জীবন সাথী (৫)

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
" ধন্যবাদ তৃষা... আমি সারা জীবন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। আপনার এই উপকারের কথা আমি কোনোদিন ভুলব না।" প্রিন্সিপাল স্যারের রুম থেকে বেরিয়েই তৃষাকে মৃদু স্বরে কথাগুলো বললো আয়ান।

" আরে না না,, আমি কি এমন উপকার করেছি আপনার, যে আপনি সারা জীবন আমার উপর কৃতজ্ঞ থাকবেন। আমি শুধু নিজের ভুলটা শুধরে নিয়েছে। এই যা....!" হাসতে হাসতে কোমল স্বরে আয়ানকে কথাগুলো বলল তৃষা।

" তৃষা, আপনি না খুব ভালো... খুবই ভালো।" তৃষার চোখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে কথাটা বলল আয়ান।

" কিন্তু কেন?"

" না.. এমনিই, আপনি খুব ভালো!"

" ওহ্....!" মনে মনে হাসতে হাসতে কথাটা বললো তৃষা।


এভাবেই ধীরে ধীরে প্রেম শুরু হয় তৃষা আর আয়ানের। একসাথে থাকতে থাকতে দু'জন দু'জনকে নিজের জীবনের থেকে বেশি ভালোবেসে ফেলে। রোজ তাদের ফোনে কথা হয়। ভার্সিটির ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়। অবশ্য তখন আয়ানের কাছে এতকিছুর জন্য টাকা ছিল না, তাই তৃষাই বেশিরভাগ খরচ বহন করতো।

তারপর মাস পাঁচেক পেরিয়ে যায়, দু'জনে মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় তারা এবার বিয়ে করবে। তাদের ভালোবাসাকে পূর্ণতা দেবে। তাই তৃষা যেদিন তার বাবাকে গিয়ে বলে সে আয়ানকে বিয়ে করবে, প্রথমেই তাকে সাহিদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন আয়ানের আর্থিক অবস্থা কেমন? সে কোন বংশের ছেলে! কি করে, তার কয়টা গাড়ি! এইসব প্রশ্ন।

তৃষা যখন তার বাবাকে বলে আয়ান কোনো কোটিপতির ছেলে নয়, তার কয়েকটা গাড়ি কি, একটা বাইক অব্দি নেই, তখন সাহিদ সাহেব তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। এককথায় তিনি বলে দিলেন ওসব ফকির, মিসকিন ছেলের সাথে তিনি নিজের মেয়ের বিয়ে দেবেন না!

সেইদিন বেশ রেগে যায় তৃষা। সিদ্ধান্ত নেয় আয়ানের সাথে সে পালিয়ে যাবে! আয়ানও তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়। সেও পালিয়ে বিয়ে করতে প্রস্তুত। তাই তারা সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই সাহিদ সাহেবের অমতে পালিয়ে বিয়ে করে ফেলে।


আয়ান সামান্য একটা লাইব্রেরীর দোকানে কাজ করে সংসার চালাতে হিমশিম খেয়ে পড়ছিল। এটা ভেবে তৃষা তার বাবার বাড়ি থেকে নিয়ে আসা দশ ভরি স্বর্ণের গহনা আয়ানকে দিয়ে বলে সেগুলো বিক্রি করে একটা ব্যবসা শুরু করতে!

আয়ান প্রথম প্রথম ওই গহনাগুলো নিতে রাজি হয় নি। কিন্তু তৃষা যেভাবে জোর করছিল, একপর্যায়ে সে নিতে রাজি হয়ে যায় সেগুলো।

সেদিনই গহনাগুলো নিয়ে বিক্রি করতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় আয়ান। কিন্তু সে এরপর আর বাড়ি ফেরে নি। তৃষা অনেক খুঁজেছে আয়ানকে, থানায় গিয়ে জানিয়েছেও বটে, কিন্তু কেউ আয়ানের হদিস দিতে পারে নি। সবাই ব্যার্থ হয়ে আশা ছেড়ে দিয়েছে!


তারপর পেরিয়ে ছয়টা মাস। কোত্থেকে রাতুল রাহমান নামের ছেলেটাকে তৃষার সামনে নিয়ে এসে সাহিদ সাহেব বলেন, তার সাথে তিনি ছেলেটার বিয়ে ঠিক করেছেন।‌ আর মাত্র এক সপ্তাহ পরেই তার আর রাতুলের বিয়ে।
কিন্তু তৃষা কিছুতেই রাজি নয় এই বিয়েতে। সে একমাত্র আয়ানকেই ভালোবাসে, আর অন্য কাউকে নয়। এই দুনিয়ায় আয়ান ব্যতিত অন্য কাউকে সে নিজের জীবন সাথী হিসেবে মেনে নিতে পারবে না। কাউকেই না!
তবু সাহিদ সাহেব জোর করে তৃষাকে বিয়ে দিচ্ছেন। একটি বারের জন্যেও তিনি তৃষার মনের অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করছেন না। ওনার একটাই কথা, ২৫ শে মে যে করেই হোক, তিনি রাতুল রাহমান আর তৃষা সরকারের বিয়েটা দেবেনই।


________________________________



" ভাই, আমি তো তোমাদের কথা সব কথা শুনেছি, যা করতে বলেছো, তাই করেছি.. এইবার প্লিজ, প্লিজ তোমরা আমাকে ছেড়ে দাও। প্লিজ.....!" কাকুতি মিনতি করে লোকগুলোকে কথাগুলো বলল আয়ান।

" এই চুপ, একদম চুপ। যদি আর একটা কথাও তুই বলেছিস, তাহলে তোকে এখানে জিন্দা কবর দিয়ে দেব,, বুঝেছিস। আচ্ছা তোকে একটা কথা আর কতবার বলবো যে, এখান থেকে তুই আর কোনোদিনও মুক্তি পাবি না, যদ্দিন বেঁচে থাকবি ততদিন এখানেই বন্দি হয়ে থাকতে হবে তোকে। তাও এত ছেড়ে দাও ছেড়ে দাও করছিস কেন তুই! মরতে চাস নাকি!! দাঁড়া, বড় স্যারকে ফোন করে আমি বলছি, মরার খুব ইচ্ছে হচ্ছে নাকি তোর? দাঁড়া, তোর মরার ইচ্ছে আমি পূরণ করছি। তারপর উনি তোকে মজা দেখাবেন।" বেশ চড়া গলায় চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথাগুলো বললো একটা লোক। লোকটার চোখ থেকে যেন আগুন ঝরছে, যেভাবে আয়ানের দিকে তিনি তাকিয়ে আছে, মনে হচ্ছে এই বুঝি আয়ানকে চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। খানিকক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আয়ানের দিকে তাকিয়ে থেকে লোকটা নিজের প্যান্টের পকেট থেকে তার ফোনটা বের করলো। ফোনের লক খুলে নম্বর লিস্টে গিয়ে গিয়ে সাহিদ সাহেবের নম্বর টা বের করে কল দিলো। খানিকক্ষণ রিং হবার পর সাহিদ সাহেব কলটা রিসিভ করলেন। কলটা রিসিভ করলে লোকটা সাহিদ সাহেবকে সালাম দিয়ে যতটা সম্ভব মাথা ঠান্ডা করে তারপর বলতে লাগল... " স্যার, এই ছেলেটা তো খুব বাড়াবাড়ি করছে। বলছে, ও আমাদের কথা অনুযায়ী সব কাজ করে ফেলেছে। এবার নাকি মুক্তি দিতে হবে তাকে।"

" তো মুক্তি দিয়ে দাও, কে বাঁধা দিয়েছে তোমায়!"

" কি বলছেন স্যার, ওকে মুক্তি দিয়ে দিলে তো, খেলাই শেষ হয়ে যাবে!"

" যদি খুন করে নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে মুক্তি দেওয়া যায়, তবুও কি খেলা শেষ হয়ে যাবে রানা।"

" মানে!"

" মানে, তোমার কাছে যে রিভলবার টা আছে, সেটা দিয়ে আয়ানকে গুলি করে মেরে ফেলো। আজ যখন রাত হবে তখন তাকে নদীর জলে ভাসিয়ে দেবে। বুঝতে পেরেছো তো আমার কথা।"

" ওহ্,, আচ্ছা ঠিক আছে.. স্যার। কাজ হয়ে যাবে। তবে স্যার, একটু মাল কড়ি দিলে ভালো হয়। বউ বায়না ধরেছে, ওকে এক জোড়া সোনার চুড়ি কিনে দিতে হবে।"

" আচ্ছা ঠিক আছে। তৃষার বিয়েটা মিটে যাক, তারপর নিও। এখন তুমি নিজের কাজটা সম্পন্ন করো।"

এই বলে ফোনটা কেটে দিলেন সাহিদ সাহেব। উনি ফোনটা কেটে দিলে লোকটা অর্থাৎ রানা আবার আয়ানের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। এতে খানিকটা ভয় পেয়ে গেল আয়ান।
কি বললেন তুষার সরকার? কিছুই তো শুনতে পায় নি সে! তাই মনে মনে ভাবতে লাগলো কি বললেন উনি যে লোকটা তার দিকে এতটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে!!

আরো খানিকটা সময় আয়ানের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে রানা নিজের অন্য পকেট টা থেকে রিভলবার টা বের করে আয়ানের দিকে তাক করলো। তাতে আরো ভীষণ ভয় পেয়ে গেল আয়ান। কাঁপতে কাঁপতে মনে মনে বলল... " কি.. কি.. কি করতে চাচ্ছে লোকটা?"


______________________________



সরকার বাড়ির সামনে এসে গাড়িটা ব্রেক করলো। গাড়ি থেকে নামলো পোস্ট ম্যানের সাজে একজন লোক। সে গাড়ি থেকে নেমেই কাউকে কল দিল। ওপাশের ব্যাক্তি কল টা রিসিভ করলে সে বলল... " স্যার, আপনার বাড়ির সামনে চলে এসেছি। দারোয়ানকে বলে রেখেছেন তো, আমার ঢোকার কথা!"

ওপাশের ব্যাক্তি অর্থাৎ সাহিদ সাহেব উৎসুক স্বরে বললেন... " হ্যাঁ, হ্যাঁ,, তোমায় দেখলেই দারোয়ান ভেতরে যেতে দেবে।"

" ওহ্, আচ্ছা। ঠিক আছে স্যার। আমি তাহলে ভেতরে যাচ্ছি।"

ফোনটা কেটে দিয়ে পোস্ট ম্যান সাজে সাজা লোকটা বাড়ির মেইন গেটে নক করতে লাগলো। মেইন গেইটের ছোট্ট দরজাটা খুলল দারোয়ান‌। গম্ভীর গলায় বলল... " ওহ্,, আপনি চলে এসেছেন। আসুন, ভেতরে আসুন।"

ভেতরে যাওয়ার পারমিশন পেয়ে মেইন দরজা টা অতিক্রম করে সোজা রাস্তা টা ধরে লোকটা সদর দরজার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল পোস্ট ম্যান সাজে সজ্জিত লোক টা।


______________________________



" ভেসে এসেছি ঢেউয়ের তালে
  স্বপ্নেরা চোখে কথা বলে
  তোমায় ছুঁতে চায় এ মন!
  অজানা দেশের ক্যানভাসে
  একা আমি বসে আছি তীরে
  সন্ধ্যা নামে দিগন্তে
  অপেক্ষাতে থাকবো কত...?
  অবশেষে এসো ফিরে! "


নিজের ফোনে গান টা শুনছে তৃষা। আয়ান নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে সে দিনে সর্বনিম্ন হলেও চার-পাঁচ বার শোনে এই গানটা। তার মন খুব ভালো হয়ে যায়, যখন তার কানে এই গানটা বাজতে থাকে।
বর্তমান সে গান টা শুনছে ডাইনিং টেবিলে বসে খেতে খেতে। হঠাৎ কলিং বেল টা বেজে উঠলো। তৃষা খানিকটা বিরক্ত হয়ে হাত টা ধুয়ে সোজা চলে গেল সদর দরজার দিকে। দরজাটা খুলতেই সে দেখলো, একজন পোস্ট ম্যান দাঁড়িয়ে। কিছুটা অবাক হয়ে সে ওনাকে জিজ্ঞেস করলো... " কী চাই!"

" আপা, এখানে তৃষা সরকার নামে কে আছেন!" গম্ভীর গলায় কথাটা বলল লোকটা।

" জ্বী, আমিই তৃষা সরকার।"

" ওহ্ আচ্ছা, আপনার নামে একটা চিঠি এসেছে।" তৃষার দিকে চিঠি টা এগিয়ে দিয়ে কথাটা বলল লোকটা।

" কে পাঠিয়েছে?"

" আপনিই নাহয় দেখে নিন। আমার এখন একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। আমি নাহয় গেলাম।"

এই বলে লোক টা তৃষাকে আর কোনো কথা বলতে না দিয়ে তাড়াহুড়ো করে সেখান থেকে চলে যেতে লাগলো। তৃষা লোকটাকে ডাকতে চেয়েও কেন জানি আর ডাকলো না। সদর দরজাটা বন্ধ করে ভেতর থেকে লক করে দিয়ে আবার ডাইনিং টেবিলের দিকে ফিরে যেতে চাইলো সে। কিন্তু, কেন জানি আর খেতে ইচ্ছে করছে না। কে চিঠি পাঠিয়েছে, আর কি'ই বা লেখা আছে তাতে! জানার জন্য খুব এক্সাইটেড তৃষা।

হাতে চিঠি টা নিয়ে একটা একটা করে সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরতলার দিকে যেতে লাগলো তৃষা। ওপরতলায় উঠে সোজা নিজের রুমের দিকে এগিয়ে গেলো সে। দরজা টা ভেতর থেকে লক করে দিয়ে বিছানায় গিয়ে উপুড় হয়ে শুলো তৃষা।


To Be Continued..................
98 Views
12 Likes
5 Comments
5.0 Rating
Rate this: