পুনর্মিলন হবে না আর

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
রাজধানীর ব্যস্ত সড়ক পেরিয়ে পুরনো ধুলোমাখা বইয়ের দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল আরিব। চোখে পুরনো চশমা, হাতে পুরনো একটা চিঠি। বইয়ের দোকানটার নাম “কালবেলা”—যেন একটুখানি অতীতকে ধরে রাখে। এই জায়গাটাতেই প্রথমবার দেখা হয়েছিল ওদের। সাত বছর আগে।

আরিব তখন সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। টিউশনি করে চলে নিজের খরচ, স্বপ্ন দেখে লেখক হবে একদিন। আর মেয়েটি—নাম নাভিলা। উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়ে, চুলে সবসময় একটা ছোট ক্লিপ, ঠোঁটে হালকা হাসি। সে এসেছিল ‘কালবেলা’য় জীবনানন্দের কবিতা খুঁজতে। আরিব তাকিয়ে ছিল দূর থেকে, অবাক হয়ে। একটা কবিতার বই নিয়েই শুরু হয় কথাবার্তা, আর এরপর শুরু হয় পরিচয়, আড্ডা, একসাথে কফি খাওয়া, ঘোরাঘুরি আর ভালোবাসার নীরব প্রকাশ।

তবে ওদের গল্পটা কখনোই ঠিকভাবে বলা হয়নি কারও কাছে।
তাদের প্রেমে ছিল চুপিচুপি হাত ধরা, লাইব্রেরির এক কোণায় পাশাপাশি বসে বই পড়া, শহরের ভীড় থেকে দূরে ছাদে বসে চাঁদ দেখা। সবই ছিল, কিন্তু ছিল না সমাজের অনুমতি।

নাভিলার বাবা ছিলেন প্রভাবশালী একজন মানুষ। ধনী, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। আরিবকে তিনি কখনোই পছন্দ করেননি।
“একটা মধ্যবিত্ত ছেলে আমাদের পরিবারের মেয়ের উপযুক্ত হতে পারে না,”—সরাসরি বলে দিয়েছিলেন।
নাভিলা তখন অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, “বাবা, তুমি কি ওর চোখে কখনো তাকিয়ে দেখেছো? তার স্বপ্নগুলোকে চিনতে পেরেছো?”
কিন্তু বাস্তব বড় নির্মম।
নাভিলাকে বাধ্য করা হয় বিয়েতে। পরিবারের চাপে, মায়ের কান্নায়, সমাজের ভয় দেখিয়ে।
আরিব তখন ঢাকা ছেড়ে চলে যায়। শহর, স্মৃতি, বইয়ের দোকান—সব ফেলে। কারো সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি। একেবারে হারিয়ে যায়।

আর নাভিলা...?

সে হয়তো তার স্বপ্নহীন জীবনে বেঁচে ছিল, কিন্তু বাঁচেনি।
আরিব ফিরে এসেছিল আজ সাত বছর পর। “কালবেলা”য় এসে দাঁড়িয়েছিল, কারণ খবর পেয়েছে—নাভিলা এখন এই শহরেই আছে, বিবাহিত, কিন্তু আলাদা থাকে, সন্তানের কাস্টডি নিয়েও কোর্ট-কাচারিতে লড়ছে।

হঠাৎ দোকানের দরজার ঘণ্টা বেজে উঠলো।
আরিব মুখ তুলে তাকালো।
নাভিলা।

চোখে একই সেই ক্লিপ, ঠোঁটে কোনো হাসি নেই। চোখে গভীর ক্লান্তি।

দুজনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। কেউ কিছু বললো না। সময় যেন থমকে গেলো।

তারপর নাভিলা আস্তে বললো, “তুমি কেন এসেছো?”

আরিব হেসে বলল, “শুধু জানতে চেয়েছিলাম... তুমি ভালো আছো কিনা।”

নাভিলা বলল, “ভালো? কেউ যখন কাউকে ছাড়তে বাধ্য হয়, তখন ভালো থাকা আর না থাকা—দুটোই খুব ফাঁপা হয়ে যায়। আমি শুধু... বেঁচে আছি।”

আরিব বলল, “আমিও... শুধু বেঁচে আছি।”

হঠাৎ তারা দুজন একসঙ্গে হাসলো। সেই পুরনো কষ্টের হাসি, যা কাঁদাতে জানে।

আরিব চিঠিটা বাড়িয়ে দিলো।

“এটা সেই সময়ের জন্য লেখা, যখন আমরা কথা বলতে পারিনি।”

নাভিলা চিঠিটা নিলো, পড়লো না।

“আমাদের গল্পটা কি এখানেই শেষ?”

নাভিলা মাথা নেড়ে বললো, “না, শেষ তো অনেক আগেই হয়ে গেছে। এখন শুধু স্মৃতির ধুলো ঝাড়ার সময়। পুনর্মিলন হবে না আর।”

আরিব আর কিছু বললো না। ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলো শহরের ভিড়ে মিশে যেতে।

নাভিলা দাঁড়িয়ে রইলো, হাতে চিঠি নিয়ে।

চোখের কোণ বেয়ে একটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো—হয়তো সেটা ছিল শেষ ভালোবাসার চিহ্ন।
67 Views
9 Likes
0 Comments
5.0 Rating
Rate this: