হঠাৎ সুনামি

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
আকাশে লালচে আভাযুক্ত সূর্যাস্তের স্বর্ণালী দ্যুতি ছড়িয়ে পড়েছে।পাখিদের বাসায় ফেরার কিচিরমিচির উল্লাসে চারদিকের বাতাস মুখরিত হয়ে উঠেছে।ফুটপাতের লাগোয়া বটগাছটির ক্রোড়দেশে অঘোরে ঘুমিয়ে থাকা বিশ বর্ষীয়া তিয়াসা চোখ কচলে জেগে উঠল। প্রাথমিক ঘোরটা কাটতে না কাটতেই সে তার সর্বনাশটা বুঝতে পারল।জনবহুল ভীড়ের রাস্তার মধ্যে সে "মামি মামি...তুমি কোথায়..." বলে ডুকরে কেঁদে উঠল।সে তো হারিয়ে গেছে।এখন এই অচেনা জায়গাটাতে মামা বা মামি তাকে কেমন করে খুৃঁজে পাবে!তাহলে কি আর তার ঘরে ফেরা হবে না?প্রবল আতঙ্কে তার গলা বুঁজে এল।আস্তে আস্তে করে তার মনে পড়তে লাগল সব।গতকাল সন্ধ্যার পর থেকেই তো হঠাৎ করে তার মামা আর মামি হঠাৎ কেমন ভালো হয়ে গিয়েছিলেন।বাবা মা অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার পর আজ মাস সাত কি আট হবে,সে মামা মামির কাছেই রয়েছে।মামির কাছে এত আদর আর যত্ন সে কোনোদিনও পায়নি।এমনকি তার জন্য মামি যখন এই নতুন সুন্দর লাল পোশাকটা কিনে আনলেন কোনো উপলক্ষ ছাড়াই,তখন মামাতো বোন হিংসা করায় মামি তাকে দু ঘা দিয়েছিলেন।দিদির সাথে সে আর কোনো খারাপ ব্যবহার করবে না,ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করবে না এই কথা দিয়ে তবে সে রেহাই পেয়েছিল।তিয়াসার মনে জ্বলে উঠেছিল খুশির রোশনাই।বাবা মা মরার এতদিন বাদে হলেও যা হোক...তাকে আর মামা মামির অত্যাচার আর মারধোর সইতে হবে না।তার ওপর কাল রাতে শুতে যাবার সময় মামিমা যখন বলে গেলেন,তার যতগুলো জামা ছিঁড়ে গেছে ততগুলো জামা ই তাকে নিয়ে শপিং মলে গিয়ে নিজে কিনে দেবেন,তখন তার খুুশি যেন ধরছিল না।সে আজ সক্কাল সক্কাল ঘুম থেকে উঠে চেষ্টা করল নিজে নিজে দাঁত ব্রাশ করতে।মা চলে যাবার পর এইসব নিত্যনৈমিত্তিক কাজ নিজে নিজে সারতে তার ভীষণ সমস্যা হত।মামি তো একটু সাহায্য করা দুর...ঘরের মেঝেতে তার লালা ঝরছে দেখেই মেরে মেরে আধমরা করে দিতেন।মামাতো বোন তিতির তখন খিলখিল করে হাসত।আজ মামি নিজে হাতে তাকে ব্রাশ করিয়ে,ভালো করে সাবান আর শ্যাম্পু সহযোগে স্নান করিয়ে নিজে হাতে করে ব্রেকফাস্টে বানানো চাউমিন খাইয়ে নতুন জামাখানি পরিয়ে ওকে পরীর মতো সাজিয়ে তৈরি করে গাড়িতে বসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল শপিং মলে তার জন্য নতুন জামাকাপড় কিনতে।গাড়িতে যেতে যেতে হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে মামি ওকে এই গাছতলায় বসিয়ে একটা বোতলের থেকে একটু শরবোত খেতে বললেন।মামির কথা শুনে ঢকঢক করে সুস্বাদু মিষ্টি আমের শরবতটা খেয়ে নিল তিয়াসা।তারপর মামি বললেন,তুই এখানে লক্ষী হয়ে বোস,আমি গাড়িটা একটু পার্ক করিয়ে আসছি।কাছেই শপিং মল।অবোধ তিয়াসা হাসিমুখে বলেছিল,আচ্ছা মামি।তারপর সে ব্যাগ থেকে পুতুলখানা বার করে খেলতে খেলতে হঠাৎ কেমন তার দুচোখ জুড়ে ঘুম নেমে এল।তারপর তার আর কিছু মনে নেই।এখন সন্ধ্যে গড়িয়ে অন্ধকার নামছে।সে এখন মামার বাড়িতে কেমন করে ফিরবে!কোনো বড় নাম অথবা ঠিকানা সে কিছুতেই মনে রাখতে পারে না।চারপাশে প্রচুর লোকজন চলাফেরা করছে তার সামনে দিয়ে।মা বলতেন,অচেনা লোকের সাথে কখ্খোনো কথা বলতে নেই।কিন্তু এখন তো রাত নেমে আসছে।কাউকে যদি সে ডেকে অনুরোধ করে তার মামার বাড়িতে তাকে যেন একটু পৌঁছে দেয়,তাহলেও তো লাভ নেই কারণ সে মামার বাড়ির ঠিকানা আদ্যোপান্ত ভুলে বসে আছে।অবশ্য ঠিকানা যে ঠিক কিভাবে কাজে লাগে সেটাও তো সে জানে না।তার মনে হল,ঠিকানা না বলতে পারলে মামার বাড়ি তাকে কেউ কি পৌঁছে দিতে পারবে না?একবার চেষ্টা করেই দেখা যাক...
সে ফুঁপিয়ে লাল হয়ে থাকা চোখদুটো দুহাত দিয়ে ভালো করে মুছে নিয়ে তাকাল সামনের দিকে।সামনে একটা পান সিগারেটের দোকান থেকে এক ভদ্রলোক সিগারেটের প্যাকেট কিনছে।সে কান্নাভেজা গলায় জড়ানো উচ্চারণে বলে উঠল,"এই লোকটা...একটু এদিকে শোনো..."
কোনো সাড়াশব্দ পেল না।আচ্ছা ঝামেলা তো...সে গুটিগুটি গাছতলা উঠে দু পা এগিয়ে এসে ভদ্রলোকের কনুই ধরে ঝাঁকাল।চমকে গিয়ে অফিস ফেরত রাতুল তাকাল পিছন দিকে।একটা জড়বুদ্ধি হাবা গোছের তরুণী মেয়ে একটা করুণ আকুতিপূর্ণ চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।জামাকাপড় দেখে তো ভিখারী বলে মনে হচ্ছে না।নিশ্চয়ই বাড়ির লোকেদের থেকে কোনোভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।রাতুল কিছু বলতে যাবে এমন সময় তিয়াসা কাতর কন্ঠে সজোরে বলে উঠল..."এই লোকটা...আমি হারিয়ে গেছি গো...আমায় একটু ঘরে পৌঁছে দাও না..."
রাতুল বুঝল তার আন্দাজ ভুল নয়।সে শুধালো...তোমার বাড়ি কোথায়?আমায় তোমার বাবা মায়ের নাম্বার দাও আমি চেষ্টা করছি তোমাকে তোমার বাড়ি পৌঁছে দিতে।তিয়াসা শশব্যস্ত কন্ঠে বলল,"বাবা মা তো আকাশে তারা হয়ে গেছে।তুমি আমায় মামার বাড়ি পৌঁছে দাও না...ওই যে গোলাপী রংএর তিনতলা বাড়িখানা..."
