আলোর ডাক

আমাদের গল্পের নায়ক, অর্ণব, একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। চাকরির জন্য বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে সে। বছর পাঁচেক আগে তাকে একটি প্রকল্পের জন্য একটা ছোট্ট শহরে যেতে হয়েছিল। কোম্পানি থেকে বলা হয়েছিল, প্রায় তিন মাস সেখানে থাকতে হবে। তাই শহরের এক কোণে একটা ছোট বাড়ি ভাড়া করে থাকার ব্যবস্থা করে ফেলে সে।

বাড়িটা বেশ বড়সড় ছিল। একটু পুরনো, কিন্তু চারপাশে বেশ সবুজ গাছপালা। বাড়িটা দেখে তার ভালোই লেগেছিল। ভাড়াটে যে বাড়ির মালিক ছিলেন, তিনি অবশ্য কিছুটা অদ্ভুত। ভাড়া চুক্তি সই করার সময় তিনি অনেকবার বলেছিলেন, "বাড়িটা ভালো, কোনো সমস্যাই নেই, তবে তুমি যদি রাতের বেলা বাইরে বের হও, তাহলে কোনো একটা আলো দেখতে পাবে, সেই আলোর পেছনে যেও না।"

অর্ণব তখন সেই কথাগুলো শুনে একটু অবাক হয়েছিল, কিন্তু কোনো গুরুত্ব দেয়নি। তার বিশ্বাস ছিল না এসব ভূতপ্রেতের ব্যাপারে। সে ভাবল হয়তো গ্রাম্য গুজব।

সপ্তাহখানেক কাটল বেশ আরামে। রাতের বেলা কাজ থেকে ফিরে এসে ভাত খেয়ে ঘুমোত অর্ণব। সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল, কিন্তু হঠাৎ এক রাতে একটা অদ্ভুত কিছু ঘটল।

সেদিন রাতের বেলা কাজ শেষ করে বাইরে একটু হাঁটতে বেরিয়েছিল সে। দূরে গাছপালার ফাঁক দিয়ে একটা আলোর মতো কিছু দেখল, যেন কেউ লণ্ঠন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অর্ণব প্রথমে ভাবল, গ্রাম্য কেউ হয়তো পাশের বাড়ির দিকে যাচ্ছেন। কিন্তু আলোটা একটু একটু করে তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল, আর আস্তে আস্তে বেড়েই চলল। অর্ণব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। বাড়ির মালিকের কথাটা মনে পড়ল তার, কিন্তু এখন তো দৌড়ে পালানো ছাড়া কোনো উপায় নেই।

আলোটা এখন তার থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে। সে মনে সাহস এনে জিজ্ঞেস করল, "কে আছো?" কোনো সাড়া পেল না। এরপর অর্ণব তার ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে আলোটা দেখতে চেষ্টা করল। তখনই সে যা দেখল, তার বুকের রক্ত যেন জমে গেলো।

আলোটা কারও হাতে ছিল না। একটা সাদা আলো, বাতাসে ভাসছে। এক মুহূর্তের মধ্যে আলোটা তার দিকে এগিয়ে এসে এমনভাবে ঘিরে ধরল যে সে যেন কুয়াশায় ঢেকে গিয়েছিল। চারপাশের সবকিছু ঝাপসা লাগতে লাগল, আর তারপর সে কিছু শুনতে পেল। যেন অনেকগুলো কণ্ঠস্বর একসাথে ফিসফিস করে বলছে, "আমাদের সাথে এসো... আমাদের মুক্তি দাও..."

ভয়ে দৌড়ে বাড়ির দিকে ছুটল অর্ণব। বাড়ির দরজা বন্ধ করে যখন বিছানায় বসে হেঁচকি তুলতে তুলতে শ্বাস নিচ্ছিল, তখন তার মনে হলো, একটা ভারি নিঃশ্বাস তার পাশে বসেই ফেলল। কোনো অদৃশ্য কিছু তার খুব কাছে।

পরের দিন সকালে মালিকের কাছে সব খুলে বলল অর্ণব। তখন মালিক জানালেন, প্রায় একশো বছর আগে এই অঞ্চলে একটা ট্রেন দুর্ঘটনায় বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। সেই দুর্ঘটনায় মৃত লোকগুলোর আত্মা নাকি এই আলোর মধ্যে বাস করে। যারা সেই আলো দেখতে পায়, তারা বুঝে ওঠার আগেই আলো তাদের জীবনীশক্তি শুষে নিয়ে যায়।

অর্ণব এর পরপরই বাড়িটা ছেড়ে দেয়।