চর জাঙ্গালিয়া, মেঘনার কোল ঘেঁষে এক শান্ত গ্রাম, যেখানে ইয়ানুরের শৈশব কেটেছে। টিনের ছাদের ছোট্ট ঘর, নারকেল গাছের ছায়া আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা এই গ্রামে তার জীবন ছিল সুখী ও নিরবিচ্ছিন্ন। বাবা-মায়ের আদর-ভালোবাসায় ঘেরা এক সুন্দর পৃথিবী ছিল তার।
ইয়ানুরের শৈশবের একটি বিশেষ স্মৃতি ছিল তার কবুতর। ছোটবেলা থেকেই সে কবুতর পালন করত। প্রতিদিন সকালে সে কবুতরগুলোর খাঁচা খুলে দিত, আর তারা মুক্ত আকাশে উড়ে যেত। সেগুলো তার কাছে যেন জীবনের প্রতীক হয়ে উঠেছিল—মুক্ত, শান্তিপূর্ণ এবং স্নিগ্ধ।
তবে শৈশবের সবচেয়ে মধুর স্মৃতি ছিল তার মায়ের রান্নার গন্ধ। বাড়ির ছোট্ট রান্নাঘর থেকে উড়ে আসা মসলার গন্ধ তার মনকে এক অদ্ভুত শান্তি দিত। মায়ের হাতে তৈরি ভাত, মাছ, শুটকি—এই গন্ধগুলো যেন শৈশবের একমাত্র নিঃশব্দ সঙ্গী ছিল। মাঝে মাঝে মা বলতেন, "তোর যে রান্নার প্রতি ভালোবাসা, তোর জীবনে সব সময় খাবারের ভালোবাসা থাকবে।"
একদিন ইয়ানুরের বাবা তাকে বললেন, “মেয়ে, তোর জন্য একজন ভালো ছেলে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। আমরা ভাবলাম, তোর জন্য বিয়ের ব্যবস্থা করা যাক।” ইয়ানুর কিছুটা অবাক হলেও, বাবার সিদ্ধান্তে সে সম্মতি জানাল।
বিয়ের দিনটা এল। মা তাকে সুন্দর করে সাজালেন, তবে তার চোখে ছিল এক ধরনের দুঃখ। মা জানতেন, এবার তার মেয়ে এই ছোট্ট গ্রামটি ছাড়বে, ছেড়ে আসবে তাদের শৈশবের সেই নরম মাটি, রান্নাঘরের মসলার গন্ধ, উঠোন আর পুকুরপাড়।
রাকিব, ইয়ানুরের স্বামী, একজন শহরের ছেলে। বিয়ের আগে তারা একে অপরকে জানত না, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে রাকিবের ভালোবাসা আর যত্নে ইয়ানুর তার নতুন জীবনে মানিয়ে নিতে শিখল। রাকিব তার সঙ্গে ছিল প্রতিটি মুহূর্তে, তাকে আস্থার সঙ্গে জীবন শুরু করতে সহায়তা করল।
একদিন রাকিব ইয়ানুরকে জিজ্ঞেস করল,
—"তোমার শৈশবের সবচেয়ে প্রিয় স্মৃতি কী?"
ইয়ানুর হেসে বলল, "আমার কবুতর আর মায়ের রান্নার গন্ধ। তাদের দিয়ে আমার মন শান্ত হত, আর খাবারের গন্ধটা যেন আমাকে ঘিরে রাখত।"
রাকিব তার দিকে মৃদু হেসে বলল, “তুমি তোমার কবুতরের মতোই মুক্ত। আমি চাই তুমি এখানে এসে নিজের স্বপ্নগুলো উড়াতে পারো। আমি সব সময় তোমার পাশে আছি।”
রাকিবের কথা শুনে ইয়ানুর অনুভব করল, নতুন জীবনে আসলে কোনো কঠিন কিছু নেই, যদি পাশে থাকে একজন সঙ্গী যে তোমাকে ভালোবাসে। তাদের সংসার শুরু হল এক নতুন আশা নিয়ে।
ইয়ানুর এখন তার নতুন সংসারে সুখী। চর জাঙ্গালিয়া, তার শৈশবের সেই সুন্দর গ্রাম, আজও তার মনে অম্লান। কিন্তু আজ সে জানে, জীবনের আসল ঠিকানা হলো ভালোবাসা, শান্তি আর মানিয়ে নেওয়া—এগুলোই তাকে শান্তি দিয়েছে।
এ গল্প শুধু ইয়ানুরের নয়; এটি প্রতিটি মেয়ের জীবনের গল্প। শৈশবের স্মৃতির সঙ্গে ছেড়ে এসে তারা জীবনের নতুন ঠিকানা খুঁজে পায়, ভালোবাসা আর সঙ্গীকে সঙ্গে নিয়ে তাদের পথচলা হয়ে ওঠে সুখী ও সুন্দর।