ভয়ংকর পরির প্রেম শেষ পর্ব

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
সালটা ২০১৩ রাফি অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠলেও তার মানসিক অবস্থা আগের মতো ছিল না। বিজয়পুরের শীতল রাতগুলো যেন ক্রমশ ভয়াবহ হয়ে উঠছিল। দিনের আলো ম্লান হয়ে আসতেই তার মনে অজানা শঙ্কা বাসা বাঁধত। গ্রামের মানুষজন জানত, রাফির উপর কিছু অশুভ শক্তির প্রভাব রয়েছে, কিন্তু কেউই সাহস করে সেসব বিষয়ে কথা বলত না।

এক রাতে, যখন শীতের কুয়াশা চারদিকে ঘিরে ধরে, রাফি তার ঘরের ভেতর অনুভব করে হিমশীতল বাতাস। জানালা বন্ধ, তবু সেই বাতাস যেন তার শরীর ভেদ করে যায়। কানে আসে চাপা কান্নার শব্দ, যেন কেউ তার পাশেই কাঁদছে। কিন্তু ঘরে তো কেউ নেই! রাফি আলো জ্বালিয়ে খুঁজতে শুরু করে, তার চারপাশে কিছুই নেই, অথচ কান্নার শব্দটা বাড়তে থাকে। হঠাৎ একটা পায়ের শব্দ শোনা যায়। ভারী, স্থির পদক্ষেপ, যেন কোনো ভারী কিছু ধীরে ধীরে তার ঘরের দিকে এগিয়ে আসছে। রাফি ভয় পেয়ে যায়, দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে। দরজার ফাঁক দিয়ে একটা ছায়ামূর্তি ঢুকে পড়ে।

"তুই আমার থেকে পালাতে পারবি না, রাফি," কণ্ঠটা গাঢ়, ভৌতিক।

রাফি চিৎকার করতে চায়, কিন্তু গলা দিয়ে শব্দ বেরোয় না। সেই ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসে। সে দেখতে পায়, ছায়ামূর্তিটার মুখ নেই, কিন্তু চোখ দুটো আগুনের মতো জ্বলছে। ছায়াটা আরও কাছে আসে, তার হিমশীতল স্পর্শ যেন রাফির আত্মাকে কাঁপিয়ে দেয়। তখনই মেঝের ওপর কিছু একটা পড়ে। রাফি নিচে তাকিয়ে দেখে, লাল শাপলার ফুল। সেই ফুলগুলো চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে, ঘরটা যেন ভরে যাচ্ছে লাল শাপলায়।

এদিকে গ্রামের মানুষজন রাফির এই অদ্ভুত আচরণ দেখে ভয় পেতে শুরু করে। রাফির বাবা-মা সিদ্ধান্ত নেয়, তাকে গ্রামের বাইরে নিয়ে গিয়ে সাহায্য চাইবে। কিন্তু রাফির নানারা মানা করেন, তারা বলেন, "এই সমস্যার সমাধান এখানেই করতে হবে। বাইরে নিয়ে গেলে আরো বড় বিপদ হতে পারে।"

পরের দিন বিকেলে রাফির মা যখন একা ঘরে কাজ করছিলেন, তখন হঠাৎ করেই অন্ধকার নামে। দিনের বেলা হলেও সবকিছু কেমন গাঢ় হয়ে আসে। তিনি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখেন, দূরে এক মেয়ের ছায়ামূর্তি। মেয়েটার গায়ে লাল শাড়ি, তার চারপাশে লাল শাপলার মালা। মেয়েটা নীরবে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তার চোখে লাল আগুনের ঝলকানি। রাফির মা দৌড়ে বাইরে যেতে চায়, কিন্তু দরজাটা হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায়। ঘরে শ্বাসরুদ্ধকর একটা অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে, যেন কোনো শক্তি ঘরটাকে আঁকড়ে ধরেছে।

রাতে, রাফি আবার ঘুমের ভেতর শুনতে পায় সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর, "আমি আসছি রাফি, তোর জন্য। তুই আমার থেকে পালাতে পারবি না।"

রাফি এবার আর ভয়ের কারণে পালাতে পারে না। ঘুমের মধ্যে সে দেখতে পায়, সে ধীরে ধীরে সেই পরির জগতে ঢুকে যাচ্ছে। তার চারপাশে লাল শাপলার ক্ষেত, এবং সেই পরি তাকে ডাকছে। "এখানে আয়, তুই আমার।"

ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর, রাফি তার শরীরে গভীর ক্ষত দেখতে পায়। তার হাত, পা, বুক—সব জায়গায় কাটা দাগ। সে জানে, পরি তার শরীরের উপর সম্পূর্ণ দখল নিতে শুরু করেছে।

শেষমেশ, গ্রামের সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয়, কবিরাজকে ডেকে আনতে হবে। এবার আরও বড় আয়োজন হবে। পুরনো বটগাছের নিচে পূজা শুরু হয়। সাত পুকুরের পানি আর সাতটা লাল শাপলার মালা নিয়ে পূজা চলে সারা রাত। কবিরাজ মন্ত্র পাঠ করে পরির প্রভাব দূর করার চেষ্টা করতে থাকে, কিন্তু পরি এবার অনেক বেশি শক্তিশালী। হঠাৎ মাটির নিচ থেকে গর্জন শুরু হয়। বটগাছের শেকড় থেকে আগুনের মতো ধোঁয়া বের হতে থাকে।

একটা মুহূর্ত আসে, যখন রাফির শরীর আর সহ্য করতে পারে না। তার মুখ থেকে বিকট শব্দ বের হতে থাকে। গলা ফেটে রক্ত বের হয়ে আসে। সে চিৎকার করে, "ও আমাকে ছাড়ছে না! আমাকে বাঁচাও!"

কবিরাজ শেষ চেষ্টা হিসেবে রাফির গায়ে সাত পুকুরের পানি ছিটিয়ে দেয়। এক অদ্ভুত শীতল বাতাস ঘিরে ধরে চারপাশ। হঠাৎ করেই সব কিছু স্তব্ধ হয়ে যায়। কিন্তু সেই মুহূর্তে, পরি তার ভয়ঙ্কর কণ্ঠে বলে, "আমি যাব না। আমি ফিরে আসব। রাফি আমারই থাকবে!"

রাফি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে, কিন্তু তার ভেতর থেকে এক অজানা ভয় চলে না। বিজয়পুরের শীতল রাতগুলোতে এখনও সে শোনে সেই কণ্ঠস্বর—"তুই আমার, আমি আসছি..."পূজা শেষ হওয়ার পর রাফি কিছুটা শান্তি পায়, তার মনে হয় হয়তো সবকিছু শেষ। কিন্তু গভীর রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, হঠাৎ করেই বিজয়পুরের আকাশ ভেঙে যেন ঝড় শুরু হয়। ঘরের দরজাগুলো বিকট শব্দে খটখট করতে থাকে, জানালাগুলো নিজেরাই খুলে যায়। শীতের হিম বাতাস কুয়াশার মতো ঘরে ঢুকে পড়ে। রাফির চোখে ঘুম নেই, সে জানে পরি ফিরে আসছে।

এবারের উপস্থিতি ভিন্ন। জানালার বাইরে একটা বিকৃত মুখ দেখা যায়, লাল শাড়ি পরা সেই পরি, তবে এবার তার চোখ দুটো শুধু আগুন নয়, পুরো শরীর জ্বলন্ত আগুনের মতো লাল হয়ে আছে। পরির মুখে হিংস্রতা, তার চোখে হাহাকার। "তুই ভাবছিস আমি চলে গেছি, রাফি? আমি তোকে ছেড়ে যাব না। তুই আমার, চিরকাল আমারই থাকবে!"

রাফি বিছানা থেকে উঠতে চায়, কিন্তু তার শরীর যেন পাথরের মতো ভারী হয়ে গেছে। পরি এবার ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে, তার গায়ের আগুন ছড়িয়ে পড়ে ঘরের চারদিকে। চারপাশের দেয়ালগুলোতে ছায়ামূর্তি নাচতে থাকে, যেন অন্ধকারের মধ্যে অসংখ্য হাত রাফির দিকে বাড়িয়ে আসছে।

"তোর কপালে মৃত্যু লেখা আছে, রাফি। তোকে আমার জগতে নিয়ে যাব।"

রাফি চিৎকার করে, কিন্তু কণ্ঠ তার গলা থেকে বেরোয় না। পরির হাত বাড়িয়ে রাফির গলায় চেপে ধরে। সেই হাতের ঠান্ডা শীতলতা তাকে মৃত্যুর কাছাকাছি নিয়ে যায়। হঠাৎ, ঘরের ভেতর ঝড়ে একটি ধ্বংসাত্মক ঝড় ওঠে, যেন সব কিছু ছিন্নভিন্ন করে দিতে চায়।

ঠিক তখনই দরজা ভেঙে কবিরাজ আর রাফির বাবা-মা ঘরে ঢোকে। কবিরাজ মন্ত্র পাঠ করে রাফির গায়ে পানি ছিটিয়ে দেয়। পরি চিৎকার করে, তার গলা থেকে বিকৃত শব্দ বের হতে থাকে। আগুনের শিখা মুহূর্তেই নিভে যায়। কবিরাজ লাল শাপলার মালা পরির দিকে ছুঁড়ে দেয়, সঙ্গে সঙ্গে পরির শরীর কাঁপতে শুরু করে।

"তুই আর এ পৃথিবীতে জায়গা পাবি না। চলে যা!" কবিরাজ চিৎকার করে বলে।

পরি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তার শরীর থেকে ধোঁয়া বের হতে থাকে, চিৎকার করতে করতে পরি মাটির নিচে হারিয়ে যায়।

কিন্তু যাওয়ার আগে পরি বলে যায়, "তুই আমাকে পরাজিত করেছিস, কিন্তু আমার ছায়া তোর জীবন থেকে কখনো সরে যাবে না। তোর মৃত্যু হবে আমার হাতেই, রাফি।"

সবকিছু শান্ত হয়ে যায়, কিন্তু সেই রাত থেকে রাফির জীবনে কিছুই আর স্বাভাবিক থাকে না।

রাফি বেঁচে যায়, কিন্তু তার শরীরের ওপর আজও মাঝে মাঝে গভীর ক্ষত দেখা যায়। বিজয়পুরের সেই পুরনো খেজুর গাছগুলো আর রাফির কাছে যায় না কেউ। শীতের রাতে বিজয়পুরের বাতাসে লাল শাপলার গন্ধ ভেসে বেড়ায়, আর রাফি জানে, সেই গন্ধ পরির। পরি একদিন ফিরে আসবে, তার কথা রেখে রাফির জীবনের শেষ অধ্যায়টা সম্পূর্ণ করবে।

লাইক করুন কমেন্ট করুন ফাইভ স্টার রেটিং দিন ফলো দিয়ে পাসে থাকুন
341 Views
12 Likes
4 Comments
3.6 Rating
Rate this: