রিয়াদ শহরের এক কোণায়, বালুর ধুলোমাখা কর্মস্থলে ঘাম ঝরিয়ে দিন পার করে হানিফ। বয়স তিরিশ ছুঁইছুঁই, কিন্তু চোখের নিচে কালি আর হাতের রেখায় বয়স যেন চল্লিশ পেরিয়েছে অনেক আগেই।
তিন ভাই-বোনের মধ্যে হানিফ সবার বড়। বাবা যখন স্ট্রোক করে শয্যাশায়ী হলো, তখন সে ক্লাস নাইনের ছাত্র। স্কুল ছুটে যায় হঠাৎ। বন্ধুদের স্কুল ব্যাগ কাঁধে ঝুলতো, আর হানিফের কাঁধে উঠতো বস্তা। প্রথমে কাঠের দোকানে কাজ, তারপর দালাল ধরে পাড়ি জমায় সৌদিতে। যাওয়ার টাকাটা উঠাতে বোনের গয়নাও বিক্রি করে।
প্রথম প্রবাসের ঈদে মা বলেছিল,
"তুই থাকিস না মা, টাকা লাগবে না। শুধু তুই থাকলি চলত।"
কিন্তু হানিফ জানে, তার না থাকলে কিছুই চলত না। বোনের বিয়ের খরচ, ছোট ভাইয়ের পড়াশোনা, মা-বাবার চিকিৎসা—সব কিছুই তার পাঠানো টাকায় চলেছে। নিজে কিছু রাখেনি কখনো, শুধু দিয়েছে।
একবার দেশে এসে পরিচয় হয়েছিল শম্পার সঙ্গে। শহরের মেয়ে, কলেজে পড়ে। অদ্ভুত রকম শান্ত মেয়েটার চোখে ছিল গভীর কিছু, যা হানিফ আগে দেখেনি। সম্পর্কটা ধীরে ধীরে ভালোবাসায় গড়ায়।
শম্পা বলত,
"তুমি শুধু প্রবাসী না, তুমি তো যোদ্ধা। তুমি না হলে তোমার পরিবার আজ কোথায় থাকত?"
হানিফ নতুন করে বাঁচতে চায়। মায়ের সঙ্গে শম্পার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যায়। কিন্তু তখনই আসে সবচেয়ে নির্মম আঘাত।
শম্পার বাবা সোজা বলে দিলেন,
"ডিগ্রি নেই, ভবিষ্যৎ নেই। বিদেশে দিনমজুর, কবে কাজ থাকবে, কবে থাকবে না, তার ঠিক নেই। আমাদের মেয়ে ওর সঙ্গে কেমনে থাকবে?"
শম্পা কিছু বলেনি। শুধু চোখ নামিয়ে ছিল। ধীরে ধীরে দূরত্ব বাড়ে, সম্পর্ক হারিয়ে যায় অজান্তেই।
হানিফ আবার রিয়াদে ফিরে যায়। তার ব্যাগে শম্পার উপহার দেওয়া একজোড়া কাচের চুড়ি, যা সে বলেছিল—
"তুমি আমার হলে আমি এই চুড়িটা পরে থাকব সারাজীবন।"
তারপর সময় পেরিয়ে গেছে অনেক। আরেকবার দেশে ফিরলে পরিবার থেকে আবার বিয়ের চেষ্টা হয়। কিন্তু মেয়ের পরিবার মুখে বলেই ফেলে,
"বিদেশে কাজ করে ঠিক আছে, কিন্তু লেখাপড়া তো নাই। বয়সও তো বাড়তেছে। এমন ছেলেরে মেয়ে দিয়া ঝুঁকি নেব কে?"
হানিফ চুপ থাকে। কী বলবে? বলবে সে সব দিয়ে দিয়েছে, শুধু ডিগ্রিটা ত্যাগ করেছিল পরিবারের জন্য?
ছোট ভাই এখন সরকারি চাকরিতে। বাড়িতে সবাই গর্ব করে বলে,
"ছেলেটা পরিবারটারে উঠায়ে দিল!"
কেউ ভাবে না, কে সেই ছেলের পেছনে দাঁড়ায়েছিল ছায়ার মতো।
---
রাত হলে রিয়াদে ফ্ল্যাটের এক কোণে বসে হানিফ পুরোনো ডায়েরিতে লিখে:
"মা, তুই বলছিলি দেশে ফিরলে আমার ঘর হবে। কিন্তু এখন তো কেউ ঘর দিতে চায় না। আমি তো কাউরে ঠকাইনি মা। আমি শুধু নিজেকে বিসর্জন দিছি।"
সরকারের কাছে সে কেবল একটি নাম—“বিদেশপ্রেরিত অর্থের উৎস।”
না কোনো পেনশন, না কোনো সুরক্ষা। সে সরকারি চাকরিজীবী না যে অবসরের পরও সম্মান থাকবে।
---
শেষ বয়সে হানিফ একা। একটা ভাঙা ব্যাগে কিছু পুরোনো চিঠি, মায়ের একটা সাদা ওড়না আর শম্পার চুড়ি।
সে জানে না শম্পা আজও সেই চুড়িটা পরে কিনা।
শুধু জানে—
"আমার গল্প কেউ শুনবে না, কারণ আমি হানিফ—শুধু একজন প্রবাসী।"
---
পাঠকের উদ্দেশ্যে কিছু কথা:
এই গল্প শুধু হানিফের না।
এটা হাজারো প্রবাসীর প্রতিচ্ছবি—যারা নিজেদের জীবন বিসর্জন দিয়ে গড়ে তোলে অন্যদের ভবিষ্যৎ, অথচ নিজেরটা গড়া হয় না কখনও।
তাদের নেই চাকরিজীবীদের মতো পেনশন, নেই সরকারি ভাতা, নেই সামাজিক সম্মান।
তারা রোদে পোড়ে, জ্বলে, গলে—তবুও দেশের প্রতি ভালোবাসায় টিকে থাকে।
তারা রেমিট্যান্স পাঠায়, কিন্তু দেশে ফিরে ঠিকানার মতো সম্মান খুঁজে পায় না।
তাদের নেই ছুটির দিন, নেই উৎসবের আনন্দ, নেই পরিবার পাশে।
আর সবচেয়ে বড় সত্য—তাদের ভালোবাসাও অনেক সময় মূল্য পায় না, শুধু “ডিগ্রি নেই” বলে।
তাই একবার ভাবুন—যে ছেলেটা আজ আপনাদের ঘরে টাকা পাঠায়, তার ঘরে কে আছে?
যে ভাই দেশের জন্য প্রবাসে ঘাম ঝরায়, তার গল্পটা কি কেউ শুনবে না?
একবার শুনুন, একবার বোঝার চেষ্টা করুন—প্রবাসীর কষ্ট শুধু টাকা দিয়ে মাপা যায় না।
চিঠি আসে না আর
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
67
Views
0
Likes
0
Comments
0.0
Rating