পরিণীতাসক্তি

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
৪৬.
- M....May I come in sir...... (দিনা ভয়ে ভয়ে দরজায় নক করলো)

- Yes.....


দীপ্তর কেবিনে যাওয়ার আগে আরো একবার নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো দিনা। তারপর সে আস্তে আস্তে কেবিনে প্রবেশ করলো। দীপ্ত তাকে দেখে বললো-

- কি যেন নাম তোমার.... দিন না রাত... (দীপ্ত)

- দিনা... দিনা আমার নাম। (দিনা)

- Yeah, right. দিনা। তো কেউ যেন আমাকে গাঁজাখোর বলেছিলো। (দীপ্ত)

- ক......কে স্যার? (দিনা)

- কে যে,,,,, নামটা মনে আসছে না। তবে মনে হয় দিনা নামের কোনো এক মেয়ে বলেছিলো। আর আমার কেনো জানিনা মনে হচ্ছে সেটা তুমি। (দীপ্ত)

- ও,,,,হ.... হতেই পারে। একটা মানুষের ভুল হতেই পারে। কিন্তু সেটাকে সিরিয়াসলি নেয়া উচিত নয় স্যার। (দিনা একটু হাসার চেষ্টা করে)

- তাই? তো ভুলটা করার আগে তো তার দেখা উচিত সে কার সাথে ভুলটা করতে যাচ্ছে। (দীপ্ত)

- কিন্তু সে তো আপনার আসল পরিচয় জানতোই না। (দিনা)

- জেনে হোক আর না জেনেই হোক, ভুল তো ভুলই। সে যা করেছো তা তাকে কড়ায় গন্ডায় মিটিয়ে দিতে হবে। (দীপ্ত)

- ম..মানে? (দিনা)


দিনার চেহারায় ত্রাস লক্ষ্য করা গেল।

- মানে......একটু পরই বুঝতে পারবে। এখন যাও কালকের মিটিংয়ের প্রেজেন্টেশন ফাইল এক ঘন্টার মধ্যে রেডি করে আমাকে ফরওয়ার্ড করো। (দীপ্ত)

- এত ভারি একটা কাজ এক ঘন্টায়!!! (দিনা অবাক হয়ে)

- হ্যাঁ, এক ঘন্টায়। (দীপ্ত)

- But... (দিনা)

- Who is your boss, you or I? (দীপ্ত)

- আপনি। (দিনা)

- তাহলে কার কথা কে শুনবে? আমি তোমার কথা শুনবো নাকি তুমি আমার কথা শুনবে? (দীপ্ত)

- আমি আপনার কথা শুনবো। (দিনা মিনমিন করে)

- তাহলে যা বলছি সেটা করো। যাও। (দীপ্ত)


দিনা শুকনো মুখে দীপ্তর কেবিন থেকে চলে গেলো।


৪৭.
Lunch break এর আগে আখি অথবা দিনা কেউই অবসর পেলো না। মাহির আর দীপ্ত তাদের সবসময় কাজের মধ্যে রেখেছে। আখি ও দিনা মনে হয় অফিসে জয়েন করার পর কখনও সারাদিনেও এত কাজ করেনি যত কাজ তারা শুধু আজকে সকালে করেছে। কাজ করতে করতে দুজনেরই অবস্থা কাহিল।

আখি লাঞ্চ ব্রেক হওয়ার সাথে সাথেই মাহিরের থেকে ছুটি নিয়ে নিজের কেবিনে চলে এসেছে। কেবিনে এসেই প্রথমে নিজের প্রিয় চেয়াটাতে এসে ধপ করে বসলো আর মাথাটা চেয়ারে এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। আহা, কি শান্তি। বিশ্রামের মূল্য পরিশ্রম না করলে বোঝা যায় না। আসল অফিস আর খাটুনি কাকে বলে, এতদিনে বুঝতে পারছে সে।

কিছুক্ষণ পরই দিনা আখির কেবিনে এসে দেয়ালের দিকে রাখা সোফায় ধপ করে বসলো।

- আমি আজকে কাজের চাপে মরে যাবো আখি। (দিনা)

- তুই তো মরে যাবি। আমি মনে হয় মরে গেছি। মাতালটা মনে হয় আসলেই নেশা করে এসেছে। নাহলে এত কাজ কেউ কাউকে দিয়ে করায়? (আখি)

- গাঁজাখোরও মনে হয় সকাল সকাল গাঁজা খেয়ে অফিসে এসেছে। এই দুটো যে এত শয়তান, বিশ্বাস কর, কল্পনাও করতে পারিনি। (দিনা)

- এর থেকে অফিস থেকে বের হয়ে যাওয়া ভালো। (আখি)

- তুই থাকলে থাক। আমি কালকেই রিজেগনেশন নেবো। (দিনা)

- আমি তো তোর থেকেও ডেঞ্জারজোনে আছি। আমার আগে রিজেগনেশন নেয়া উচিত। কি জন্যে যে মরতে এত কাহিনি করতে গিয়েছিলাম.......(আখি)


এমন সময় তপু এসে বলে-

- আখি ম্যাডাম, আপনারে বস,,,,থুরি, CEO sir ডাকতাছে। (তপু)

- (হতাশ হয়ে) তুমি যাও, আমি যাচ্ছি। (আখি)


তপু চলে গেলে আখি নিজের মাথা দুহাতে চেপে ধরে একটি বিরক্তিকর ও অসহনীয় শব্দ করে বললো-

- আ........... এই মাতালটা লাঞ্চ টাইমেও শান্তি দেবে না। (আখি)


৪৮.
- ভাইয়া, দেখতো এই ডিলটা, কোথাও গন্ডগোল মনে হচ্ছে। (দীপ্ত মাহিরের কেবিনে ঢুকতে ঢুকতে বললো)


মাহির নিজের টেবিলে বসে ল্যাপটপে কাজ করছিলো। দীপ্তর গলা পেয়ে সে সামনে তাকিয়ে ভ্রু কূচকে বললো-

- কি গন্ডগোল মনে হচ্ছে? (মাহির)

- (মাহিরের সামনে কিছু কাগজ ধরে) Look at this, চারমাস আগে C.R কোম্পানির সাথে আমাদের কোম্পানির একটা ডিল হয়েছিলো। সেটা full-fill হওয়ার পর আমাদের কোম্পানির একাউন্টে ৭০ লাখ টাকা আসার কথা। এখানে দেওয়া আছে সেটা account এ ট্রান্সফার করা হয়েছে। But এই ফাইলগুলোতে দেখা যাচ্ছে একাউন্টে ৫০ লাখ টাকা ঢুকেছে। বাকি কুড়ি লাখ টাকা কোথায় গেলো? (দীপ্ত)

মাহির খুব ভালোভাবে ফাইলগুলো দেখলো। দেখলো দীপ্ত ঠিকই বলছে। সেখানে কিছু গন্ডগোল আছে।

- হুম। বুঝছি না ব্যাপারটা। আচ্ছা তুই একটু দেখ, আমি আখির সাথে এই নিয়ে কথা বলছি। আর এই ফাঁকে ওকে দিয়ে একটু খাটিয়ে নেওয়া যাবে। (মাহির)

- Okey. যা ভালো বুঝিস কর। (দীপ্ত)


দীপ্ত চলে গেলে মাহির আখিকে ডেকে পাঠায়।

- Sir, আমায় ডেকেছিলেন? (আখি)

- হুম। এই পেপার্সগুলো চেক আউট করো। দেখো কোথায় গন্ডগোলে হয়েছে সেটা। (মাহির)

- স্যার আপনি তো পেপার্স দেখেছেন, আমাকে বলে দিন সমস্যা কোথায়। তাহলে আমাকে আর কষ্ট করে সমস্যাটা খুঁজতে হবে না। (আখি)

- মুখে মুখে এত কথা বলো কেনো? যা করতে বলেছি সেটা করো। (মাহির)


আখি মাহিরের অলক্ষ্যে তাকে মুখ ভেঙচি দিয়ে মনে মনে বললো-

- Devil লোক একটা। কীভাবে আমাকে খাটানো যায় তার ধান্দা করে সবসময়। (আখি মনে মনে)


আখি ঝটপট কাজে লেগে পড়ে। সমস্ত মনোযোগ কাজে ঢেলে দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে কাগজগুলো। সে তাতে এতটাই মনোযোগী ছিল যে মাহির নিজের ল্যাপটপে চোখ রাখার পাশাপাশি তার দিকেও অসংখ্যবার আড়চোখে তাকিয়েছে সেটা সে বুঝতেও পারেনি। এর আগে আখিকে নিরীক্ষণ করার সুযোগ মাহিরের হয়নি। কাজ করার সময় যখন সে সমস্ত মনোযোগ কাজে ঢেলে দেয়, তখন তার মধ্যে আলাদা একটা সৌন্দর্য জেগে ওঠে। সেই সৌন্দর্য যেন শব্দের গায়ে ধরা যায় না-তা এক নিবিড়, অব্যক্ত, নীরব জ্যোতির মতো। যখন সে কাজে ডুবে যায়, তখন তার হরিণাক্ষী চোখদুটো আরও গভীর হয়ে ওঠে, যেন কোনো অদেখা গহ্বরের ভেতরে ডুবে আছে সে, তার ভ্রু-এর সামান্য কুঁচকানো, গোলাপি ঠোঁটের কোণে অদৃশ্য মনোযোগের রেখা—সব মিলিয়ে তাকে করে তোলে অপার্থিব এক দৃশ্য। মাথার একপাশে পড়ে থাকা চুলগুলোও তখন অনাবিষ্কৃত কোনো কবিতার অনুচ্ছেদ হয়ে সামনে এসে পড়ে। সে মুহূর্তে তাকে দেখলে মনে হয়, এ কোনও সাধারণ মেয়ে নয়। যেন কাজের ছলে নিজেকেই গড়ে নিচ্ছে নিভৃতে—নির্মাণ করছে এমন এক রূপ, যা বাহ্যিক নয়, বরং গভীর, গূঢ় এবং ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

কিন্তু নারী বা নারীর সৌন্দর্যের প্রতি অনাগ্রহতা কোথাও একটা গিয়ে মাহিরের মুগ্ধতাকে ব্যাহত করে। তবে সৌন্দর্য না পারলেও কাজের প্রতি তার নিষ্ঠা মুগ্ধ করতে বাধ্য করে মাহিরকে।

সমস্যাটি খুঁজে বের করতে আখির বেশি সময় লাগে না। গন্ডগোল বুঝতে পেরেই সে মাহিরের কাছে গিয়ে বলে-

- স্যার, হিসেবে কি গড়মিল আছে? (আখি)


মাহিরের দৃষ্টি সেসময় ল্যাপটপে নিবদ্ধ ছিল। আখির গলার আওয়াজ পেয়ে সে নিজের শান্ত দৃষ্টি তার দিকে নিক্ষেপ করল। গম্ভীর গলায় বলল-

- আর কোনো সমস্যা খুঁজে পেয়েছো? (মাহির)

- না। (আখি)

- তাহলে অবশ্যই সেটাই। (মাহির)

- না, মানে অন্য কোনো সমস্যাও হতে পারে। তাই বলছিলাম। (আখি)

- ওখানে হিসেব এদিক-ওদিক কেনো? (মাহির)

- আমি কি জানি? (আখি)

- ছ'মাস ধরে এখানে কাজ করছো। তুমি জানবে না তো কে জানবে? (মাহির)

- আমি আপনার অফিসের সিসিটিভি নাকি? আপনার অফিসের পুঙ্খানুপুঙ্খর খবর আমি রেখে বসে আছি, যে আমি সব জানবো! (আখি রেগে)


আখি একটু ঝাঝালো গলায় বললে মাহির তার দিকে জলন্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকালে আখি চুপ হয়ে যায়।

- এই ডিলের দায়িত্বে কে ছিলো? (মাহির)

- আব....সম্ভবত ম্যানেজার স্যার। (আখি)

- উনি কোথায়? (মাহির)

- মনে হয় চলে গেছেন। (আখি)

- চলে গেছেন মানে? অফিস টাইম শেষ? (মাহির)

- অনেকক্ষণে শেষ। (আখি)

- আমি যে কাজগুলো তোমাকে করতে দিয়েছিলাম সেগুলো হয়েছে? (মাহির)

- একটুখানি বাকি আছে স্যার। (আখি)

- প্রথমদিনেই কাজ শেষ করতে পারলে না। আমি disappointed হলাম। (মাহির)

- একসপ্তাহের কাজ যে একদিনে করে দিচ্ছি সেটা আপনার ভাগ্য। (আখি মনে মনে)

- ফাইলসগুলো বাড়িতে নিয়ে যাও। কাল সকালে অফিসে এসেই আগে আমাকে ওগুলো দেখাবে। (মাহির)

- Okey sir. (আখি)


৪৮.
আজকে অফিস থেকে দেরী করে বের হওয়ায় আখির প্রত্যহ দিনার সাথে বাড়ি ফেরার নিয়মে ছেদ পড়েছে। দেরি হচ্ছে দেখে দিনাকে সে-ই বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। তার বাড়িতে তার অসুস্থ বাবা রয়েছে। যদি কোনো সমস্যা হয়। কিন্তু অন্যের ভালো করতে গিয়ে নিজেকে একদিক দিয়ে বিপদে ফেলে দিয়েছে সে। এতরাতে এমনি গাড়িঘোড়া কিছু পাওয়া যায় না, তারওপর নির্জন রাস্তা। শর্টকাট রাস্তা দিয়ে গেলে অফিস থেকে তার বাড়ির দূরত্ব বেশি নয়। কিন্তু যদি হাইওয়ে দিয়ে যেতে হয়, তাহলে হেঁটে যাওয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু সবসময় শর্টকাটেই ঝামেলা থাকে। সেখান দিয়ে একটা একা মেয়ের রাতদুপুরে যাওয়া সিংহের গুহা দিয়ে যাওয়ার কম কিছু নয়। কিন্তু অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাধ্য হয়ে তাকে সেই পথ বেছে নিতে হয়। মনে কিছুটা আশঙ্কা নিয়েই মাহিরকে মনে মনে দুষতে দুষতে দ্রুতপদে পা চালিয়ে সেদিক দিয়ে চলতে শুরু করে সে।

রাস্তাটা যথেষ্ট সংকীর্ণ। ল্যাম্পপোস্টগুলোও একটি অপরটির থেকে বেশ দূরত্বে অবস্থিত। কোনো বাড়িঘর নেই, তবে রাস্তার দুধারে সারি দিয়ে অসংখ্য দোকান রয়েছে, যার সবই এখন বন্ধ। একটাও জনমানবের চিহ্ন নেই। অলিগলির ভেতর থেকে মাঝে মাঝে শুধু নিশাচর পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। কিন্তু তার মধ্যেই হঠাৎ পেছন থেকে একটি কাচ ভেঙে যাওয়ার শব্দ পায় আখি। থেমে দাড়ায় সে। পেছনে তাকিয়ে সোডিয়ামের আবছা হলুদাভ আলোয় দেখে খানিক দূরেই একটি পুরুষালি অবয়ব। তার পায়ের কাছেই একটা ভাঙা কাচের বোতল পড়ে আছে। বোতলটা ঠিক কিসের তা বুঝতে বিলম্ব হয় না তার। ছেলেটির হাতেও ওমন আরেকটি বোতল দেখা যাচ্ছে। যেই শঙ্কায় সে এতক্ষণ পথ চলছিল, সেই শঙ্কাটি সত্য হওয়ায় হাড় হিম হয়ে আসে তার। কিন্তু সে মনের জোর হারায় না।সামনে ঘুরে হাটার গতি পাঁচগুণ বাড়িয়ে এগিয়ে যেতে থাকে সে। কিন্তু খুব দ্রুতই পেছনে কয়েকজনের পদশব্দ স্পষ্ট শুনতে পায় সে। এতে তার ত্রাস আরো বেড়ে যায়। কয়েক মূহুর্তে পরই একটি ছেলে পায় দৌড়ে এসে তার সামনে এসে দাড়ায়।

- আরে ম্যাডাম এই রাত-বিরেতে এত তাড়াঘুরো করে কোথায় যাচ্ছেন? (ছেলেটি)


মনে সামান্য ভয় থাকলেও সে চোখ মুখে একটু কঠোরতা নিয়ে এসে দৃঢ় গলায় বলে-

- সামনে থেকে সরুন। (আখি)

- সরার জন্য তো আসিনি। তোমাকে সঙ্গ দিতে এসেছি। এক কাজ করো, আমাদের সাথে চলো। আমরা তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছি। (ছেলেটি)


ছেলেটি এই বলে আখির হাত ধরলে আখি সাথে সাথে হাঁটু দিয়ে তার অন্ডকোষ বরাবর লাথি মারে। ছেলেটি সাথে সাথে ব্যথাতুর শব্দ করে দূরে সরে যায়।

- আহঃ... (ছেলেটি)


ছেলেটি এরপর আখির দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বাকিদের উদ্দেশ্যে বলে-

- এই... দাঁড়িয়ে দেখছিস কি? ধর ওকে। (ছেলেটি)


পাশেই বালু পড়ে ছিলো। আখি দ্রুত ঝুঁকে মুঠোভর্তি বালু তুলে নিয়ে তা ছেলেগুলোর দিকে ছুঁড়ে দিলো। চোখে বালু ঢুকে যাওয়ায় তারা একেকজন লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গেল। এই সুযোগে আখি উল্টোদিকে ছুট দিলো। কিছুদূর যেতেই একবার পেছনে ফিরে তাকায় সে। ছেলেগুলোর কাউকে দেখতে পেল না সে। তবে দূরে কালো জ্যাকেট ও কালো প্যান্ট পরিহিত একটি ছায়ামূর্তি দেখতে পায়। কিন্তু বিপদের আশঙ্কায় সেটা নিয়ে বেশিক্ষণ না ভেবে দ্রুত সে বাড়ির রাস্তায় পা বাড়ায়।

৪৯.
- মাহির.... দীপ.... Where are you?


মাহির ও দীপ্ত ওপরের রুমে বসে ব্যবসায়িক আলোচনায় ডুবে ছিলো। মাঝখানে নিচ থেকে মাহিরের মায়ের গলা পাওয়া যায়। ফলে তাদের আলোচনা আপাতত স্থগিত করতে হয়।

- কী ব্যাপার বল তো ভাইয়া, আন্টি এ সময় এভাবে ডাকছে কেন? (দীপ্ত)

- অফিস থেকে ফেরার সময় মম কি বলেছিলো মনে নেই? মনে হচ্ছে আজ বড়সড় কোনো ঝামেলা হবে। (মাহির)

- এখন? (দীপ্ত)

- চিন্তা করিস না, সেটা সামলানোর ক্ষমতা আমার আছে।


মাহির ও দীপ্ত সিড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে দেখে মাহিরের মা ড্রইংরুমে দাঁড়িয়ে আছেন। তার চেহারায় ক্রোধ স্পষ্ট। বাড়ির অন্যান্য সদস্যরাও হাজির হয়েছেন। মনে হয় তারাও বুঝতে চেষ্টা করছেন অবন্তী রওশনের এত রাগের কারণ কি?

- What happened mom, ডাকছো কেন? (মাহির)

- তোমরা আজকে এমন একটা কাজ করেছো যেটা আমি তোমাদের থেকে একদম expect করিনি। (মাহিরের মা)

- আহ্, অবন্তী, ভনিতা না করে তাড়াতাড়ি বলো না ওরা কি করেছে? ওদের দোষটা কোথায়? (মাহিরের বাবা)

- কিন্তু আমাদের যতদূর মনে পড়ছে, আমরা তো আজকে কোন দোষ করিনি। (দীপ্ত)

- আমি তোমাদের বারণ করেছিলাম ওই চিফ মেয়ে দু্টোকে নিজেদের পিএ না করতে। কিন্তু তাও তোমরা আমার কথা শুনলে না। (মাহিরের মা)

- But where is the problem mom? (মাহির)

- The problem is they are from a middle-class family. (দীপ্ত)

- So what aunt? (দীপ্ত)

- হ্যাঁ, তাতে সমস্যা কি? আমার কোম্পানিতে তো এমন কোনো নিয়ম নেই যে মিডলক্লাস ফ্যামিলির কেউ আমার কোম্পানিতে কাজ করতে পারবে না। (মাহিরের বাবা)

- তুমি বিষয়টা বুঝতে পারছো না আরিফ, অন্য পোষ্টে কাজ করা একটা বিষয় আর পিএ'র পোষ্টে কাজ করা আরেকটা বিষয়। (মাহিরের মা)

- মানে? অন্য পোস্টে কাজ করা আর পিএ হিসেবে কাজ করার মধ্যে কি পার্থক্য রয়েছে? (দীপ্তর মা)

- আরে অঙ্কিতা, একটু ভেবে দেখো। যদি ওরা পিএ হিসেবে থাকে তাহলে ওদের সবসময় মাহির আর দীপের আশেপাশে থাকতে হবে। আর এই টাইপের মেয়েদের আমি খুব ভালো করে চিনি। বড়লোক ছেলে দেখলেই এরা ওদের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তেমনিভাবে ওই মেয়েগুলোও আমার ছেলেদেকে attract করার চেষ্টা করবে। আর যদি কোনোক্রমে ওরা ওদের ফাঁদে পা দেয়, তাহলে বুঝতে পারছো কি হবে? (মাহিরের মা)

- Wait mom, are you thinking like that? Seriously? আরে যেখানে অস্ট্রেলিয়ার এত সুন্দর সুন্দর মেয়ে কিনা আমাকে attract করতে পারেনি, সেখানে ঐ মেয়েটা আমাকে attract করবে? (মাহির তাচ্ছিল্যের স্বরে)

- আমাদের attract করা এত সহজ নয় আন্টি যতটা তুমি ভাবছো। (দীপ্ত)

- আচ্ছা, ওদিকটা বাদ দিলাম। But do you know boys, ঐ মেয়েগুলো কত mannerless? Specially ঐ আখি নামের মেয়েটা। (মাহিরের মা)

- তুমি কি করে জানলে ওরা mannerless? (মাহিরের বাবা)

- আমার ওদের চেনা অনেক আগেই হয়ে গেছে। তুমি জানো ঐদিন ক্যাফেতে ঐ আখি নামের মেয়েটা আমার শাড়িতে কোক ফেলে আমার সাথে কত বেহায়ার মতো তর্ক করছিলো? তাহলে কীভাবে তোমরা বলো ও mannerless নয়? ওকে কালকেই তোমরা অফিস থেকে বের করে দেবে। (মাহিরের মা)

- Mom, মেয়েটা personal life এ যেমনই হোক না কেন, ও অফিসের কাজ খুব ভালোভাবে করে। তাই আমার মনে হয় না ওকে বের করে দেয়া উচিত। (মাহির)

- Yes aunt. Don't worry about us. (দীপ্ত)

- But...... (মাহিরের মা)

- Please mom...... এটা নিয়ে আর মাথা ঘামিয়ো না। (দীপ্ত)

- Okey, but stay away from them as possible as can. (মাহিরের মা)


৫০.
আখি অফিস থেকে বাড়ি ফিরে ফ্রেস হয়েই বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। চোখটা বন্ধ করে আজকে সারাদিন কি কি হলো সেগুলো কল্পনা করছে আখি। আজকে এতগুলো সারপ্রাইজ পেয়েছে যে মাথাটা পুরো হ্যাং হয়ে আছে। প্রথমে আগের সিইও স্যারের অ্যানাউন্সমেন্ট, তারপর মাহিরের ও অবন্তী রওশনের আসল পরিচয় জানা, ও মাহিরকে CEO হিসেবে এনাউন্স করা, আবার মাহিরের তাকে পিএ হিসেবে সিলেক্ট করা। আর শেষে ফেরার পথের অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ। কী থেকে যে কি হয়ে গেল.....


কিছুক্ষণ পর মনে পড়ল মাহির তাকে অনেকগুলো কাজ দিয়েছে। শুয়ে থাকলে হবে না। বিছানা থেকে উঠে নিজের স্টাডি টেবিলে গিয়ে কাজগুলো করতে বসলো সে। কাজ করতে করতে তার মনে পড়ল অফিসের ফাইলে হিসেবের গন্ডগোলের কথা। এমন তো হওয়ার কথা নয়। তাহলে অফিসের কেউ কি টাকা চুরি করেছে? কে করতে পারে? এসবের দায়িত্বে তোর ম্যানেজারই থাকে। কিন্তু উনি তো এমন কাজ কখনোই করতে পারে না। অনেকদিন থেকে কাজ করছেন তিনি রওশন এন্টারপ্রাইজে। তাহলে কে হতে পারে? এ পেছনে বড় কোনো হাত নেই তো?

আখি যখন নিজের ভাবনায় মত্ত, তখন তার বাবা ঘরে প্রবেশ করলেন। দরজা খোলার শব্দের আখিও নিজের ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে এলো। সে নিজের বাবার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল-

- কি ব্যাপার বাবা, আজকে তুমি আমার ঘরে এসেছো? (আখি)

- (স্বল্প হেসে) অফিস থেকে ফেরার পর তো আর গল্প করতে আসলি না? তাই আমিই চলে এলাম, তুই কি করছিস তা দেখতে। (আখির বাবা)

- ভাবলাম তুমি ব্যস্ত থাকবে, তাই যাইনি। (আখি)আ

- একদম মিথ্যে কথা বলবি না। তোর বাবা তো প্রতিদিনই ব্যস্ত থাকে। তুই তাও যাস। তাহলে আজকে এমন কি হলো? (আখির মা)


আখির মা ডাইনিং রুমেই ছিলেন। তিনি ডাইনিং টেবিলটা একটি কাপড় দিয়ে মুছছিলেন। আখির রুম থেকে বের হলেই ডাইনিং রুম পড়ে। আখির রুমের দরজা খোলা থাকায় আখির মা তার ও তার বাবার সমস্ত কথোপকথন শুনতে পাচ্ছিলেন। তাই আখির কথা শুনে তিনি ডাইনিং রুম থেকেই প্রতিবাদ করে বললেন।

- তুমি কিভাবে আমার মিথ্যে কথাগুলো ধরে ফেলো বলতো মা? (আখি)

- মেয়ের মনে কি চলছে, তা মা সবসময় বুঝতে পারে। তোর দিকে না তাকিয়েও তোর গলার স্বর শুনেই বুঝতে পারবো, তুই সত্যি বলছিস নাকি মিথ্যে। নিজে যখন মা হবি তখন বুঝবি। (আখির মা)

- কখনও হতেও চাইনা। বিয়ে একটা disgusting জিনিস। (আখি)

- এখন বলতো, আজকে গল্প করতে যাসনি কেন? এখন আবার কাগজ কলম নিয়ে বসেছিস? অফিস থেকে এসে তো কোনদিন কাজ করতে দেখিনি তোকে। (আখির বাবা)


আখির মনেো পরল সে তো বাবা-মাকে বলতেই ভুলে গেছে সে CEO র পিএ হিসেবে সিলেক্টেড হয়েছে।

- বাবা, তোমাদের জন্য একটা সুখবর আছে। (আখি)

- কী সুখবর? (আখির বাবা)

- Wait.... (আখি এই বলে রুম থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো)


দশ সেকেন্ড পর সে নিজের মাকে সাথে করে নিয়ে এসে বিছানায় বসায়।

- কী বলবি বল তাড়াতাড়ি। আমার অনেক কাজ আছে। (আখির মা)

- আগে শোন না আমি কি বলি। (আখি)

- বল। (আখির বাবা)

- আমি CEO sir এর পিএ হিসেবে সিলেক্টেড হয়েছি। (আখি)


আখির বাবা-মা কিছুক্ষণ আখির মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। তারপর হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বললেন-

- ত.... তুই সত্যি বলছিস? (আখির মা)

- হ্যাঁ, মিথ্যে কেন বলবো? (আখি)

- এটা তো ফাটাফাটি একটা খবর। দেখ গিন্নী দেখ, আমার মেয়ে ধীরে ধীরে life এ কত shine করছে দেখো। (আখির বাবা খুশি হয়ে)

- তাই তো দেখছি। আখি, আজ কী খাবি বল, আমি আজ সব তোর পছন্দের খাবার রান্না করবো। (আখির মা)

- এত রাতে আবার কী রান্না করবে তুমি। থাক, কিছু করতে হবে না। (আখি)

- তা বললে হয়, গিন্নী, তুমি রান্না বসাও। আমি বাজার থেকে ভালো দেখে মিষ্টি নিয়ে আসি। এত বড় একটা সুখবর পেলাম, মিষ্টিমুখ না করলে হয়? (আখির বাবা)

- এত রাতে? এত রাতে তোমার জন্য কোন মিষ্টির দোকান খোলা থাকবে? (আখি)

- আরে আমার পরিচিত একটা ভালো দোকান আছে। ওখানে ঠিক পেয়ে যাব। (আখির বাবা)

আখির শত বাধা উপেক্ষা করেও আখির মা-বাবা নিজেদের মেয়ের এই অগ্রগতি উদযাপন করলেন। কাল যদি আখি অফিস থেকে রিজেগনেশন নিয়ে নেয়, তাহলেই অফিসের সাথে তার কোনো সম্পর্ক থাকবে না। আখির তার মা-বাবার খুশিটা নষ্ট করতে ইচ্ছে করছিলো না। একবার মনে হলো- থাক, কী দরকার শুধু শুধু সরে যাওয়ার? কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলো- কিন্তু বস যত চাপ দিচ্ছে, আদৌও সেখানে কাজ করা যাবে? নাহ, বাঁচার জন্য হলেও সব ইমোশনকে দূরে ফেলে দিতে হবে। এসব ভেবেই আখির মনটা বিষাদে ভরে গেলো।


চলবে....................




69 Views
3 Likes
1 Comments
4.5 Rating
Rate this: