অশরীরী রূপ

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
বিবিচিনি গ্রামটি সমুদ্রের ধারে একটি নির্জন জায়গায় অবস্থিত। দিনের বেলায় সবকিছু স্বাভাবিক থাকলেও রাত হলেই পুরো গ্রামে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে আসে। গ্রামের প্রবীণরা বলেন, এখানে কিছু একটা অশুভ আছে, যা রাতে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু মামুন কখনো এসব গল্প বিশ্বাস করেনি।

মামুন ছিল গ্রামের স্কুলের একজন শিক্ষক। সদ্য শহর থেকে ফিরে এসে সে তার দাদার পুরনো বাড়িতে থাকতে শুরু করেছে। বাড়িটি বেশ বড়, কিন্তু বহুদিন ধরে পরিত্যক্ত থাকায় চারদিকে ভাঙাচোরা। প্রথম দিন বাড়িতে প্রবেশ করতেই মামুনের মনে হলো, যেন তাকে কেউ দেখছে। বাড়ির দরজার পুরোনো কাঠের শব্দ এক অদ্ভুত গা ছমছমে অনুভূতি এনে দিল।

রাতের বেলায় মামুন পড়ার টেবিলে বসে পরের দিনের ক্লাসের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। হঠাৎই বাতাসের এক অদ্ভুত ঝাপটা এসে মোমবাতিটা নিভে গেল। চারদিকে অন্ধকার। হালকা মৃদু কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, যেন কেউ দূর থেকে ফিসফিস করে কিছু বলছে। মামুন টেবিল থেকে উঠে গিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল, কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না।

হঠাৎ করেই, দরজার বাইরে থেকে ধীর পায়ের শব্দ শোনা গেল। মামুন সাহস করে দরজা খুলে বাইরে তাকাল, কিন্তু আশপাশে কেউ নেই। দরজা বন্ধ করে ভেতরে আসতেই সে দেখতে পেল টেবিলের উপর একটি পুরনো চিঠি পড়ে আছে। চিঠিটি সে খোলার চেষ্টা করল, কিন্তু তার হাত কেঁপে উঠল। চিঠির উপর রক্তের ছোপ এবং একটি মাত্র বাক্য লেখা ছিল: "আমাকে ছাড়ো না।"

রাত গভীর হতে থাকল। মামুন চিঠির সেই লেখা নিয়ে ভাবছিল, কিন্তু তার মাথায় কোনো উত্তর আসছিল না। "আমাকে ছাড়ো না"—এই শব্দগুলো কেন তার জন্য লেখা হতে পারে, সেটি একেবারেই বুঝতে পারছিল না। মনে হলো যেন ঘরের দেয়ালগুলোও তাকে দেখছে, তার শ্বাস ভারী হয়ে উঠল।

পরদিন সকালে গ্রামবাসীদের কাছে সে এই চিঠি নিয়ে কথা বলতে চাইল। কিন্তু গ্রামের মানুষজন যেন কেমন ভীত আর গুটিয়ে ছিল। কারও চোখে চোখ পড়লেই তারা এড়িয়ে যাচ্ছিল। বৃদ্ধ মজনু চাচা, যিনি গ্রামের প্রায় সব ইতিহাস জানেন, মামুনের কথায় একটু চুপ করে থেকে বললেন, "এই বাড়িটা ভালো না বাবা। তোমার দাদার সময়েও এখানে কিসের যেন ছায়া ছিল। কেউ কিছু দেখত না, কিন্তু অনুভব করত। সাবধানে থাকো।"

মামুন কথাটা উড়িয়ে দিয়ে স্কুলে চলে গেল। সারাদিন ক্লাস নিয়ে সে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরল। সন্ধ্যায় চা খেতে খেতে আবার সেই অস্বাভাবিক অনুভূতিটা তাকে গ্রাস করল। যেন কেউ তার খুব কাছেই দাঁড়িয়ে আছে।

রাত হলো। বাড়িটা আবারো অদ্ভুত নিস্তব্ধ হয়ে গেল। মামুন মশারি টানিয়ে শুতে যাওয়ার চেষ্টা করল। চোখ বুঁজতেই হালকা বাতাসের শব্দে মশারির একপাশ দুলে উঠল। মামুন ভয় পেয়ে উঠে বসে দেখল, জানালার কপাট খুলে গেছে। কিন্তু জানালাটা সে ভালো করেই বন্ধ করেছিল।

হঠাৎ করেই ঘরের কোণে কিছু একটা নড়ে উঠল। মামুন টেবিলের পাশ থেকে লাইট নিয়ে ঘরের সেই কোণটায় তাকাল। সেখানে কোনো কিছু ছিল না। কিন্তু ঠিক তখনই পেছন থেকে হালকা নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা গেল। মামুন দ্রুত পেছনে ঘুরে তাকাল—কিন্তু সেখানে কেউ নেই।

হতভম্ব অবস্থায় টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখে, সেই চিঠিটা আবার সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছে। এবার চিঠির নিচে আরেকটি নতুন লাইন যোগ হয়েছে:
"তুমি ফিরে এসেছ, কিন্তু এখন কী করবে?"

ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে মামুন এবার বুঝল, সে এমন কিছুতে জড়িয়ে পড়েছে যার কোনো সহজ ব্যাখ্যা নেই।

পরদিন সকালে মামুন আর অপেক্ষা না করে গ্রামের মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে গেল। তিনি গ্রামে অনেকদিন ধরে আছেন এবং বিভিন্ন অদ্ভুত ঘটনার কথা শুনেছেন। মামুন পুরো ঘটনা খুলে বলল। ইমাম সাহেব গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন। তিনি বললেন, "বাড়িটা অভিশপ্ত হতে পারে। এখানে কিছু হয়েছিল- কিছু ভয়ানক। তোমার দাদার সাথে কিছু জিজ্ঞেস করেছিলে?"

মামুন জানাল, তার দাদা বহু আগে মারা গেছেন। বাড়ির ইতিহাস সম্পর্কে সে খুব বেশি কিছু জানে না। ইমাম সাহেব বললেন, "গ্রামে একজন আছেন—বয়োবৃদ্ধ ফজলু মিয়া। তিনি বাড়িটির ইতিহাস জানেন। তবে তার সাথে কথা বলার জন্য সাহস লাগবে। কারণ তিনি এসব বিষয়ে কথা বলতে ভয় পান।"
মামুন সেই সন্ধ্যায় ফজলু মিয়ার বাড়িতে গেল। ফজলু মিয়া প্রথমে কিছুই বলতে চাননি। কিন্তু মামুন বারবার জিজ্ঞেস করলে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন, "তোমার দাদার সময় একটা বড় ভুল হয়েছিল। একটা মেয়ে, যে গ্রামে কাজ করত, তাকে এই বাড়ির ভেতর জোর করে আটকে রাখা হয়েছিল। শোনা যায়, সে আত্মহত্যা করেছিল, কিন্তু তার আত্মা কখনো মুক্তি পায়নি। সেই মেয়েটা এখনো এখানে আছে।"

মামুন হতবাক হয়ে গেল। বাড়ি ফিরে সে আবার সেই চিঠি দেখল। এবার চিঠিতে লেখা ছিল:

"তুমি আমার কথা জানো। এখন কি আমায় দেখবে?"

রাতে মামুন ঠিক করল যে সে আজ জেগে থাকবে। মোমবাতি জ্বালিয়ে সে চুপচাপ বসে থাকল। রাতের প্রথম দিক শান্ত ছিল, কিন্তু রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে অদ্ভুত আওয়াজ আসতে শুরু করল। যেন ঘরের মেঝেতে কেউ হাঁটছে।

হঠাৎ করেই দরজার পাশ দিয়ে একটা ছায়া সরে গেল। মামুন দ্রুত উঠল, কিন্তু বাইরে কেউ ছিল না। সে আবার ঘরে ফিরে এল। ঠিক তখনই, জানালার কাঁচে একটা মুখ ভেসে উঠল-একটি নারীর মুখ। তার চোখ দুটো একদম ফাঁকা, যেন কেবল শূন্যতার দিকে তাকিয়ে আছে।

মামুন চিৎকার করার চেষ্টা করল, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। সেই মুখটি আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। জানালার বাইরে তাকিয়ে মামুন একটি ছায়া দেখতে পেল, যা বাড়ির পেছনের দিকের দিকে যাচ্ছে।

পরদিন সকালে মামুন ঠিক করল, বাড়ির পেছনের অংশটা খুঁজে দেখবে। বাড়ির পেছনে গিয়ে সে একটি পুরনো কুয়ো দেখতে পেল। কুয়োর চারপাশে জং ধরা লোহার জাল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। কিন্তু জালের গায়ে রক্তের মতো দাগ লেগে আছে।

মামুন গ্রামের মাটি খুঁড়ে বের করার কিছু সরঞ্জাম নিয়ে এল। কুয়োর পাশে সে মাটি খোঁড়া শুরু করল। কিছুক্ষণ পরে, সে একটি পুরনো চিরকুট খুঁজে পেল। চিরকুটে লেখা ছিল:

"তুমি আমাকে এখানে পুঁতে দিয়েছ, কিন্তু আমি মরে যাইনি। আমার রাগ আর দুঃখ এখনো জীবিত।"

মাটি খুঁড়তে গিয়ে মামুন দেখল, একটা ছোট বাক্স আছে। সেই বাক্স খুলতেই এক ভয়ংকর গন্ধ বেরোল। বাক্সের ভেতর থেকে বের হলো নারীর চুলের গোছা আর কিছু পোড়ানো কাপড়। মামুন বাক্সটা দ্রুত বন্ধ করে দিল।

ঠিক তখনই, বাড়ির ভেতর থেকে এক নারীকণ্ঠ ভেসে এলো, "মামুন, তুমি কী খুঁজছ?"
মামুন বাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, দরজার সামনে সেই নারী দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে বিকৃত হাসি।
চলবে........!!!
445 Views
18 Likes
7 Comments
4.9 Rating
Rate this: