শহরের এক ব্যস্ত এলাকায় পাশাপাশি দুইটা বাসা। একটায় থাকে নাহিয়ান, আরেকটায় সানজানা। নাহিয়ান তাদের পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট। তার বাবা মসজিদের খেদমতে থাকা একজন সাধারণ মানুষ আর মা শায়লা বেগম একজন স্কুল শিক্ষিকা। আর সানজানা তিন ভাইয়ের একমাত্র আদরের বোন, সরকারি চাকুরিজীবী বাবার কোয়ার্টারে তার বেড়ে ওঠা।
নাহিয়ান যখন ১২, সানজানা ১১। সানজানা প্রতিদিন পড়তে আসতো নাহিয়ানের মায়ের কাছে। চোখে চোখে যেন শুরু হয়েছিল এক অবুঝ প্রেম। তখনকার ভালোবাসা ছিল চুপচাপ, নীরব, শুধুই অনুভবে। কিছুদিন পর হঠাৎ করেই সানজানা আর আসা বন্ধ করে দেয়। যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
কিন্তু নাহিয়ান ভুলতে পারে না। প্রতিদিন স্কুল শেষে সানজানার স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকত এক ঝলক দেখার আশায়। দেখা পেতো না, কথা তো দূরের কথা। সানজানার বাবা-মা তাকে সবসময় নিয়ে যেতো, নিয়ে আসতো।
দিন কেটে যায়, দুজনেই বড় হতে থাকে। কিন্তু যোগাযোগ আর হয় না।
ছয় বছর কেটে যায়।
নাহিয়ান তখন ১৯। পরিবারে অভাব, দায়িত্ব, কষ্ট। সিদ্ধান্ত নেয় প্রবাসে যাবে। কিন্তু মন পড়ে থাকে সানজানার কাছে। একদিন ট্রানজিটে কাতারের বিমানবন্দরে বসে নাহিয়ান শুধু কাঁদছিলো—কারণ একটাই, সানজানা।
প্রবাসে এসে শুরু হয় যুদ্ধ। কাজ নেই, খেয়ে না খেয়ে দিন কাটে। তবুও বেঁচে থাকার লড়াই চলে।
এক দুপুরে হঠাৎ সানজানার বাবার আইডি থেকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট।
তড়িঘড়ি করে একসেপ্ট করে মেসেজ পাঠায় নাহিয়ান—"আমি নাহিয়ান, আপনি কে?"
এক মাস কোনো উত্তর নেই।
তারপর হঠাৎ উত্তর—
"আমি সানজানা।"
তখন যেন সময় থেমে যায়।
"এতদিন কোথায় ছিলে?"
"লজ্জা... পরিস্থিতি... ভেবেছি তুমি ভুল বুঝবে।"
নাহিয়ানের চোখ ভিজে ওঠে। বুকের বা পাশে তীব্র ব্যথা, যেন হৃদপিণ্ড কাঁদছে।
তাদের আবার কথা হতে থাকে। ভালোবাসা ফিরে আসে। সানজানা জানায়, সে বিয়ে করতে চায়, হালাল পথে সম্পর্কটাকে এগিয়ে নিতে।
কিন্তু বাধা আসে।
সানজানার বাবা রাজি নন। তার স্বপ্ন—মেয়েকে একজন সরকারি চাকুরের সাথে বিয়ে দেবেন।
নাহিয়ান বোঝায়, সময় দিলে সে শহরে কিছু করবে, ঘর বানাবে, গাড়ি কিনবে।
প্রতিশ্রুতি দেয়,
"রক্ত বিক্রি করে হলেও তোমার মেয়েকে সুখে রাখব।"
তবুও রাজি হন না সানজানার বাবা।
তখন নাহিয়ান বলে,
"তাহলে এবার তোমার পালা, তুমি কিছু করো। আমি তো শুরুতেই বলেছিলাম—তোমার বাবা রাজি হবেন না। তাই আগে আলাদা হয়ে যাই।"
কিন্তু তখন সানজানা বলেছিল,
"আপনি রাজি করাতে না পারলে আমি করব।"
কিন্তু হঠাৎ সব উল্টে যায়।
সানজানা বলে,
"তখন আবেগ ছিল, এখন বিবেক এসেছে। আমি পারব না আপনাকে বিয়ে করতে।"
নাহিয়ানের চোখ অন্ধকার হয়ে যায়।
কিন্তু সে বেছে নেয় ঘুরে দাঁড়ানোর পথ।
সে কথা রেখেছে—কোনো নারীর কাছে নিজেকে আর তুলে দেয়নি।
একটা সময় এসেছিল যখন সানজানার বাসার পুরনো কাঠের সোফা—চুলার লাকরি হিসেবে এনে রেখেছিল নাহিয়ানের বাবা। সেই সোফার গায়ে একদিন সানজানা বসেছিল। এখন তা জ্বলে গেছে আগুনে। যেমন জ্বলে গেছে নাহিয়ানের স্বপ্ন।
প্রতিদিন রাতে নাহিয়ান কথা বলত বালিশের সাথে। কান্না করত একা।
আজ শহরে তার বাড়ি আছে, গাড়ি আছে, টাকা আছে।
কিন্তু নেই সেই প্রতিশ্রুতি রাখা মানুষটা।
আর কোনো নারী নেই তার জীবনে—কারণ প্রতিশ্রুতি ছিল,
“তোমার জায়গায় কাউকে দেবো না।”
---
যদি সানজানা কখনো এই গল্পটা পড়ে...
জানো সানজানা,
আমি আজও প্রতিদিন কাঁদি।
আমার ঘরের দেয়ালে এখনও তোমার অনুপস্থিতি লেগে আছে।
তুমি আমাকে পেতে চাওনি—তবুও আমি চাইনি কেউ আমার হৃদয়ে আসুক।
তোমার বাবার কোয়াটারে বড় হওয়া মেয়েটা, একদিন বস্তির ছেলেটাকে বিশ্বাস করেছিল, কিন্তু শেষমেশ পাল্টে গেলো সব।
তবুও আমি তোমাকে দোষ দিই না।
তোমার বাবার স্বপ্ন বড় ছিল, আমার ভাগ্য ছোট।
আমি শুধু বলি—আমার কথা রেখেছি,
তুমি রাখতে পারো নি।
তাই তোমার জন্য এই গল্প,
প্রতিশ্রুতির শেষ পৃষ্ঠা।
---
যুবকদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা:
ভালোবাসা সবকিছু না।
তোমার স্বপ্ন, সম্মান, পরিবার—এই তিনটিই তোমার আসল পরিচয়।
একটা মেয়ের "না" তোমার জীবন শেষ করে দিতে পারে না।
যারা কষ্ট দেয়, তারা তোমাকে মানুষ বানায়।
কান্না করতে করতে একদিন যখন আয়নার সামনে দাঁড়াবে, তখন দেখবে—তুমি আগের তুমি নেই।
আরেকটা তুমি দাঁড়িয়ে আছে—জেদি, সফল, প্রতিশ্রুতি রাখা পুরুষ।
আত্মহত্যা নয়, ঘুরে দাঁড়াও।
---
যুবতীদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা:
ভালোবাসা মানেই পাওয়া নয়।
একজন ছেলের আত্মত্যাগকে মূল্য দাও।
বাবা-মায়ের ইচ্ছের সাথে ভালোবাসাকে মিলিয়ে নিও, ভেঙে দিও না।
কারণ কোনো একদিন হয়ত তোমার স্মৃতির দেয়ালে একজন ‘নাহিয়ান’ কাঁদবে—
যে শুধু প্রতিশ্রুতি রেখেছিল, কিন্তু হারিয়ে গিয়েছিল তোমার “বিবেকের” কাঁচি তলায়।
---
শেষ পৃষ্ঠা অবধি যারা এসেছেন—জেনে রাখুন,
সব গল্পের শেষ সুন্দর হয় না,
কিন্তু কিছু গল্প হৃদয়ের প্রতিশ্রুতি হয়ে চিরকাল বেঁচে থাকে।
– মুশফিক আল আরাবি
প্রতিশ্রুতির শেষ পৃষ্ঠা
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
49
Views
0
Likes
0
Comments
0.0
Rating