হারানো দিনগুলো

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:

শীতের সকাল। ঘর থেকে বেরিয়ে একটি সাদা রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে আমি হাঁটছিলাম। চারপাশের নিস্তব্ধতা যেন আমার হৃদয়ের সুর তুলে ধরছিল। গত এক বছর ধরে প্রতিটি দিনই ছিল কষ্টের, তবে আজকের দিনটি অন্যরকম।

আমার নাম রাহী। আমি ঢাকার এক ছোট্ট শহরে বড় হয়েছি। বাবা মা দুজনেই ছিলেন শিক্ষিত, কিন্তু তাঁদের আর্থিক অবস্থা ততটা ভালো ছিল না। তাই প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের সংগ্রাম করতে হয়েছে। ছোটবেলা থেকেই আমি শিখেছিলাম, জীবনের মধ্যে কষ্ট থাকবে, কিন্তু সে কষ্টকে সঙ্গী করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।

আমার জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্টটি আসে যখন আমি কলেজে পড়তাম। আমার ছোট ভাই, রাফি, যিনি ছিল আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু এবং সঙ্গী, হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। ডাক্তাররা বলেছিল, ওর রোগের চিকিৎসা খুব কঠিন এবং ব্যয়বহুল। আমার মা-বাবা চেষ্টা করলেন, কিন্তু তাঁদের সামর্থ্যের বাইরে ছিল। আমি স্কুলের পড়াশোনা ছেড়ে কাজ করতে শুরু করি, তবে তাও যথেষ্ট ছিল না।

রাফির কষ্টের সাথে আমার কষ্টও বাড়তে থাকে। সে প্রতিদিন রোগে কষ্ট পেত, আর আমি helpless বোধ করতাম। অবশেষে, একদিন রাফি চলে গেল। আমার পৃথিবীটা থমকে গেল। আমি যেন নড়াচড়া করতে পারছিলাম না। চারপাশে সবাই আমার জন্য চিন্তা করছিল, কিন্তু আমি কষ্টের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছেছিলাম।

দিন কাটতে লাগল, তবে রাফির স্মৃতি আমার মনে থাকল। আমি কলেজে ফিরে গেলাম, কিন্তু মনে হচ্ছিল সবকিছু শূন্য। বন্ধুদের সাথে কথা বলতাম, তবে কিছুই ভালো লাগত না। রাফির কথাগুলো বারবার মনে পড়ত। সে বলত, "ভাই, কষ্টের মধ্যেই জীবনের আসল সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে।"

একদিন, ক্লাসের শেষে, আমি কলেজের ছাদে গিয়ে বসে পড়লাম। আমি ভাবতে লাগলাম, কষ্টের ভেতর দিয়েই কি সত্যিই জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়? এক সময় হঠাৎ করে একটা অনুভূতি আসল। মনে হল, আমাকে রাফির স্মৃতির জন্য কিছু করতে হবে। তার মতো, আমি প্রতিজ্ঞা করলাম, কষ্টকে শক্তিতে রূপান্তরিত করব।

আমি পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে শুরু করলাম। রাতের বেলা কাজ করার পাশাপাশি পড়াশোনা করতে লাগলাম। ক্লাসে আমার আগ্রহ বেড়ে গেল। ধীরে ধীরে আমি আমার প্যাশনের প্রতি নজর দিতে লাগলাম—লেখা। আমি গল্প লেখা শুরু করলাম। প্রতিটি গল্পে রাফির স্মৃতি, আমার জীবনের কষ্ট, এবং সংগ্রামের কথা তুলে ধরতে লাগলাম।

এক বছর পর, আমার প্রথম বই প্রকাশিত হল। বইটির নাম দিলাম "কষ্টের রঙ"। বইটি খুব একটা বিক্রি হয়নি, কিন্তু আমি খুশি ছিলাম। কারণ আমি রাফির জন্য কিছু লিখতে পেরেছিলাম। মানুষের মন্তব্যগুলোও আমাকে অনুপ্রাণিত করল।

আবার সময় চলতে লাগল। আমি চাকরি খুঁজতে শুরু করলাম এবং অবশেষে একটি এনজিওতে কাজ পেলাম, যেখানে আমি দরিদ্র শিশুদের শিক্ষায় সাহায্য করতাম। এখানে কাজ করতে গিয়ে আমি অনেকের কষ্ট দেখলাম, কিন্তু একই সাথে তাদের সাহসও অনুভব করলাম। তাদের হাসি, তাঁদের স্বপ্ন, সবই আমাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছিল।

মা-বাবা আমার অর্জনগুলো দেখে গর্বিত ছিলেন। তাদের মুখে হাসি দেখে আমি বুঝলাম, কষ্টের মাঝেই আমি নতুন করে জীবনের অর্থ খুঁজে পেয়েছি। তবে রাফির অভাব কখনো পূরণ হবে না।

একদিন, কাজ শেষে আমি বাড়ি ফিরে আসছিলাম। হঠাৎ একদল ছোট শিশুদের দেখলাম, যারা খেলছিল। তাদের মধ্যে একজন শিশু হঠাৎ পড়ে গেল। আমি দ্রুত ছুটে গিয়ে তাকে উত্সাহিত করলাম। সে হাসি মুখে উঠে দাঁড়াল। আমার মনে পড়ে গেল রাফির কথা, "কষ্টের মধ্যেই আমাদের সাহস পেতে হয়।"

সেই মুহূর্তে আমি অনুভব করলাম, রাফি আজও আমার সাথে আছে। কষ্টগুলো এখন আমার জীবনের একটি অংশ। আমি জানি, আমি আর কখনো একা নই। আমি কষ্টকে এক নতুন আলোতে দেখতে শিখেছি।

কষ্টের গল্প কখনো শেষ হয় না, তবে সেটি আমাদের শক্তি জোগায়। তাই আমি প্রতিদিন সেই শক্তির জন্য লড়াই করি। জীবনের এই যাত্রায় কষ্টের রঙে রাঙিয়ে তোলার চেষ্টা করি। আমি জানি, রাফি সবসময় আমার সাথে আছে, আর তার স্মৃতি আমাকে পথ দেখাবে।

এভাবেই আমি কষ্টের গল্পের ভেতর দিয়ে নতুন করে বাঁচতে শিখলাম, একটি নতুন জীবন শুরু করতে পেরেছিলাম।
129 Views
7 Likes
1 Comments
5.0 Rating
Rate this: