ছায়ার ফাঁদ

তামিম, ১৪ বছরের এক কিশোর। ক্লাস এইটে পড়ে। একসময় খুব উৎসাহী ছিল—রকেট বানাত, বিজ্ঞান বই পড়ত, মহাকাশের ছবি কাটত কাগজ থেকে। তার স্বপ্ন ছিল একজন মহাকাশবিজ্ঞানী হওয়া। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহে কেমন যেন হয়ে গেছে সে। মনে হয়, কেউ যেন তার মন থেকে সব ইচ্ছেগুলো চুরি করে নিচ্ছে।

সে টের পায়—দিনে যতই হাসে, রাতে তার ভেতরটা ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। পড়ার টেবিলে বসলে মাথা ধরে, বইয়ের অক্ষরগুলো যেন অন্ধকারে ডুবে যায়। ঘুম এলেই একটা অদ্ভুত স্বপ্ন আসে—এক ছায়ামানব দাঁড়িয়ে থাকে জানালার পাশে, আর বলে,
“তোমার স্বপ্ন অনেক বড়, তামিম... কিন্তু এত কষ্ট করে কী হবে? কেউ কদর করবে না... চলো, ঘুমিয়ে পড়ো... সব ভুলে যাও...”

তামিম প্রথমে ভেবেছিল এটা নিছক দুঃস্বপ্ন, কিন্তু এখন সেটা যেন দিনে-দিনে আরও বাস্তব হয়ে উঠছে। ছায়াটা যেন তার সাথে সঙ্গী হয়ে গেছে। সে আর আগের মতো জেগে থাকতে পারে না। সকাল হলেই ক্লান্ত লাগে, রাত নামলেই মনে হয় যেন কেউ তাকে ডাকছে, টানছে অন্ধকারের দিকে।

একদিন, ভয়ংকর এক রাতে, তামিম স্বপ্নে পুরোপুরি সেই ছায়ামানবের মুখোমুখি হয়। সাদা পাথরের মতো মুখ, আগুনের মতো জ্বলন্ত চোখ, আর ঠান্ডা কণ্ঠে সে বলে—
“আমি ‘অবসাদ’। আমি তোমার স্বপ্ন খেয়ে ফেলতে এসেছি। তুমি এখন আমার। তুমি আর কিছুই না। তোমার স্বপ্নগুলো আমার পেছনে ছায়া হয়ে যাবে।”

তামিম ভয়ে কাঁপে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার বিজ্ঞান বইগুলো, রকেট মডেল, মা-বাবার গলা—“তুমি অনেক দূর যাবে, মা...”
আর ঠিক তখনই এক কণ্ঠ ভেসে আসে—তার নানুর, যিনি আর বেঁচে নেই—
“ভয় পাস না, তুই একা না রে... নিজের আলো খুঁজে নে...”

তামিম জোরে চিৎকার করে উঠে—
“না! আমি হারবো না! আমি জানি আমি কে! আমি তামিম। আমি স্বপ্ন দেখি। আর সেটা তোকে ছুঁতে দেবে না!”

সেই মুহূর্তে চারপাশ আলোয় ভরে যায়। ছায়ামানব চিৎকার করে মিলিয়ে যায় বাতাসে। ঘুম ভেঙে যায় তামিমের। শরীরটা ঘামে ভেজা, কিন্তু মনটা আগের চেয়ে অনেক পরিষ্কার।

সেই দিন থেকেই বদলে যায় তামিম। মোবাইল থেকে গেম ডিলিট করে, পড়ার টেবিলটা গুছিয়ে ফেলে, আবার রকেট মডেলটা নতুন করে বানাতে শুরু করে। সে জানে, শয়তান কোনো সিঙা-ওয়ালা ভূত না, বরং অলসতা, হতাশা, আর আত্মবিশ্বাস হারানোর ছায়া।

কিন্তু আলো যারা বুকে ধরে রাখে, তাদের ছায়া ছুঁতে পারে না।