৫১.
ব্যস্ত শহরটির অন্ধকার দূর করে ভোরের আলো ফুটেছে। সকাল সকাল আখি অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে ঘর থেকে বের হলে তার কানে টিভিতে নিউজ বলার শব্দ আসে।
- আজকে ঢাকার *****তে কয়েকজন যুবকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। (নিউজ প্রেজেন্টর)
আখি সেটা শুনতেই টিভির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। আর সেখানে চোখ পড়তেই তার চোখ বড়বড় হয়ে যায়। সে কোনো এক ঘোরের মধ্য দিয়ে সেদিকে এগোতে থাকে।
- গত রাতেই খুন হয়েছে এই যুবকেরা। খুবই নৃশংসতার সাথে তাদেরকে মারা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এদের মধ্যে একজনকে প্রথমে দুইহাত কেটে তারপর মাথায় কোনো শক্ত কিছু দিয়ে আঘাত করা হয় তাকে। আর তাতেই তার মাথার ঘিলু পর্যন্ত বেরিয়ে যায়। সেখানেই মৃত্যু হয় এই যুবকের। তবে মৃত্যুকালে সে মদ্যপ ছিলো বলে রিপোর্টে জানা গিয়েছে। কে বা কারা আর কেনই বা এই খুন করেছে সেটির কোনো কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছেনা পুলিশ। বিস্তারিত জানতে চোখ রাখুন। (নিউজ প্রেজেন্টর)
- দেখেছিস মা, কি হচ্ছে এসব শহরে। (আখির বাবা)
- হু? (আখি যেন অন্য ধ্যানে ছিলো)
- কিছু হয়েছে তোর? (আখির বাবা ভ্রূ-কূঞ্চিত করে)
- না বাবা, কিছু না। আমি আসছি। (আখি)
আখি ব্যাগটি কাধে তুলে নিলো। আরেকবার তাকালো টিভির দিকে। কেন জানিনা তার মনে হচ্ছে এই লোকটা গতরাতের সেই নেশাগ্রস্ত অসভ্য ছেলেটি। কিন্তু তার চোখমুখের অবস্থা ভালো নেই দেখে নিশ্চিত হতে পারছে না সে।
৫২.
অফিসে এসেই নিত্যদিনের অভ্যেসমতো প্রথমেই নিজের প্রিয় বেস্টফ্রেন্ডের কাছে গেলো সে। এসে দেখে দিনা গালে হাত দিয়ে বসে আছে।
- কীরে, তোকে দেখে tranced মনে হচ্ছে। (আখি)
- হুম। রিজেগনেশন লেটারটা সাবমিট করবো কিনা ভাবছি। (দিনা)
- কেন, ভাবাভাবির কি আছে? কালকেই তো decide করলাম আমরা লেটারটা দিয়ে দেবো। (আখি)
- থাক না আখি। আগে কিছুদিন দেখি। কিছুদিন পর ওদের রাগ এমনিই পড়ে যাবে। এজন্য রিজেগনেশন নেয়ার দরকার আছে? আর ভেবে দেখ, এখন অফিস ছেড়ে দিলে নতুন চাকরি কোথায় পাবো? আমার ফ্যামিলির অবস্থাও ভালো নয়। বাবার অসুস্থতা দিনদিন বেড়েই চলেছে। এখন চাকরি ছেড়ে দিলে বাবার চিকিৎসা করাবো কি করে? (দিনা)
- তোর তো রিজেগনেশন নেওয়ার দরকার নেই। তুই আহামরি কিছু করিসনি। শুধু দীপ্ত স্যারকে উল্টোপাল্টা কয়েকটা কথা বলেছিস। কিন্তু আমি যা করেছি, তার জন্য মনে হয় না মাতালটা আমায় এত সহজে ছেড়ে দেবে। এক কাজ কর, আংকেল যেহেতু অসুস্থ, তুই রিজেগনেশন নিস না। কিছুদিন দেখ। তারপর যদি তোর মনে হয় তোর সেটা দরকার তাহলে নিস। (আখি)
-হুম। কিন্তু তোকে ছাড়া অফিসে.... (দিনা)
- আরে ওসব ব্যপার না। কয়েকদিন পর এমনি অভ্যাস হয়ে যাবে। (আখি)
৫৩.
- May I come in? (আখি)
- Yes. (মাহির)
সম্মতি পেয়ে আখি মাহিরের কেবিনের কাঁচের দরজা ঠেলে কেবিনে প্রবেশ করলো।
- গতকাল যে কাজগুলো করতে দিয়েছিলাম সেগুলো হয়েছে? (মাহির)
- পুরোটা হয়নি। (আখি)
মাহির একটি ফাইলের পাতা উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে দেখছিলো। দৃঢ় ও আত্নবিশ্বাসী ভঙ্গিতে বলা আখির কথায় তার হাত থেমে যায়। কাগজে নিবদ্ধ করে রাখা ভয়ংকর শীতল দৃষ্টিটা সে আখির ওপর নিক্ষেপ করলো। যা দেখে একমুহূর্তের জন্যে আখির বুকের পানি শুকিয়ে গেলেও আখি নিজের চেহারা আগের মতো করে রাখে। মাহির গম্ভীর অথচ রাগত স্বরে বলে-
- মানে? (মাহির)
- মানে আমি পুরোটা করিনি। (আখি)
- কেনো? আমি তোমাকে পুরোটা করতে বলিনি? (মাহির)
- আমি পুরোট কমপ্লিট করার প্রয়োজন মনে করিনি। (আখি)
- তুমি জানো এজন্য তোমার কি শাস্তি হতে পারে? (মাহির)
- আমি তো আপনার অফিসে কাজ করবোই না, তাহলে আপনার শাস্তি কেন গ্রহণ করবো? (আখি তাচ্ছিল্যের স্বরে)
- মানে? (মাহির ভ্রূ কূচকে)
- মানে? মানে এই যে রিজেগনেশন লেটার। আমি অফিস থেকে রিজেগনেশন নিচ্ছি। (আখি)
আখি বেশ খুশি মুখে মাহিরের দিকে রিজেগনেশন লেটারটি তুলে ধরলো। তার মুখে রয়েছে এক বিজয়ের হাসি। আজ সে রিজেগনেশন নিতে পারলেই জিতে যাবে।
মাহির একবার আখির দিকে গম্ভীরভাবে তাকালো। তারপর আখির হাত থেকে খপ করে লেটারটি নিয়ে কোনো দিকে না তাকিয়ে আখির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে লেটারটি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেললো। আখির মুখের হাসি নিমেষে কর্পূরের মতো গায়েব হয়ে গেলো। সে হন্তদন্ত হয়ে বললো-
- এই.. এই...কি করছেন আপনি। ওটা ছিঁড়ছেন কেনো? (রাগত স্বরে) আপনি এটা করতে পারেন না। (আখি)
- (বাঁকা হেসে) আমি কি করতে পারি না পারি, তা সম্পর্কে তোমার এখনও বিন্দুমাত্র ধারণাও হয়নি, মিস আখি ইয়াসমিন। (মাহির)
- আপনি এটা ঠিক করছেন না। কেউ রিজেগনেশন চাইলে তাকে সেটা দেয়া বাধ্যতামূলক। (আখি)
- তাই নাকি? তাহলে আমিও CEO. বাধ্যতামূলক বলতে আমার জন্য কিছু নেই। (মাহির)
- আমি আপনার বাবার কাছে যাবো। (আখি)
- তুমি ঐ আমাদের বাড়ির গেইট পর্যন্তই যেতে পারবে। ভেতরে আর ঢুকতে পারবে না। যে-সে আমাদের বাড়িতে যেতে পারে না। (মাহির)
- আপনি....... (আখি)
- গলা নামিয়ে কথা বলো। Don't forget that I'm your boss and you're my P.A. আর তুমি কি ভেবেছিলে, আমি লেটারটা যদি নাও ছিঁড়তাম, আমি ওখানে সাইন করে দিতাম। এত সোজা? আমি তো এত সহজে তোমায় মুক্তি দিচ্ছি না মিস.আখি ইয়াসমিন। কি কি করেছো সব ভুলে গেছ? যা যা করেছ, সব সুদে-আসলে মিটিয়ে নেবো। আর কাজ কমপ্লিট করোনি তাই না? আজকে এর ডাবল কাজ আমি তোমাকে দিয়ে করাবো। আর বেশি তিরিং বিরিং করলে আমি সবাইকে বলে দেবো তুমি এতদিন আমার নকল গার্লফ্রেন্ড সেজে ছিলে even এখনও আছো। অফিস থেকে তো বের হতে পারবে না। তাই আমার কথার নড়চড় করলে অফিসেও তোমার মান-সম্মান যাবে, কাজও করতে হবে। তাই যদি বুদ্ধিমতি হয়ে থাকো, যা যা বলবো, তাই তাই করবে। বুঝেছো? এখন যাও ফাইলগুলো নিয়ে এসো। আর এখানে, আমার চোখের সামনে বসে বাকি কাজগুলো করো। (মাহির)
মাহিরের কথায় আখি একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। চারপাশে যেন অদৃশ্য জালের মতো এক অদ্ভুত ফাঁদ বিস্তৃত, যার প্রতিটি পথে বিপদের সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। মাহির রওশন কী, তা আজ যেন রক্তে-মজ্জায় টের পাচ্ছে সে। যেদিকেই পা বাড়াক না কেন, দিনরাত এক করে দিনশেষে তাকে মাহিরের কাছে সমর্পণ করতেই হবে।
তবে, এত কিছু সহ্য করে যদি শেষপর্যন্ত মর্যাদাটুকুও হারাতে হয়, তবে কি লাভ? সম্মান আর আত্মসম্মান যখন এমন সূক্ষ্ম সীমানায় দাঁড়িয়ে, তখন প্রতিরোধ না করে আপাতত মাথা নোয়ানোই বুদ্ধিমানের কাজ—এই উপলব্ধি তাকে একপ্রকার মেনে নিতে বাধ্য করল পরিস্থিতিকে। তাই না চাইলেও ঠোঁটে টেনে আনলো এক কৃত্রিম, ম্লান হাসি।
- স্যার, আমি আমার কেবিনে কাজগুলো করি? (আখি)
- কি বললাম শোনোনি? (মাহির)
- শয়তান একটা, আমার কেবিনে থাকলে এই মাতালটাকে আচ্ছামতো গালি দিতে পারতাম। এখানে সেটাও পারবো না। আবার দেখছি আমায় ব্ল্যাকমেইল করছে। কোনদিকে যাবো আমি? ধূর, ভাল্লাগে না। (আখি বিড়বিড় করে)
- এখানে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় না করে ফাইলগুলো নিয়ে এসো যাও। নাহলে.... (মাহির)
- Yes sir, আনছি। (আখি)
আখি গজগজ করতে করতে গিয়ে ফাইলগুলো নিয়ে এলো। মাহিরের কেবিনে সোফায় বসে সে কাজ করতে শুরু করল। মাহিরও নিজের ল্যাপটপে কাজ করছে। তবে পূর্বের দিনের মতো মাঝে মাঝে আড়চোখে আখির দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু আখি কাজে এতটাই ডুবে আছে যে সে আজও সেটা টের পাচ্ছে না।
আখি কাজ করতে করতে বুঝতেই পারেনি যে কখন সময় পেরিয়ে গেছে। হঠাৎ ঘড়ির দিকে চোখ যেতেই সে দেখলো ইতিমধ্যে 2:05 বেজে গেছে। মানে এখন লাঞ্চ টাইম। মাহিরের দিকে তাকিয়ে দেখলো মাহির একমনে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে আছে। কি গম্ভীর চেহারা এই পুরুষের!! মনে হচ্ছে জগৎের সমস্ত গাম্ভীর্য তার চেহারায় এসে ভর করেছে। আর তার এই গাম্ভীর্যইতাকে আকর্ষণীয় করে তোলে বারবার। চোয়ালের রেখায় একধরনের কঠোরতা, চোখে স্থির অথচ গভীর দৃষ্টির সঞ্চার, ভ্রু দুটি যেন চিন্তার ভারে সামান্য কুঁচকে আছে। তার মুখের প্রতিটি রেখা যেন শৃঙ্খলাপূর্ণ, অথচ সহজাত এক রাজকীয় শীতলতা নিয়ে বসে আছে সে নিজের ভুবনে। চুলের ওপর পড়া নরম আলো তাকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে। মনে হয়, সময় যেন একটু থেমে গেছে তার চারপাশে। আখির মনে হলো, এ চেহারায় কেবল রূপ নেই। আছে এক ধরণের প্রখর বুদ্ধিমত্তা, শাসনের ঔদ্ধত্য, আর এমন কিছু অলিখিত আধিপত্য যা জড়িয়ে ধরে মানুষকে। মাহিরকে যে অফিসের প্রতিটা মেয়ে কেন চোখ দিয়ে গিলে খায়, তার কারণ আখি আজ বুঝলো। তার মনে হলো সেটা অবান্তর নয়। সত্যি না হলেও এই সুদর্শন যুবক সবার কাছে তার ভালোবাসার মানুষ হিসেবে স্বীকৃত ভাবতেই তার কপোলে লাল আভা ছড়িয়ে পড়লো। নিচের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসলো সে।
হঠাৎ কি মনে হতেই আখি সেই ভাবনা থেকে সরে এলো। আশ্চর্য কান্ড! যেই লোকটা তাকে কিছুক্ষণ আগেও বকাবকি করলো, সেই লোকটার সম্পর্কে এসব চিন্তাভাবনা কোথা থেকে আসছে তার? সে শুধু আখির অপছন্দনীয় হওয়ার যোগ্য। তাই নিজেকে সংযত করে সে নকল কাশি দিলো।
- অহুম...... অহুম...... (আখি)
মাহির আখির দিকে তাকালো। ভ্র নাচিয়ে বললো-
- কি হয়েছে। (মাহির)
- লাঞ্চ টাইম। (আখি)
- কিহ্? (মাহির)
- মানে স্যার, লাঞ্চ টাইম শুরু হয়ে গেছে। আমি একটু কিছু খেয়ে আসি? (আখি)
- না, যাও আমার জন্য এককাপ কফি নিয়ে এসো। (মাহির)
- অ্যাঁ? আমি কেন আপনার কফি আনতে যাবো? তপু আছে। তপুকে বলুন। (আখি গা ছাড়া ভাব নিয়ে বললো)
- আমি কি তপুকে বলেছি? (মাহির গম্ভীর হয়ে)
- আমার কাজ কি আপনার জন্য কফি নিয়ে আসা? দেখুন, আমি আপনার পিএ। আমি আপনাকে হেল্প করবো। প্রয়োজনে আপনার অফিসিয়াল যেসব কাজ করতে বলবেন, তার বাইরেও সমস্ত কাজ করে দেবো। কিন্তু তাই বলে.... (আখি)
- তুমি কি চাচ্ছো, যে আমি সবাইকে বলে দিই তুমি এতদিন আমার নকল গার্লফ্রেন্ড সেজে ছিলে? (মাহির)
- (মেকি হাসি দিয়ে) হে, হে, আমি আনছি তো আপনার জন্য কফি। এমন করেন কেন? (আখি)
- তাড়াতাড়ি যাও। আর দাঁত দেখানো বন্ধ করো। (মাহির)
৫৪.
দীপ্ত দিনাকে তার কেবিনে ডাকায় দিনা তার কেবিনে গিয়ে উপস্থিত হয়। স্বাভাবিকভাবে বলে -
- আমায় ডেকেছেন স্যার? (দিনা)
- হুম, কোথায় ছিলে সকাল থেকে? (দীপ্ত)
- আখি ম্যাম কিছু কাজ দিয়েছিলেন সেগুলো করছিলাম। আসলে উনি সকাল থেকে CEO sir এর সাথে কাজ করছেন। আর আমার আজ তেমন কাজ নেই। তাই ওনার কাজগুলো আমি করে দিচ্ছি। (দিনা)
- তোমাকে কে বললো তোমার কোনো কাজ নেই? (দীপ্ত)
- আজকে schedule অনুযায়ী আমার তো কোন অফিসিয়াল কাজ নেই। তাই......... (দিনা)
- আমার সকাল থেকে মাথাটা ব্যথা করছে। আমার মাথাটা টিপে দাও। (দীপ্ত)
- অ্যাঁ.... (দিনা অবাক ভঙ্গিতে)
- অবাক হওয়ার কি আছে? তুমি আমার পিএ, আমি যা বলবো সেটা তোমাকে করতে হবে। (দীপ্ত)
- কিন্তু স্যার, এটা তো অফিসিয়াল কোনো কাজ নয়। (দিনা)
- কাজ কি শুধু অফিসিয়ালই হয়? নাও, এখন কথা না বাড়িয়ে আমার মাথাটা টিপে দাও। (দীপ্ত)
দিনা আর কি করবে, সে দীপ্তর কথামতো দীপ্তর কাছে গিয়ে তার মাথা টিপে দিতে থাকে।
- বাহ্, মাথাটা তো ভালো massage করে দিতে পারো। এখন থেকে আমার মাথা ব্যথা হলে তোমাকেই এই কাজ দেবো। তাহলে তোমাকেও আর বসে থাকতে হবে না। (দীপ্ত)
- শয়তান একটা। ইচ্ছে তো করছে মাথার সাথে সাথে তোর গলাটাও টিপে দিই। (দিনা মনে মনে)
৫৫.
আখি মাত্রই মাহিরের দেয়া সমস্ত কাজ শেষ করে মাহিরের কেবিন থেকে বের হচ্ছে। বের হওয়ার সময় নিশি তার অপরপাশ থেকে এসে তার সামনে দাঁড়ায়। নিশির পরণে ছিলো একটা হাঁটু ওবধি টপস, যাতে তার ফর্সা পা দৃশ্যমান। আর মুখে অবশ্য উগ্র মেকআপ ছিলো।
- আখি ম্যাম, ভালোই তো দিন যাচ্ছে আপনার। সারাক্ষণ স্যারের সাথে থাকছেন। সেই সকালে দেখলাম স্যারের কেবিনে ঢুকছেন, লাঞ্চ টাইমে কফি নিয়ে যাচ্ছেন। আবার এখন বের হচ্ছেন। প্রেমটা বেশ ভালোই হচ্ছে বলুন। (নিশি)
- বাহ্, তুমি তো দেখছি সকাল থেকে কখন কতবার আমি নিঃশ্বাস নিয়েছি সেটাও গুণে রেখেছো। আগে জানলে অফিসে আর এত সিসিটিভি লাগাতেই দিতাম না। তুমি আছো তো। (আখি তাচ্ছিল্য হেসে)
- না,,, মানে ঐ একটু সবার খোঁজখবর রাখি আরকি। (নিশি বিব্রত হয়ে)
- তোমাকে কি সবার ওপর নজর রাখার জন্য রাখা হয়েছে? কিছুূদিন আগে তোমার work schedule দেখলাম। তোমার যতটুকু কাজ করা উচিত তার থেকে অনেক কম কাজ তুমি করছো। এইসব আজেবাজে কাজ না করে যে কাজের জন্য তোমাকে রাখা হয়েছে সেটা করো। CEO sir এর কানে একবার খবরটা গেলে সেটা নিশ্চয়ই তোমার জন্য ভালো হবে না। (আখি)
আখি এই বলে নিশিকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। নিশি গজগজ করতে করতে বললো-
- CEO sir এর গার্লফ্রেন্ড বলে বেশি দেমাগ দেখাচ্ছো তাই না? তোমার এই দেমাগ আমি যদি কিছুদিনের মধ্যে মাটিতে না মেশাতে পেরেছি তাহলে আমার নামও নিশি নয়। (নিশি)
নিশি এই বলে মাহিরের কেবিনে ঢুকে পড়লো। মাহির তখন গভীর মনোযোগ দিয়ে নিজের ল্যাপটপে কাজ করছে। মাহিরের প্রতি আকৃষ্ট মোটামুটি অফিসের সব মেয়েই। তবে নিশির যেন তার প্রতি একটু বেশিই আকর্ষণ রয়েছে। সে সবসময় মাহিরের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে। মাহির নিশির এই ব্যাপারটি লক্ষ্য করেছে। আসার পর থেকে দেখছে সবসময় তার দিকে কেমন অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকে এই মেয়েটা। যা তার প্রচন্ড বিরক্ত ও অসহ্যকর লাগে। তাই নিশিকে তার একটুও পছন্দ নয়।
- স্যার, ফ্যাক্টোরির সব পেপারগুলো... (নিশি)
- এখানে রেখে দিন। (মাহির নিশির দিকে না তাকিয়ে ল্যাপটপে চোখ রেখেই)
- একবারও তো দেখছেও না। এত সেজে এসে লাভ কী হলো? (নিশি মনে মনে)
- স্যার, আমার আর আজকের কোনো কাজ নেই। যদি চান, আমাকে কিছু কাজ দিতে পারেন। আপনার চাপটা কমবে। (নিশি)
মাহির এবার নিশির দিকে তাকালো। তার দৃষ্টি শান্ত কিন্তু কোথাও যেন একটা ক্রোধ দেখা যাচ্ছে সেখানে।
- আমার কাজ আপনি যদি করতে পারতেন তাহলে আমার জায়গায় আপনি থাকতেন। এখন আমায় বিরক্ত না করে কেবিন থেকে যান। (মাহির)
- Okey sir. (নিশি)
নিশি মনে একটি ক্ষোভ নিয়ে মাহিরের কেবিন থেকে বের হলো।
- আমাকে অপমান করলো! ভালো করে তো আমায় দেখলোও না। নাহ্, একে বশ করা এত সহজ হবে না। কিন্তু এখনই তো আমি হাল ছাড়ছি না। (নিশি)
৫৬.
- কিরে, তুই নাকি রিজেগনেশন নিলি, তো এখনো অফিসে আছিস যে? (দিনা আখির কেবিনে ঢুকতে ঢুকতে)
- রিজেগনেশন না কচু, ঐ মাতালটা রিজেগনেশন দেয়া তো দূর, রিজেগনেশন লেটারটা একবার পড়লো পর্যন্ত না। উল্টে লেটারটা ছিঁড়ে ফেললো! আবার বলে কি না, আমি যদি ওনার কথামত কাজ না করি তাহলে নাকি সবাইকে আমার ওনার মিথ্যে গার্লফ্রেন্ড সাজার কথা বলে দেবে! (আখি)
- এতো দেখছি দিনদুপুরে ব্ল্যালমেইল। তাহলে তোকে তো এখন এখানেই কাজ করতে হবে। (দিনা)
- (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) হুম। (আখি)
- নিশিকে দেখলাম তোর সাথে কথা বলতে। কি বলছে ও? (দিনা)
- যতসব আজেবাজে কথা। ওর কথা বাদ দে। অনেক কাজ পড়ে আছে। তপুকে এককাপ কফি পাঠাতে বল তো। (আখি)
- আচ্ছা, আমি পাঠাচ্ছি। তুই কাজ কর। (দিনা)
- হুম। (আখি)
৫৭.
সময়ের স্রোতে কেটে গেছে এক সপ্তাহ। ঘড়ির কাটা জানান দিচ্ছে রাত বাজে নয়টা। অফিস আওয়ার শেষ। পুরো অফিস ইতিমধ্যে ফাঁকা হয়ে গেছে। অফিসে শুধু রয়েছে আখি ও মাহির। দীপ্ত কাজপাগল হলেও মাহিরের মতো কাজপাগল নয়। তাই সে আগেই বাড়ি ফিরে গেছে।
আখির জন্য দুটো পোষ্টে কাজ করা খুব অসুবিধা হয়ে গেছে। মাহিরের দেয়া কাজগুলো সব শেষ করে আবার ম্যানেজিং ডিরেক্টরের কাজ করতে হচ্ছে। কাজের চাপ প্রচুর বেড়ে গেছে। আখি বুঝতে পারছে এটা তার শরীরের ওপর প্রভাব ফেলতে চলেছে। কারণ ছোট থেকে মাথায় অতিরিক্ত চাপ আখি নিতে পারে না। দিনা আখির এই অসুস্হতার বিষয়টি জানে। তাই সে যতদূর সম্ভব আখিকে সাহায্য করে কিন্তু তারও দুটো পোষ্টে কাজ করার জন্য কাজের চাপ আগের তুলনায় বেড়ে গেছে। চাইলেও অতটা সাহায্য করতে পারে না তাকে। আখিকে ঘুরেফিরে অতিরিক্ত চাপ নিতেই হচ্ছে। কিন্তু তার কিছুই করার নেই। অফিসের CEO এর ওপর তো তার হাত নেই।
অফিসের সবাই এখনও জানে সে মাহিরের গার্লফ্রেন্ড। বরং তারা এ বিষয়ে আরো নিশ্চিত হয়েছে। তারা ভাবছে মাহির আখিকে নিজের কাছাকাছি রাখার জন্য তাকে নিজের পিএ করেছে। তাই অফিসের সবার সামনে আখির রেপুটেশন অনেকটা বেড়েছে। কিন্তু সব সমস্যা মাহিরের কেবিনে গিয়ে। মাহির আখিকে দিয়ে এত বেশি খাটাচ্ছে যে অফিসে থাকলে আখির দম নেয়ারও সময় থাকে না। কখনো তো আবার অফিসের কাজ ছাড়াও পার্সোনাল কাজও করায়। যেমন একটু আগে আখিকে মাহিরের পা টিপে দিতে হলো।
মাহির যদি এ ধরনের কোনো কাজ দেয় তাহলে আখি কখনোই প্রথমে রাজি হয় না। প্রথম দুদিন আখি ভয়ে মাহিরের মুখে মুখে কথা বলতে পারতো না। কিন্তু এখন সে আগে তার সাথে তর্ক করে। তবে সেটা বেশিক্ষণ স্হায়ী হয় না। মাহিরের চোখ রাঙনিতে আখি চুপসে যায়। তাতেও যদি কাজ না হয় তাহলে মাহির তাকে ব্ল্যাকমেইল করে। আর সে শুড়শুড় করে মাহিরের কথামতো কাজ করে।
কাজ করতে করতে হঠাৎ মাহিরের ফোন বেজে ওঠে। অঙ্কিতা রওশন ফোন করেছেন। মাহির ফোনটা ধরে বলল-
- হ্যাঁ, আন্টি বলো... (মাহির)
- কটা বাজে দেখ তো। (অঙ্কিতা রওশন)
- নয়টা মনে হয়। (মাহির)
- এতক্ষণ তুই অফিসে কী করছিস? (অঙ্কিতা রওশন)
- কাজ করছি আন্টি। অফিসে কি করবো। (মাহির)
- হয়েছে। আর কাজ করতে হবে না তোমায়। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসো। (অঙ্কিতা রওশন)
- কিন্তু আন্টি...... (মাহির)
- কোনো কিন্তু নয়। আধঘন্টার মধ্যে তোকে আমি বাড়িতে দেখতে চাই। (অঙ্কিতা রওশন)
- ঠিকাছে। আসছি আমি। (মাহির)
- সাবধানে আসবি। (অঙ্কিতা রওশন)
- হুম। (মাহির)
মাহির কান থেকে ফোনটি নামিয়ে সমস্ত ফাইল গোছাতে থাকে। সব ঠিকঠাক হয়ে গেলে মাহির নিজের কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে। তবে সে আখির কেবিনে লাইট জ্বলতে দেখতে পায়। সে ভ্রূ-কূচকে কেবিনের দিকে গেলে দেখে আখি গভীর মনোযোগে এখনও কাজ করছে।
- মিস আখি....... (মাহির)
আখি মাহিরকে দেখে উঠে দাঁড়ায়।
- এখনো বাড়ি যাওনি? (মাহির)
- না স্যার, কিছু কাজ বাকি আছে। (আখি)
- বাকিটা কালকে এসে করবে। আজ বাড়ি যাও। অনেক রাত হয়ে গেছে। (মাহির)
- বাব্বাহ্, এই মাতালটা এত ভালো হল কবে? কাজ ফেলে চলে যেতে বলছে। (আখি মনে মনে)
- কি হলো স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন? যা বললাম তাই করো। ফাইলগুলো ক্লোজ করো। (আখি)
- Okey sir. (আখি)
আখি মাহিরের সাথেই বাইরে বেরিয়ে এলো। মাহির নিজের গাড়ির দিকে এগোচ্ছিলো। আখি মনে মনে বললো -
- একবার জিজ্ঞেসও করলো না আমার লিফ্ট লাগবো কি না? (আখি মনে মনে)
মাহির তখন কি মনে হতে আখির দিকে ঘুরে দাঁড়ালো আর বলল -
- তুমি একা যেতে পারবে? (মাহির)
- হ্যাঁ, স্যার। আপনি যান। (আখি)
- Okey. (মাহির)
মাহির তার গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিলো। আখি তার কান্ডে কিছুটা অবাকই হলো। আরে অপরিচিত বা স্বল্পপরিচিত কেউ কোনো সাহায্য করতে চাইলে কেউ প্রথমবারেই "হ্যাঁ" বলে নাকি? অনিচ্ছা সত্ত্বে অথবা ভদ্রতার খাতিরে হলেও তো "না" বলতে হয়। তাই বলে কি সেটাকে সিরিয়াসলি নিয়ে নিতে হবে?
- আরেকবার বললে কি হতো? আমি ঠিকই গাড়িতে উঠে যেতাম। ধূর, লাজলজ্জা ভুলে প্রথমবারেই হ্যাঁ বলতে হতো। এখন আমায় একা একা যেতে হবে। (আখি মনে মনে বিরক্ত হলো)
মাহিরের গাড়ি ধূলো উড়িয়ে হাইওয়ে ধরে চলে গেলো। তবে আখি সাথে সাথে সেখান থেকে নড়তে পারলো না। গতকালের ঘটনাটি আবার মনে হতেই গলা শুকিয়ে এলো তার। তবে আজকে আখির ভাগ্য আজকে ভালো থাকায় তখন সৌভাগ্যক্রমে সে একটি অটো পেয়ে গেল। তাই তার আর অসুবিধা হলো না।
চলবে..................
কোথাও কি কিছু ঠিক করা দরকার? মানে লেখায় কি কোনো ঘাটতি আছে? যদি থাকে তাহলে আপনাদের থেকে পরামর্শ চাইছি। কাহিনী বাদে যেকোনো কিছু নিয়ে বলতে পারেন। সেটা না হলে একটু বর্ণনামূলকভাবে বলে যান কিছু।
পরিণীতাসক্তি
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
82
Views
4
Likes
2
Comments
4.0
Rating