ছিল।
তিন্নি একটু কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, "আমি তিন্নি। ফজলু ভাই চ্যালেঞ্জ করেছে যে আপনার সাথে একটা সেলফি তুলতে হবে... আর তার বদলে আমি একটা আস্ত রসগোল্লার হাঁড়ি পাব, আর তার বাইকেও চড়তে পারব।"
ভূতটা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার দীর্ঘশ্বাসে যেন পুরোনো ধুলাবালির গন্ধ বেরিয়ে এল। "আহ্! সেই পুরোনো গল্প! সবাই শুধু ভূত দেখতে আসে। কেউ আমার মনের কথা বোঝে না। গত ২০০ বছর ধরে আমি এখানে একা একা বসে আছি, আর সবাই শুধু আমার ভয় পায়, কিংবা আমার সঙ্গে সেলফি তুলতে আসে।"
তিন্নি অবাক হয়ে বলল, "আপনার মনের কথা? কী কথা?"
ভূতটা এবার মুখটা আরও স্পষ্ট করে তুলল। দেখা গেল, তার চোখগুলো অদ্ভুতভাবে চকচক করছে, যেন অনেক দিনের না বলা কথা বলার জন্য ছটফট করছে। সে খানিকটা ফিসফিস করে বলল, "আমি আসলে বিয়ে করতে চাই! এই ভূতের জীবন আর ভালো লাগে না। সারাদিন একা একা পুরোনো বাড়িতে বসে থাকি, আর মাঝে মাঝে লোকে এসে সেলফি তুলতে চায়। কোনো সঙ্গী নেই, কোনো আড্ডা নেই। আর রাতের বেলায় একলা লাগে খুব।"
তিন্নি হতভম্ব। ভূত বিয়ে করতে চায়! সে হাসি চাপতে পারল না, কিন্তু ভূতকে অপমান করার সাহসও পেল না। "বিয়ে? কিন্তু... কাকে?"
ভূতটা আরও খানিকটা এগিয়ে এসে বলল, "যে আমাকে বুঝবে, আমার ভূতের বাড়ির রান্নাবান্না সামলাবে—যদিও ভূতেরা খায় না, কিন্তু একটা গৃহস্থালির পরিবেশ চাই তো!—আর মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে অমাবস্যার রাতে চাঁদের আলোয় ভূতুড়ে নাচ করবে!" ভূতটা কল্পনা করতে করতে যেন নিজেই কিছুটা রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল।
তিন্নি হো হো করে হেসে উঠল। সে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। "ভূতের নাচ! হা-হা-হা! এটা তো কল্পনাও করা যায় না!"
ভূতটা এবার মুখ ফুলিয়ে বলল, "হাসছ কেন? ভূতেরও মন আছে, ইচ্ছা আছে! মানুষের মতোই তো আমাদেরও একটা জীবন আছে, যদিও অদৃশ্য! তুমি কি আমার জন্য একটা বউ দেখতে পারো? যে ভূতকে ভালোবাসতে পারবে? এই জঙ্গলে এমন সুন্দরী কোনো ভূতনি তো দেখি না।"
তিন্নি কোনোমতে হাসি থামিয়ে বলল, "ঠিক আছে, আমি চেষ্টা করব। কিন্তু প্রথমে আমার রসগোল্লাটা পেতে হবে! আর ফজলুর বাইকে চড়াও বাকি আছে!"
ভূতটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, "যাও, রসগোল্লা খাও। আর যদি এমন কোনো মেয়ে পাও, যে ভূতকে বিয়ে করতে রাজি, তাহলে আমাকে খবর দিও। তাকে আমি এই ভূতের বাড়ির এক অংশ লিখে দেব, আর কোনোদিন তাকে ভয় দেখাব না।"
তিন্নি দ্রুত একটা সেলফি তুলে সেখান থেকে চম্পট দিল। ফজলুকে রসগোল্লার হাঁড়ি দিতে বাধ্য করে সে পুরো গ্রামে ভূতের বিয়ের প্রস্তাবের গল্প ফেঁদে বসল। তারপর থেকে গ্রামের লোকেরা আর সেই ভূতের বাড়ির দিকে না তাকিয়ে, যখনই ভূতের বিয়ের কথা ওঠে, হেসে লুটিয়ে পড়ে। আর তিন্নি? সে এখনও নাকি মাঝে মাঝে ভূতের বাড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবে, বেচারা ভূতটা কি শেষমেশ একটা বউ খুঁজে পেল! নাকি সে এখনও একা একা অমাবস্যার রাতে চাঁদের আলোয় তার ভূতুড়ে নাচের সঙ্গীর অপেক্ষায় বসে আছে!
26
Views
0
Likes
0
Comments
0.0
Rating