আত্মর মুক্তি

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
রানা ও লিমা অনেকদিন ধরেই শহরের ব্যস্ত জীবন থেকে দূরে একটি শান্তিপূর্ণ স্থানে বসবাসের স্বপ্ন দেখছিল। তারা বরিশালের অদূরে এক নির্জন গ্রামে একটি পুরোনো বাড়ি পেয়েছিল, যা তাদের কাছে নতুন জীবনের সূচনা হিসেবে মনে হয়েছিল। বাড়িটি অনেক পুরোনো, ব্রিটিশ আমলের স্থাপত্যের নিদর্শন, কিন্তু তার মধ্যে এমন কিছু ছিল যা লিমাকে মুগ্ধ করেছিল। বাড়ির বড় বড় জানালা, লাল টালির ছাদ, আর চারপাশের ঘন গাছপালার আড়ালে থাকা নিস্তব্ধতা যেন এক বিশেষ ধরনের আকর্ষণ সৃষ্টি করেছিল। রানা বাড়িটির আর্থিক সুবিধার দিকে বেশি নজর দিয়েছিল, কারণ শহরের তুলনায় এই বাড়ি অনেকটাই সস্তা।

লিমা, যিনি একজন লেখিকা, এই বাড়িটিকে তার কাজের জন্য আদর্শ মনে করেছিলেন। তার মনে হয়েছিল, এখানে সে শান্তিতে নিজের উপন্যাস লেখার কাজ চালিয়ে যেতে পারবে। বাড়ির নিস্তব্ধ পরিবেশে সে নতুন সৃষ্টির প্রেরণা পাবে।রানাও বাড়িটি অনেক বেশি পছন্দ হয়েছিল—কারণ এই গ্রামের একটি হাইস্কুলের তার নতুন চাকরি হয়েছে । তিনি ভাল একজন ইংলিশ টিচার। 

প্রথম কয়েকটা দিন বেশ স্বাভাবিক ভাবেই কেটে গেল। তারা বাড়ির বিভিন্ন কোণা পরিস্কার করল, নতুন আসবাব নিয়ে এল, আর গ্রামের লোকজনের সঙ্গেও ধীরে ধীরে পরিচিত হল।লিমা, গভীর রাতে তার উপন্যাসের প্লট নিয়ে কাজ করত, আর রানা ঘুমিয়ে পড়ত কাজের ক্লান্তিতে। তবে, কিছুদিন পর থেকেই লিমা অদ্ভুত কিছু লক্ষ করতে শুরু করল।

রাতের বেলায়, যখন রানা গভীর ঘুমে থাকে, লিমা অনুভব করত যেন বাড়ির কোন এক ঘরে কেউ হেঁটে বেড়াচ্ছে। প্রথমদিকে সে ভেবেছিল, এটা তার নিজের কল্পনা—নতুন বাড়ি, একাকীত্ব, এসব থেকেই হয়তো তার মনে এমন ভাবনা আসছে। কিন্তু ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারল, এটা শুধু কল্পনা নয়। প্রতিদিন রাতেই, বাড়ির পুরোনো মেঝেতে কারও পায়ের আওয়াজ শোনা যায়, যেন কেউ ধীরে ধীরে পা ফেলে ঘরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হাঁটছে। 

লিমা প্রথমে ভয় পায়নি, বরং কৌতূহলী হয়ে উঠেছিল। সে নিজেই ভাবল, হয়তো বাড়ির পুরোনো কাঠের মেঝে থেকে এসব শব্দ আসছে। কিন্তু এই কৌতূহল খুব বেশি দিন স্থায়ী হল না। কারণ, এর কয়েকদিন পর থেকেই আরও অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে শুরু করল।

একদিন গভীর রাতে, যখন লিমা তার লেখার টেবিলে বসে কাজ করছিল, হঠাৎ তার মনে হল যেন পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। সে দ্রুত পিছন ফিরে তাকাল, কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। তবু একটা অজানা শীতল অনুভূতি তার শরীরকে গ্রাস করল। মনে হল, বাড়ির ভিতর একটা অদৃশ্য চোখ তাকে লক্ষ্য করছে। লিমা বুঝল, এটা আর কেবল কল্পনা নয়। বাড়িতে কিছু অস্বাভাবিক ঘটছে। 

পরের দিন লিমা তার অভিজ্ঞতা রানাকে বলল। কিন্তু রানা এসব কথা হাসি উড়িয়ে দিল। সে লিমাকে বোঝাল যে, এটা নতুন পরিবেশের কারণে মনে হচ্ছে, এবং এসব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে বেশি ভাবতে হবে না। রানার এই মনোভাব লিমাকে কিছুটা আহত করল, কারণ তার অনুভূতি এতটাই জোরালো ছিল যে সে তা কল্পনা বলে উড়িয়ে দিতে পারছিল না। 

তবে, রানাকে কিছু বোঝাতে না পেরে, লিমা নিজেই বাড়ির ইতিহাস নিয়ে অনুসন্ধান করতে শুরু করল। গ্রামের এক প্রবীণ মহিলার কাছ থেকে জানতে পারল, এই বাড়িতে বছর দশেক আগে আধুরী নামে এক মেয়ে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যায়। গ্রামের লোকেরা বলত, সেই মেয়েটি বাড়ির মধ্যে অদ্ভুত সব জিনিস দেখত এবং প্রতিদিনই ভয়ের কোনো অদ্ভুত অনুভূতির কথা বলত। 

এই ঘটনা শোনার পর থেকে লিমা আরও বিচলিত হয়ে পড়ল। সে অনুভব করল, আধুরীর সঙ্গে তার কোনো এক অদ্ভুত সংযোগ তৈরি হচ্ছে। তার মধ্যেও একই ধরনের ভয়ঙ্কর অনুভূতি হচ্ছে, যা আধুরীর হয়েছিল। বাড়িটিতে কি কিছু লুকিয়ে আছে? আধুরির সাথে কি ঘটেছিল? এসব প্রশ্ন লিমার মনে ঘুরতে থাকল।

গভীর রাতে, যখন লিমা ঘুমানোর চেষ্টা করছিল, সে হঠাৎ বাড়ির দরজায় কারও চাপা কণ্ঠের ফিসফিসানি শুনতে পেল। মনে হচ্ছিল, যেন কেউ তার নাম ধরে ডাকছে। সে ভয়ে শিউরে উঠল, এবং রানাকে ডাকল। কিন্তু রানা কিছুই শুনতে পেল না। 

এরপর, লিমা এক পুরোনো আলমারির মধ্যে থেকে একটি ছোট ডায়েরি আবিষ্কার করল। ডায়েরিটিতে আধুরীর লেখা ছিল। তার মধ্যে আধুরীর ভয়, তার দেখা অদ্ভুত দৃশ্য এবং নিখোঁজ হওয়ার আগের কিছু ঘটনা বর্ণিত ছিল। লিমা ডায়েরিটি পড়তে পড়তে বুঝল, বাড়ির মধ্যে কিছু অশুভ শক্তি কাজ করছে, যা আধুরিকে গ্রাস করেছিল। 

গল্পটি এখানেই শেষ হয় না। লিমা আরও গভীরে প্রবেশ করতে চায়, আধুরীর নিখোঁজের রহস্য উদঘাটন করতে চায়। কিন্তু সামনে যে বিপদ অপেক্ষা করছে, তা সে এখনো পুরোপুরি বুঝতে পারেনি।

রাত যত গভীর হয়, ততই লিমার মনে হয় এই বাড়ির দেয়ালের মধ্যে কিছু লুকিয়ে আছে। প্রথমে সে ভেবেছিল, এটা তার কল্পনার খেলা। পুরোনো বাড়ির ফাঁকা ঘরগুলো থেকে এমন ফিসফাস শোনা যেতেই পারে। তবু, তার মনের এক কোণায় একটা অস্বস্তি থেকে গেল। প্রতিদিন, সন্ধ্যে নামার পর থেকেই বাড়ির পরিবেশে এক অজানা ঠান্ডা ভয় মিশে থাকত। 

রানা যখন ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়ত, তখন লিমা তার লেখার টেবিলে বসে কাজ করত। কিন্তু প্রতিদিন রাত বাড়ার সাথে সাথে তার মনোযোগ ভেসে যেত বাড়ির বিভিন্ন অস্বাভাবিক শব্দের দিকে। ঘরের কোণে কে যেন দাঁড়িয়ে থাকে, দেয়ালের ছায়াগুলো যেন ঘুরে বেড়ায়। প্রথম দিকে লিমা বিষয়টিকে আমল দেয়নি, তবে ক্রমশ সে বুঝতে পারল, বিষয়টা শুধুই তার কল্পনা নয়।

এক রাতে, যখন লিমা তার উপন্যাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় লিখছিল, হঠাৎই সে অনুভব করল ঘরের দরজার পাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। তার শরীরে একটা শীতল অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল। সে এক মুহূর্তের জন্য ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। তবুও সে অনুভব করল, ঘরে যেন কেউ ছিল। দেওয়ালের ছায়াগুলো যেন তার দিকে চেয়ে আছে। 

“রানা!” লিমার চিৎকার করে ডাকল, কিন্তু রানা তখন গভীর ঘুমে ছিল। সে সাড়া দিল না। লিমা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকল, ঘরের পরিবেশটা যেন তাকে বেঁধে ফেলছিল। 

পরের দিন সকালে, লিমা রানাকে আগের রাতের অভিজ্ঞতা বলার চেষ্টা করল। কিন্তু রানা এসব কথায় কান দিল না। তার মতে, পুরোনো বাড়িতে এ ধরনের শব্দ হওয়া স্বাভাবিক। “এতটা ভেবো না লিমা, নতুন জায়গায় গেলে এমনটা মনে হয়,” রানা শান্ত গলায় বলল।

কিন্তু লিমা জানত, এসব কিছু সাধারণ নয়। সে আবার বাড়ির বিভিন্ন ঘরে খুঁজতে শুরু করল, আর সেই সময়েই বাড়ির পুরোনো আলমারির মধ্যে সে পেল একটি পুরানো ডায়েরি। ডায়েরির পাতা হলুদ হয়ে গেছে, প্রায় ছিঁড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। প্রথমে লিমা ভাবল, এটা হয়তো বাড়ির আগের বাসিন্দাদের কোনো জিনিস। কিন্তু ডায়েরির প্রথম পাতাটি পড়ার সাথে সাথেই তার গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল। 

ডায়েরিটি ছিল আধুরী নামের এক মেয়ের, যে এই বাড়িতে বহু বছর আগে থাকত। ডায়েরির প্রতিটি পাতায় লেখা ছিল আধুরীর ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা। সে অনুভব করত, এই বাড়িতে কিছু অশুভ শক্তি আছে, যা ধীরে ধীরে তার জীবন গ্রাস করছিল। লিমা ডায়েরির পাতায় পাতায় আধুরীর কথা পড়তে শুরু করল। 

আধুরী লিখেছে, “প্রতিদিন রাতের বেলা আমি অদ্ভুত ফিসফিসানি শুনি, যেন কেউ আমার নাম ধরে ডাকছে। দেয়ালের ছায়াগুলো আমাকে ঘিরে ধরে, আমি যেদিকেই তাকাই, তারা আমাকে অনুসরণ করে। আমি এই বাড়ি থেকে বের হতে চাই, কিন্তু কীভাবে?”

লিমার মনে হতে লাগল, আধুরীর অভিজ্ঞতাগুলো যেন তার নিজের জীবনেও ঘটছে। এই বাড়ির অশুভ শক্তি কি তাকে গ্রাস করতে শুরু করেছে? ডায়েরির মধ্যের দিকে আধুরী লিখেছিল, “আমি জানি, তারা আমাকে নেবে। আমি আর পালাতে পারব না। এই বাড়ি আমাকে ছেড়ে দেবে না।”

ডায়েরিটি পড়ার পর লিমা পুরোপুরি হতবাক হয়ে গেল। সে বুঝতে পারল, আধুরী এই বাড়ির মধ্যে নিখোঁজ হয়েছে, এবং হয়তো তার আত্মা এখনও এখানে বন্দী। লিমার মন কিছুতেই শান্ত হচ্ছিল না। সে ডায়েরি হাতে নিয়ে বসে রইল, কিন্তু তার মাথার মধ্যে যেন একের পর এক ভয়ঙ্কর প্রশ্ন আসতে লাগল। 

সেই রাতে লিমর ঘুমাতে চেষ্টা করল, কিন্তু তার চোখের পাতায় ঘুম এল না। বারবার মনে হচ্ছিল, ঘরের কোণে কেউ দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে। দেওয়ালের ছায়া যেন ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে, তার দিকে এগিয়ে আসছে। আর সেই অদ্ভুত ফিসফাস—যেন তার নাম ধরে কেউ ডাকছে, খুব ধীরে ধীরে, অন্ধকারের মধ্য থেকে।

“লিমা…” 

সে উঠে বসল। এবার আর ভুল নয়। রানা গভীর ঘুমে, কিন্তু লিমা স্পষ্ট শুনতে পেল, কেউ তার নাম ধরে ডাকছে। ঘরের ভেতর শীতল হাওয়া বইছে, তার সারা শরীর কেঁপে উঠল। সে উঠে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজা খোলার চেষ্টা করল, কিন্তু দরজা যেন আটকে গেছে। 

হঠাৎই দরজার ওপাশ থেকে তীব্র ঠকঠকানোর শব্দ এল। যেন কেউ দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে মরিয়া হয়ে ঢুকতে চাইছে। লিমা আতঙ্কে পেছনে সরে গেল, আর সেই মুহূর্তেই দরজা খুলে গেল। কিন্তু দরজার ওপাশে কেউ ছিল না। তবু দরজার খোলা অংশ থেকে ঠান্ডা বাতাস ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। 

লিমার মনে হল, যেন এই বাড়ি তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে। আধুরীর মতো, সে কি এই বাড়ির ফাঁদে পড়ছে? তার মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরতে লাগল—এই বাড়ির শেষ পরিণতি কী হতে চলেছে? 

লিমার মাথার ভেতরে যেন একটা ভয়ঙ্কর ঝড় উঠেছে। আধুরীর ডায়েরির প্রতিটি শব্দ তার মধ্যে গভীরভাবে ঢুকে পড়েছে। প্রতিদিন রাতের অন্ধকারে সে অনুভব করে, এই বাড়ির দেয়ালগুলোর মধ্যে আধুরীর ভয়াবহ অভিজ্ঞতাগুলো প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। বাড়িটা কেমন যেন শ্বাস নিচ্ছে, তার প্রতিটি পদক্ষেপ অনুসরণ করছে। 

রানা অবশ্য লিমার এই কথাগুলোকে পাত্তাই দিচ্ছে না। সে মনে করছে, এটা লিমার অতিরিক্ত চিন্তার ফলাফল। “তুমি সবকিছু কল্পনা করছ, লিমা। একটা পুরোনো বাড়ি, নির্জনতা—এসব মিলে মস্তিষ্ক একটু খেলা করে, বুঝলে? এমনটা হতেই পারে,” রানা বলল।

কিন্তু লিমার মনকে শান্ত করা কঠিন। প্রতিদিন রাতে তার ভেতর এক অদ্ভুত অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে। ঘরের কোণে ছায়াগুলো যেন তাকে দেখছে, দেয়ালের পেছন থেকে একটা অদৃশ্য চোখ তাকে অনুসরণ করছে। আর সেই ফিসফাস—সেটা থামছে না। কখনও তার নাম, কখনও অজানা শব্দ, যা শুধু অন্ধকারের মধ্যে ভেসে আসে।

এক রাতে লিমা রানাকে বলল, “রানা, আমি সত্যিই জানি না কী হচ্ছে, কিন্তু এই বাড়িতে কিছু একটা অস্বাভাবিক আছে। আমি আধুরীর ডায়েরিটা পড়েছি, আর আমি জানি তার সঙ্গে যা ঘটেছিল সেটা আমার সঙ্গেও ঘটতে শুরু করেছে।”

“তুমি কি আমাকে বলছ, এই বাড়ি তোমার উপর কিছু করছে?” রানা অবিশ্বাসের হাসি হেসে বলল। “এসব অদ্ভুত কথা বন্ধ করো, লিমা। এটা আমাদের নতুন বাড়ি, আমাদের নতুন জীবন। তুমি কেন এমন অযথা ভয় পাচ্ছ?”

লিমা ভেতরে একটা গভীর অসন্তোষ জমতে লাগল। সে বুঝতে পারল, রানা তার কথায় বিশ্বাস করবে না। তাদের মধ্যে দূরত্ব ক্রমেই বাড়তে থাকল, আর লিমার ক্রমশ একাকী হয়ে পড়ল। তার প্রতিটি রাত এক অবর্ণনীয় আতঙ্কে পরিণত হচ্ছিল। 

ডায়েরির পাতাগুলো আরও গভীরে পড়তে শুরু করল মঞ্জরী। ললিতা লিখেছিল, “আমি রাতে আর ঘুমোতে পারি না। অন্ধকারে দেওয়ালের ছায়াগুলো বড় হতে থাকে, তারা আমাকে ধরে ফেলার চেষ্টা করে। আমি জানি, কিছু একটা আমার পেছনে রয়েছে। প্রতিদিন রাতে, যখন সবাই ঘুমিয়ে থাকে, তখন সে আসে।”

লিমার ভেতরে এক অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগল। সে যেন আধুরীর সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে পড়েছে। তারও তো একই অভিজ্ঞতা হচ্ছে। সেই অজানা ছায়াগুলো, সেই অদ্ভুত অনুভূতি—সবকিছু যেন তাকে আধুরীর পথেই নিয়ে যাচ্ছে। 

এক রাতে, লিমা শুয়ে থাকার সময় হঠাৎ অনুভব করল, ঘরের দরজার ওপাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। দরজা পুরোপুরি বন্ধ ছিল, কিন্তু লিমা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারল, কারও উপস্থিতি আছে। সে উঠে দরজার কাছে গেল, আর দরজার ওপাশ থেকে একটা চাপা ফিসফাস শুনতে পেল। যেন কেউ ধীরে ধীরে তার নাম ধরে ডাকছে—”লিমা…”

তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। সে দরজা খুলে দিল, কিন্তু দরজার ওপাশে কাউকে দেখতে পেল না। ঘরের ভেতরে যেন শীতল হাওয়ার ঢেউ ঢুকে পড়ল। মঞ্জরী দরজার কাছে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল, কিন্তু কিছুই ঘটল না। শুধু একটা অদ্ভুত ঠান্ডা তার চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। 

সেই রাতেই লিমা সিদ্ধান্ত নিল, সে আধুরীর নিখোঁজ হওয়ার রহস্য উদঘাটন করবে। এই বাড়িতে আসার পর থেকেই তার মনে হয়েছে, ললিতার আত্মা এখানেই কোথাও বন্দী রয়েছে। আর সে মুক্তি চায়। কিন্তু প্রশ্ন হল, কীভাবে?

পরের দিন সকালে, লিমা গ্রামে আদুরীর পরিবারের কোনো খবর পাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু গ্রামের কেউই ভালোভাবে কিছু বলতে পারল না। আদুরীর পরিবার অনেক বছর আগে এই গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। তারা মেয়েটির নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে আর কখনও ফিরে আসেনি। তবে গ্রামের একজন বৃদ্ধা মহিলার কাছ থেকে লিমা একটি চমকপ্রদ তথ্য পেল। 

“আদুরী একদিন হঠাৎ করেই নিখোঁজ হয়ে যায়। তার পরিবার অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কিছুই পায়নি। কিন্তু গ্রামে একটা কথা প্রচলিত আছে যে, এই বাড়ির মধ্যে কিছু একটা আছে—একটা অশুভ শক্তি, যা মানুষকে ধরে ফেলে। ললিতা তার শিকার হয়েছে,” বৃদ্ধা ফিসফিস করে বলল।

লিমার গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল। বৃদ্ধার কথা শুনে সে বুঝতে পারল, আদুরীর গল্পটা শুধু ডায়েরিতেই সীমাবদ্ধ নয়। এই বাড়ির ইতিহাসের ভেতরে একটা অন্ধকার সত্য লুকিয়ে আছে। 

লিমা আরও গভীরভাবে ভাবতে শুরু করল। সে জানত, এই রহস্যের সমাধান তাকে করতেই হবে। আর তার মন ক্রমশ দৃঢ় হচ্ছিল আদুরীর সাথে যা ঘটেছিল, সেটা সে নিজে অনুভব করছে। সে জানত, তার সামনে কঠিন পথ রয়েছে, কিন্তু সে এই বাড়ির অন্ধকার কে উন্মোচন করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। 

কিন্তু লিমা তখনও জানত না, কী ভয়াবহ বিপদ তার সামনে অপেক্ষা করছে। বাড়িটা যেন ধীরে ধীরে তার মনের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে। আর সামনে যে অশুভ শক্তির সঙ্গে তার মোকাবিলা হতে চলেছে, তা সে কল্পনাও করতে পারেনি।

লিমা গভীর রাতে ঘুমোতে পারছিল না। ডায়েরির প্রতিটি শব্দ তার মনের গভীরে এমনভাবে গেঁথে গেছে যে চোখ বন্ধ করলেই সে আদুরীর চেহারা, ভয়ঙ্কর সব দৃশ্য দেখতে পায়। আদুরীর জীবন যেন লিমার ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিনের মতোই সেদিন রাতেও সে শুয়ে পড়ল, কিন্তু তার মনে হচ্ছিল, ঘরের প্রতিটি কোণ থেকে অজানা চোখ তাকে লক্ষ্য করছে।

রানা ঘুমিয়ে ছিল গভীর নিদ্রায়, কিন্তু লিমা এক মুহূর্তের জন্যও শান্তি পাচ্ছিল না। ঘরের বাইরে থেকে হালকা একটা ফিসফিস শব্দ শোনা গেল—“লিমা…”। তার সারা শরীর শীতল হয়ে গেল, যেন হিমশীতল হাওয়ায় আচ্ছন্ন। সে চোখ বন্ধ করে শ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে থাকল, কিন্তু শব্দ থামল না। 

তারপর হঠাৎই, একটা দৃশ্য তার চোখের সামনে উদ্ভাসিত হলো। সে দেখতে পেল একটা ছোট্ট মেয়ে, পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে, তার সাদা ফ্রকের পেছন থেকে দীর্ঘ চুল ছড়িয়ে পড়েছে মাটিতে। মেয়েটি হঠাৎই ঘাড় ঘুরিয়ে লিমার দিকে তাকালো। সেই চোখের দৃষ্টিতে ছিল অপার আতঙ্ক এবং সাহায্য চাওয়া আকুতি। 

লিমা ঘামতে শুরু করল। এটা ছিল এক দুঃস্বপ্নের মতো, কিন্তু তবুও অত্যন্ত বাস্তব মনে হচ্ছিল। তার হাত-পা যেন জমে গিয়েছিল, আর সে সেখান থেকে পালাতে চাইছিল, কিন্তু পারছিল না। সে মেয়েটার চোখ থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারছিল না। আর তখনই হঠাৎ মেয়েটা বলে উঠল, “আমাকে মুক্তি দাও।”

লিমা চিৎকার করতে গিয়েও পারল না। তার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরোল না। ঘরের প্রতিটি দেওয়াল যেন তার দিকে এগিয়ে আসছে। সেই অদ্ভুত ভয়ঙ্কর দৃষ্টির ভারে লিমার মাথা ঘুরে যাচ্ছিল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে, মেয়েটা হাওয়ার মতো মিলিয়ে গেল।

লিমা কাঁপতে কাঁপতে উঠে বসল। তার শরীর জুড়ে ঘাম। সে জানত, এই দুঃস্বপ্ন কেবলমাত্র তার মনের খেল নয়, বরং আদুরী তাকে কিছু বলতে চাইছে। ডায়রির কথা মনে পড়তেই সে উঠে সেটা হাতে নিল। সে আরও কিছুটা পড়তে শুরু করল। 

ডায়েরিতে লেখা ছিল: “প্রতিদিন রাতে আমি তাকে অনুভব করি। সে ঘরের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে আমার পাশে দাঁড়ায়। আমি পালাতে চাই, কিন্তু আমার পা চলে না। সে যেন আমার প্রাণশক্তি শুষে নিচ্ছে। তার চোখে এমন কিছু আছে যা আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। আমি জানি, আমি বাঁচব না। কিন্তু আমি মুক্তি চাই। কেউ যদি আমার কথা শুনতে পায়, তবে তাকে সাহায্য করতে হবে।”

লিমা ডায়েরির এই লেখাটা পড়ে ভীষণভাবে হতবাক হয়ে গেল। আদুরীর অভিজ্ঞতা আর ল মার বর্তমান অবস্থা যেন হুবহু মিলে যাচ্ছে। 

সে তাড়াতাড়ি সুমনকে জাগানোর চেষ্টা করল। “সুমন, উঠো! তোমাকে কিছু দেখাতে হবে।” 

রানা বিরক্ত হয়ে বলল, “আবার কী হলো, লিমা? কেন আমাকে এভাবে জাগাচ্ছ?”

লিমা ডায়েরিটা তার হাতে দিয়ে বলল, “আদুরীর কথা বিশ্বাস করো। তার সঙ্গে যা ঘটেছিল, সেটা আমার সঙ্গেও ঘটছে। আমি প্রতিদিন রাতে তাকে দেখতে পাচ্ছি, তার কষ্টের অনুভূতি আমার ওপর ভর করছে। তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে হবে, রানা।”

রানা ধীরে ধীরে ডায়েরির পাতা উলটে পড়তে থাকল। তবে তার মুখে কোনো আবেগ দেখা গেল না। “এটা শুধু তোমার কল্পনা, লিমা। তুমি বেশি ভেবে ফেলছ। ডায়েরির লেখা আর তোমার মাথার মধ্যেকার অতিরিক্ত চিন্তার মিশ্রণে এই সব হচ্ছে। এটা মানসিক চাপের ফলাফল।”

লিমা হতাশ হয়ে চুপ করে রইল। সে জানত রানা কিছুতেই তাকে বিশ্বাস করবে না। কিন্তু তার নিজের বিশ্বাস ক্রমশ দৃঢ় হচ্ছিল যে এই বাড়িতে একটা অশুভ শক্তি আছে, আর সেটা তাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। 

সেদিন রাতে লিমা আরও ভয়ানক কিছু দেখতে পেল। সে শুয়ে ছিল, আর হঠাৎ করেই তার শরীর অসাড় হয়ে গেল। সে নিজেকে নাড়াতে পারছিল না, চোখ খুলে রাখতে পারছিল না। তখন তার ভেতর দিয়ে একটা অদ্ভুত অনুভূতি বয়ে গেল। যেন তার শরীরের ওপর দিয়ে কেউ ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে। তারপর, সে অনুভব করল তার গলার ওপর চাপ পড়ছে। 

সে চোখ খুলে দেখল, আদুরী তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সেই একই চোখ, সেই একই ভয়। লিমা তার দিকে তাকিয়ে দেখল আদুরীর ঠোঁট নড়ে উঠল—“আমাকে মুক্তি দাও…”

লিমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। তার সমস্ত শক্তি দিয়ে সে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু কোনোভাবেই সে উঠতে পারছিল না। হঠাৎই সবকিছু মিলিয়ে গেল। সে হাঁফাতে হাঁফাতে উঠে বসল। তার মনে হচ্ছিল, যেন সে কিছুক্ষণ আগেই মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে।

ডায়েরির কথা মনে পড়তেই সে বুঝতে পারল, এই অশুভ শক্তি শুধু ললিতার নয়, তার নিজের জীবনকেও ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। সে জানত, আদুরী তাকে কিছু বলতে চাইছে, কিছু জানাতে চাইছে। 

কিন্তু কীভাবে? কী সেই রহস্য যা আদুরী দিয়ে যেতে চেয়েছিল? আর কেন এই বাড়ি তার ওপর এমন প্রভাব ফেলছে?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে লিমা আরও গভীরে নামতে বাধ্য হবে। এই অন্ধকার বাড়ির প্রতিটি কোণ, প্রতিটি দেওয়াল যেন কিছু লুকিয়ে রেখেছে, যা সে ধীরে ধীরে আবিষ্কার করবে। 

কিন্তু সামনে অপেক্ষা করছে আরও ভয়ঙ্কর কিছু, যা সে তখনও কল্পনাও করতে পারেনি। 

রাত গভীর থেকে গভীরতর হয়ে আসছিল। লিমা বিছানায় শুয়ে আছে, কিন্তু তার মনে শান্তি নেই। ঘরের চারপাশের অন্ধকার যেন তাকে গিলে খেতে চাইছে। সেই ফিসফিস শব্দটা আবার কানে এলো—”লিমা…”। 

সে আচমকা উঠে বসে চারপাশে তাকাল। ঘরের মধ্যে এমন কিছু নেই যা চোখে পড়ার মতো। কিন্তু মন যেন বিশ্বাস করতে চাইছিল যে এখানে কিছুর অস্তিত্ব আছে। সে চোখ বন্ধ করল, কিন্তু সেই সময়েই একটা ধাতব শব্দ শোনা গেল—কিছু যেন লোহার দরজার সাথে ঘষা খাচ্ছে। তার হৃদস্পন্দন দ্রুত হতে লাগল।

ঘরের অন্ধকারে হঠাৎ করেই আদুরীর ছায়া দেখা দিল। সে তার ছোট্ট হাত তুলে লিমার দিকে ইশারা করল, যেন কিছু বলার চেষ্টা করছে। “সাহায্য করো…” সেই মৃদু কণ্ঠস্বর শোনা গেল। আদুরীর মুখে বিষাদের ছাপ, তার চোখে এক অদ্ভুত আতঙ্ক। লিমার শরীর জমে গেল। সে উঠে দাঁড়াতে চেয়েও পারল না, যেন অদৃশ্য কিছু তাকে আঁকড়ে ধরেছে।

আতঙ্কে ঘেমে নেয়ে লিমার ঘুম ভাঙল। এটা ছিল একটা স্বপ্ন, কিন্তু এতটাই বাস্তব মনে হচ্ছিল যে সে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। সেই স্বপ্নের ভেতরকার ভয়াবহতা তাকে বাস্তবের চেয়েও বেশি আতঙ্কিত করেছিল। সে অনুভব করল, এই স্বপ্ন কেবল একটি স্বপ্ন নয়। আদুরী তাকে কিছু বলতে চাইছে, তাকে মুক্তি চাইছে।

পরের দিন সকালে লিমা উঠে ডায়েরিটা আবার পড়তে বসল। ডায়েরির প্রতিটি পাতায় আদুরীর ভয়, আতঙ্ক আর অসহায়তার চিহ্ন স্পষ্ট। কিন্তু আজ সে এমন কিছু খুঁজে পেল যা আগে সে লক্ষ্য করেনি। একটা পাতায় লেখা ছিল: “বাড়িটা আমার নয়, আমি এর বন্দী। এই জায়গায় অশুভ কিছু আছে। এটা আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাকে আটকে রেখেছে। আমি পালাতে চাই, কিন্তু পারছি না। যে-ই এখানে আসে, তার হৃদয়ের গভীর শঙ্কা আর হতাশা সেই শক্তিকে আরও বেশি শক্তিশালী করে তোলে।”

লিমার মাথার ভেতর দিয়ে শীতল একটা অনুভূতি বয়ে গেল। আদুরীর এই লেখার সঙ্গে তার বর্তমান অভিজ্ঞতার মিল একেবারে স্পষ্ট হয়ে উঠল। সে বুঝতে পারল, এই বাড়িটা কেবল পুরোনো একটা স্থাপনা নয়, এটা কিছুর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সেই অশুভ শক্তি, যা ললিতাকে বন্দী করে রেখেছে, আজ লিমার জীবনেও প্রবেশ করতে চাইছে।

ডায়েরির পরের পাতায় আরেকটি লেখা ছিল: “আমি একা নই। এখানে যারা আসে, তারাও এই ফাঁদে পড়ে। অন্ধকার আমাকে গ্রাস করে নিয়েছে। কিন্তু আমি এখনও আশা ছাড়িনি। যদি কেউ আমার কথা শুনতে পায়, তবে দয়া করে আমাকে মুক্তি দাও।”

লিমা ডায়েরির লেখা পড়তে পড়তে একটা অদ্ভুত ভয় অনুভব করছিল। তার চারপাশের পরিবেশও যেন ভারী হয়ে উঠছিল। মনে হচ্ছিল, বাড়ির প্রতিটি কোণ থেকে সেই অশুভ শক্তি তাকে দেখছে, তাকে ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। 

রানা তখনও এসব ঘটনাকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছিল না। সে লিমার এই অস্বাভাবিক আচরণকে মানসিক চাপের ফল বলে মনে করছিল। কিন্তু লিমা জানত, এই ভয়ানক পরিস্থিতি কেবল তার মনের কল্পনা নয়। আদুরীর সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতাগুলি সত্যি, আর লিমার উপরও তা ঘটতে শুরু করেছে।

সেদিন রাতে আবার কিছু অস্বাভাবিক ঘটনার মুখোমুখি হলো লিমা। ঘুমের মধ্যে সে অনুভব করল যে তার চারপাশে কিছু অদ্ভুত এবং শক্তিশালী কিছু আছে। তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছিল, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে আটকে রেখেছে। সে দেখতে পেল ললিতা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, চোখে ভীতির ছাপ, আর ঠোঁটে সেই একই কথা—“আমাকে মুক্তি দাও…”

লিমার মন আচ্ছন্ন হয়ে গেল। সে বুঝতে পারছিল না কীভাবে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করবে। ললিতা কি সত্যিই তাকে সাহায্য চাইছে, নাকি তার নিজের আতঙ্ক তাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে? 

হঠাৎ করেই একটা অদ্ভুত শীতল হাওয়া ঘরের মধ্যে ঢুকল। মঞ্জরী দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল, দরজা অল্প ফাঁক হয়ে গেছে, আর সেখান থেকে কেমন যেন একটা অদ্ভুত আলোর ঝলকানি। সেই আলোতে মঞ্জরী দেখতে পেল একটা দীর্ঘ ছায়া ঘরের ভেতর দিয়ে হাঁটছে, কিন্তু সে কিছুই স্পষ্টভাবে বুঝতে পারল না।

তখনই, লিমার মাথায় একটা নতুন চিন্তা এলো। আদুরী বলেছিল, “এই বাড়িটা তার নয়, বরং বাড়ি তাকে বন্দী করে রেখেছে।” তবে বাড়িটা ঠিক কীভাবে এমন অশুভ হয়ে উঠল? এই বাড়ির ইতিহাস কী? 

লিমা তখনই সিদ্ধান্ত নিল, তাকে এই বাড়ির পুরো ইতিহাস খুঁজে বের করতে হবে। সে বুঝতে পারছিল, আদুরী শুধু তাকে সাবধান করতে চাইছে না, বরং তাকে কিছু জানাতে চাইছে যা এই ভয়ঙ্কর রহস্যের চাবিকাঠি হতে পারে।

কিন্তু সামনে কী অপেক্ষা করছে, লিমা তখনও জানত না

রাতের অন্ধকার গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। লিমা বিছানায় শুয়ে কষ্ট পাচ্ছে। তার শরীর যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে, মনে হচ্ছে, এক অদৃশ্য শক্তি তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। গত কয়েক রাতের স্বপ্নগুলি তাকে ক্রমাগত যন্ত্রণা দিচ্ছে—অতীতের অন্ধকার এবং ভবিষ্যতের আতঙ্কের এক ভয়ঙ্কর মিলন।

এদিন রাতে, লিমা একটি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল। সে একটি বড়, পুরোনো ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরটির দেয়ালগুলি ময়লা আর ক্ষয়ে গেছে, আর সেখানে এক ধরনের অদ্ভুত সুর বাজছে। চারপাশে খুঁজে দেখলে কিছুই স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে না, শুধু অন্ধকার আর অস্পষ্ট ছায়ার এক নৃত্য। হঠাৎ,আদুরীর চেহারা লিমার সামনে উদ্ভাসিত হলো। তার চোখগুলো যেন অশান্তির গভীরতা থেকে উজ্জ্বল হচ্ছিল। 

আদুরী লিমার দিকে তাকিয়ে বলল, “এটা ভয়ঙ্কর, লিমা। বাড়ি তোমার ভয় আর দুঃখ থেকে শক্তি সংগ্রহ করে। তুমি যদি আমার মতোই না পারো, তাহলে তুমি নিজেই পরিণত হবে।” আদুরী মুখের অভিব্যক্তিতে এক ধরনের আকুতি ছিল, আর তার কথাগুলির মধ্যে এক গভীর দুঃখ। 

লিমা ভয়ার্ত চোখে আদুরীর দিকে তাকিয়ে থাকল। তার মনে হচ্ছিল, আদুরী কিছু বড় সত্য প্রকাশ করতে চাইছে, কিন্তু সে ঠিক কী বলছে তা বুঝতে পারছে না। স্বপ্নের মধ্যে একটা ভয়ঙ্কর কোলাহল শুরু হল—গলার আওয়াজ, দরজার পিটুনির শব্দ, আর ঘরের দেওয়াল থেকে আসা অদ্ভুত ফিসফিস।

সেই মুহূর্তে, লিমা ঘুম থেকে উঠে বসে পড়ল। তার হৃদস্পন্দন দ্রুত হচ্ছিল। ঘরের আলোটা টিপে জ্বালিয়ে দিল, কিন্তু ঘরটি আগের মতোই অন্ধকার আর নিরব ছিল। সেই ভয়ার্ত অনুভূতি যেন বাস্তবতার অংশ হয়ে উঠেছে। 

সকালে, লিমা রানা কে ডাকল। রানা তখনও ঘুমিয়ে ছিল, কিন্তু লিমার চিৎকারে সে উঠে এল। “রানা! আমাকে সাহায্য করতে হবে।
403 Views
9 Likes
4 Comments
5.0 Rating
Rate this: