সিউলের বসন্তকাল। চারপাশে ছড়িয়ে আছে চেরি ব্লসমের রঙিন ছোঁয়া, বাতাসে হালকা গন্ধ। সেই গন্ধের মাঝেই হাঁটছিল জিসা, ধীরে ধীরে, যেন হাঁটতে হাঁটতে হারিয়ে যেতে চায় কোথাও। একসময় হাতটা গেল কোটের পকেটে—একটা পুরনো ট্রেন টিকিট এখনো সে নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। ছয় বছর আগের সেই দিনটার টিকিট। যে দিন সে প্রথম ফাহিমকে ভালোবেসেছিল, এবং হারিয়েও ফেলেছিল।
জিসা একজন শিল্পী। সে জলরঙে মানুষের মুখ আঁকে। কিন্তু গত তিন বছর ধরে সে আর কোনো মুখ আঁকে না। শুধু আঁকে কুয়াশা ঢাকা পাহাড়, অন্ধকার ট্রেনস্টেশন, কিংবা এমন কিছু যা মানুষের ভেতরের শূন্যতা তুলে ধরে। তার ছাত্ররা ভাবে, সে হয়তো ডিপ্রেশনে আছে। কিন্তু কেউ জানে না, এই একাকীত্বের ভেতর সে একজন মানুষকে প্রতিদিন খুঁজে ফেরে—ফাহিমকে।
ফাহিম দক্ষিণ কোরিয়ায় পড়তে এসেছিল বিদেশি শিক্ষার্থী হিসেবে। তারা দেখা করেছিল ইউনিভার্সিটির এক্সিবিশনে। জিসার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে ফাহিম বলেছিল,
"তুমি কষ্টের রং জানো, তাই ছবিতে এত গভীরতা।"
সেই এক বাক্যেই তারা কাছাকাছি এসেছিল।
তাদের সম্পর্ক ছিল সাদামাটা, কিন্তু গভীর। কফির কাপে ভাগাভাগি করে খাওয়া কেক, বৃষ্টির রাতে ছাতা ছাড়াই হাঁটতে হাঁটতে গান গাওয়া, কিংবা সন্ধ্যাবেলায় নদীর পাশে বসে গল্প বলা—এই সবকিছুর মাঝেই গড়ে উঠেছিল এক অদৃশ্য বন্ধন।
কিন্তু ঠিক ছয় বছর আগে, এক সকালে ফাহিম হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যায়। কোনো ফোন, কোনো চিঠি, কোনো মেসেজও না। জিসা প্রথমে ভেবেছিল, ফাহিম হয়তো রাগ করেছে। কিন্তু দিন পেরোতে পেরোতেই স্পষ্ট হয়, সে ফিরে আসবে না। তার ডিপার্চার তারিখের ট্রেন টিকিটটাও জিসা খুঁজে পেয়েছিল ফাহিমের ঘরের টেবিলের ওপর।
“আমি তোর জীবন থেকে চলে গেলাম, কারণ তোর পাশে আমি বোঝা ছিলাম।”
এই লাইনটা লেখা ছিল এক কাগজে।
জিসা বহুবার ফাহিমকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। কাউকে ভালোবাসার চেষ্টা করেছে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার হৃদয় একবারই স্পন্দিত হয়েছিল—ফাহিমের জন্য।
এইভাবে কেটে গেছে ছয়টা বছর।
এবং ঠিক আজ, সেই একই ট্রেনস্টেশনে, যেখানে তারা প্রথম একসঙ্গে চেরি ব্লসম দেখতে গিয়েছিল, হঠাৎ জিসা একজনকে দেখতে পেল—
একটা কফি কাপ হাতে, তাকিয়ে আছে স্টেশনের এক কোণে।
ফাহিম।
তার চোখে কিছুটা অপরাধবোধ, কিছুটা আশা, কিছুটা অবিশ্বাস। জিসা প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারছিল না।
সে এগিয়ে গেল ধীরে ধীরে।
ফাহিম কিছু না বলেই কফির কাপটা বাড়িয়ে দিল।
একটাও শব্দ নেই। চারপাশে শুধু ট্রেনের শব্দ, আর হালকা বাতাসে উড়ে যাওয়া চেরি ব্লসম।
জিসা ফিসফিস করে বলল:
“তুমি কেন গেলে?”
ফাহিমের উত্তর:
“কারণ আমি জানতাম, তোমার জীবনে আমার মতো একজন থাকার মানে তুমি তোমার স্বপ্ন ছেড়ে দেবে। আমি তোমার উড়ে যাওয়া ডানা ভেঙে দিতে চাইনি। তাই নিজে থেকেই সরে গিয়েছিলাম।”
জিসার চোখ ঝাপসা হয়ে গেল।
সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ফাহিমের চোখে। তারপর বলল,
“তুমি জানো না, আমি ডানা ছিঁড়ে ফেলে শুধুই তোমার সঙ্গে হাঁটতে চেয়েছিলাম। তুমি উড়তে চাওনি, কিন্তু আমিও আর উড়িনি।”
দু’জনের মাঝখানে নীরবতা। অনেক দীর্ঘ, অনেক ভারী।
তারপর জিসা বলল,
“এখন তুমি কী চাও?”
ফাহিম বলল:
“তুমি যদি চাও, আবার শুরু করতে পারি। যদি না চাও, চিরতরে বিদায় নেব। তবে আজ শুধু শেষবারের মতো তোমার মুখটা দেখতে এসেছিলাম। একবার চোখে চোখ রাখলে, হয়তো তোমার ক্ষমা পেয়ে যাব।”
জিসা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর কফির কাপটা হাতে নিল।
এক চুমুক খেয়ে বলল,
“এই কফিটার স্বাদ আজও এক রকম, যেমনটা ছিল ছয় বছর আগে। আর তুমিও ঠিক আগের মতোই — একবার ভালোবাসলে আর কাউকে ভালোবাসতে পারো না।”
“আর আমি?”
“তোমার মতো আমিও বদলাইনি।”
দুজন আবার পাশাপাশি হাঁটতে লাগল।
চেরি ব্লসমের পাতারা তাদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে।
সময় যেন থেমে গেছে কিছুক্ষণের জন্য।
সমাপ্ত.......................................
তুমি যখন চলে গেলে
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
53
Views
7
Likes
0
Comments
0.0
Rating