রাতুল মৃদু হেসে বলল,"বাড়ির রং নয়,তুমি আমায় তোমার মামার বাড়ির ঠিকানা টা বলো।"
তিয়াসা মাথা চুলকাতে লাগল তীব্র উৎকন্ঠায়।আমতা আমতা করে বলল,"ওই যে ব্যাচারামদার দোকানের পাশ দিয়ে গলি।তিনতলা বাড়ির ছাদে কত্তগুলো ফুলের টব আছে...ওই বাড়িখানা..."ফোঁপাতে লাগল তিয়াসা।ওই বাড়িতেই জানোয়ারের মতো ব্যবহার পেয়েছে তিয়াসা।ওই বাড়িতে ফিরে যাওয়ার চাইতে তার কাছে হয়তো চিরকালের জন্য হারিয়ে যাওয়াটাই ভালো।কিন্তু এখন তার পেট ক্ষিদেয় কাতরাচ্ছে।জড়বুদ্ধি হাবা হলেও কোনো অচেনা মানুষকে সে কখনোই মুখ ফুটে সে কথা বলতে পারছে না লজ্জায়।সেই যন্ত্রণাটাই কান্না হয়ে বেরিয়ে আসছে।রাতুলেরও সেটা বুঝতে খুব বেশি বেগ পেতে হল না।সাথে সে এটাও বুঝতে পারল যে এই অবোধ নারীর পক্ষে নিজের থাকার জায়গার সঠিক ঠিকানা বলতে পারা এক কথায় অসম্ভব। সে সহানুভূতিপূর্ণ কন্ঠে তিয়াসা কে শুধালো,তোমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে তাই না?
চাতকের দৃষ্টিতে তাকালো তিয়াসা রাতুলের চোখের দিকে।রাতুল কোমল কন্ঠে বলল,এসো আমার সাথে।
রাতুল তিয়াসাকে একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল।পেট ভরে তাকে মাছ ভাত খাওয়াল।রাতুল ভেবেছিল খাওয়া শেষে  মেয়েটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বলে বলে চেষ্টা করবে যদি কোনোভাবে তার বাড়ির ঠিকানা টা বেরিয়ে আসে...।কিন্তু খাওয়ার সময় যখন তিয়াসা ভাত সব্জি ঝালঝোল সবকিছু সারা মুখমন্ডলে আর সমস্ত জামাকাপড়ে ফেলে মাখিয়ে একশা করল আর শিশুর মতো অস্ফুটে রাতুলের কাছে তার মাছ বেছে দেবার জন্য দাবী জানাল, তখন রাতুল ঠিকানা জানতে পারার আশা পরিপূর্ণভাবে ত্যাগ করল এবং বুঝতে পারল,সর্বশরীরে যৌবন বিকশিত এই অবোধ মেয়েটিকে রাস্তায় একটু বেশিরাতে একা পেলে তো সব নিশাচর নরপিশাচেরা একেবারে ছিঁড়েখুঁড়ে খাবে।সে কোনোভাবে তখনকার মতো পকেট থেকে রুমাল বার করে মায়ের মতো তার মুখ হাত মুছিয়ে যতটা সম্ভব পরিষ্কার করে নিজের হাতে মাছের কাঁটা বেছে খাইয়ে দিল।তারপর তিয়াসাকে শুধালো,"তুমি আমার সাথে আমার বাড়িতে যাবে?"
পেট ভরে খেয়ে পরিতৃপ্ত তিয়াসা হাসিমুখে জবাব জানাল,"হ্যাঁ অ্যা অ্যা যাব"।
বেশ।তুমি তাহলে হাত মুখ ধুয়ে এসো আমি বিলটা পে করে আসি।তিয়াসা লক্ষী মেয়ের মতো ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে রাতুলের অঙ্গুলি নির্দেশ অনুসরণ করে মুখ ধোওয়ার বেসিনের দিকে এগিয়ে গেল।রাতুল খাবার বিল পে করে নিয়ে তিয়াসাকে নিতে এল ভিতরে।ভিতরে এসে তার একেবারে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ার মতো অবস্হা হল।সে দেখল,হাতমুখ ধুতে গিয়ে মেয়েটা কলের জলে পুরো স্নান করে গিয়েছে।একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে তিয়াসাকে বলল,এসো।আমার হাত ধরো।

জনবহুল রাস্তার ধারে ভীড় ও হকারে ঠাসা
ফুটপাতের মাঝ দিয়ে একজন অচেনা পুরুষের হাত ধরে এক জড়বুদ্ধি অবোধ নারী অদ্ভুত এক বিশ্বাস এবং অজানা এক ভরসার স্নিগ্ধ আশ্বাসে ধীর পায়ে চলতে লাগল অনিশ্চিত কোনো গন্তব্যের অভিমুখে।

শিশুকালে পিতৃবিয়োগ হওয়ার পরে আপন যৌথ পরিবার হতে ক্রমাগত অপমানিত আর অবশেষে বিতাড়িত হওয়ার পরে বাবার সঞ্চয় করে রাখা স্বল্প পুঁজি হাতে নিয়ে প্রায় এক কাপড়েই সদ্য বিধবা মায়ের সাথে সাত কি আট বছর বয়সে প্রথম অচেনা শহর কলকাতায় পা রেখেছিল ছোট্ট রাতুল।তারপর চরম দারিদ্র্য,জীবনযুদ্ধের চড়াই উতরাই রাস্তায় ক্ষতবিক্ষত হতে হতে অবশেষে এই অচেনা শহরের বুকে গড়ে নেয় তার ছোট্ট একটি স্হায়ী আস্তানা।রাতুল চাকরি পাওয়ার মাস কয়েকের মধ্যেই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পরলোকে পাড়ি দেন তার মা।তারপর থেকেই কার্যত এই এত বড় পৃথিবীর বুকে সে যন্ত্রের মতো বেঁচে আছে।একা।তার দু কামরা বিশিষ্ট একার এই সংসারটাতে জীবনের সমস্ত অর্থ যেন ভাষাহীন...দিশাহীন।ঘরদোরের প্রতিটি দিক,প্রতিটি কোণা যেন সেই দিকভ্রষ্টতার দিশাহীনতা তীব্রভাবে প্রতিফলিত করে চলেছে।ঘরখানার দশা এমন,যে সে ঘরে আদৌ মানুষ থাকে নাকি গোরু ছাগল থাকে প্রথমটা সেইটাই ঠাহর করা মুশকিল হবে।সাত পাঁচ কিছুমাত্র চিন্তাভাবনা না করেই সে ঘরে আজ দিনশেষে রাতুল সাথে করে নিয়ে এসেছে এক নতুন অতিথিকে।বারান্দার গেটের তালা খুলে রাতুল দরজার লক খুলে ভিতরে ঢুকতে যাবে,এই সময়ে সে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল,নবাগত অতিথিটি এখনো একবুক সংকোচ নিয়ে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।"ভিতরে এসো...লজ্জা কি!"বলে রাতুল বাইরে এসে তিয়াসার হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে প্রায় টেনে নিয়ে এল ঘরের ভিতরে।ঘরের ভিতরে পা দিয়ে সে প্রথম উপলব্ধি করল,এই ঘর কোনো মানুষের বাসযোগ্য নয়।বিছানার উপর সপ্তাহখানেকের উপর হতে জমিয়ে আসা অগোছালো জামাকাপড়ের ডাঁই এতটাই উঁচু একখানা ঢিবির রূপ নিয়ে নিয়েছে যে বেশ কদিন তো রাতুল অফিস থেকে ফিরে খাওয়া সেরে মেঝেতেই মাদুর পেতে ঘুমের কাজ সারছে।চেয়ারের উপর অফিসের ফাইলপত্রের ডাঁই আর সারা টেবিল জুড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যেন হরেকমালের দোকান দিয়েছে।বাসনপত্র রান্নাঘরের চৌহদ্দি পেরিয়ে বসা কাম শোওয়ার একমাত্র এই ঘরটিতে তার দখলদারি ছড়িয়েছে। মা গত হওয়ার পর থেকে কোনোদিন ঘরখানার দিকে রাতুল ঠিকভাবে তাকায়নি।আজ হঠাৎ এমন এক ঘটনাচক্রে সে এক নবাগতা অতিথির হাত ধরে তার নিজের এই ঘরখানায় প্রবেশ করেই হঠাৎ যেন তার সবকিছু অসহ্য ঠেকল।এতদিন বাদে সে যখন প্রথম উপলব্ধি করল তার এই ঘরখানা আসলেই মানুষের বাস করার অযোগ্য,সে তখন মনে মনে নিজেকেই নিজে গাল পাড়তে লাগল।তারপর চেয়ার টেবিল ছোট আলমারী আর খাটখানার মাঝে একখানা মাদুর পেতে দিয়ে তিয়াসাকে বলল,তুুমি এইখানে একটু বসো,আমি ততক্ষণ ঘরটা একটু গুছিয়ে দিই।তিয়াসা তার কথামতো মাদুরে গিয়ে বসে ঘরদোরের ছিরিছাঁদ ফেরাতে ব্যস্তসমস্ত রাতুলের দিকে এক অদ্ভুত মায়াময় দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে রইল ফ্যালফ্যাল করে।বছরের পর বছর ধরে যে কাজগুলির কোনো প্রয়োজনীয়তাই রাতুল অনুভব করেনি আজ হঠাৎ কোন এক অজ্ঞাত তাগিদে প্রায় এক লহমায় জামাকাপড় ভাঁজ করে রাখা থেকে শুরু করে ঘরের প্রতিটি জিনিসকে তার সঠিক জায়গাতে গুছিয়ে রেখে ঘর ঝাঁটপোছ করে ঘরখানার প্রায় ভোল পালটে ফেলল।তারপর তিয়াসার জন্য সুন্দর করে মশারি খাটিয়ে বিছানা করে দিল।কিন্তু মুশকিল হল,তিয়াসার পরনের পোশাক খানি নিয়ে।এমন দামী আর শৌখিন পোশাক পরে তো আর বিছানায় শোওয়া যায় না...আর রাতুলের ঘরে তো পোশাক বলতে তার নিজের শার্ট প্যান্ট আর গেঞ্জি পাজামা ছাড়া আর কিছুই নেই।মায়ের কিছু শাড়ি আছে অবশ্য,কিন্তু এই জড়বুদ্ধি হাবা মেয়েটির গায়ে শাড়ি যদি কোনোভাবে জড়িয়েও দেওয়া যায়,সেই শাড়িতে সে নিজেই জড়িয়ে টরিয়ে মেঝেয় পড়ে হাড়গোড় ভাঙবে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।কি করা যায়...উপায় না দেখে রাতুল নিজের ঘরে পরার একটা ট্রাউজার আর একটা টি শার্ট নিয়ে এল তিয়াসার সামনে।সে তিয়াসার সামনে গিয়ে সন্তর্পণে দাঁড়াল।সে লক্ষ্য করল,তিয়াসা দেওয়ালের একটা কোণ আঁকড়ে গুটিসুটি হয়ে একেবারে সিঁটিয়ে বসে আছে।রাতুল ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আস্তে করে ওর চিবুকটা তুলে ধরল।কয়েক মূহুর্তের জন্য সে তিয়াসার কাজল টানা দীঘল চোখদুটির নিষ্পাপ আর সরল চাহনির নিটোল মায়ায় কেমন যেন হারিয়ে গেল।রাস্তার পাশে হঠাৎ সজোরে বারোটার ঘন্টা বেজে উঠতেই তার সম্বিৎ ফিরল।হাতে ধরা টি শার্ট আর ট্রাউজার টা তিয়াসার সামনে এগিয়ে ধরে রাতুল বলল,এই নাও।এখনকার মতো এই জামা দিয়ে কাজ চালিয়ে নাও।কাল সকালে তোমার জন্য নতুন জামা কিনে আনব কেমন!
রাতুলের হাতে ধরা টি শার্ট আর ট্রাউজার খানি খপ্ করে ধরে ফেলল তিয়াসা।তারপর সারাদিন ধরে গায়ে চেপে থাকা এই দামী পোশাকের ধড়াচূড়োখানা অপটু হাতে টান মেরে খুলে ফেলতে গেল সে।রাতুল কোনোমতে তাকে আটকাল।তারপর বলল,এখানে নয়।তুমি বাথরুমে যাও।ফ্রেশ হও।আমি ততক্ষণে খাওয়াটা শেষ করে নিই কেমন!রাতুলের কথা শুনে সে বাধ্য মেয়ের মতো তার অঙ্গুলি নির্দেশ অনুসরণ করে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল।রাতুল রান্নাঘরের দিকে গেল নিজের জন্য কিছু খাবারের বন্দোবস্ত করতে।সন্ধ্যের পরে অন্য সব দিনে সে অফিস থেকে ফিরে এসে ফ্রিজ থেকে সকালের কুটে রাখা সব্জি আর ভেজে রাখা মাছ দিয়ে ভাতের সাথে একটা ঝোল বা তরকারি যা হোক কিছু চাপিয়ে দেয়।সেটা হতেও খুব বেশি সময় লাগে না।কিন্তু আজ তো সে একা নয়,ফিরেছে দোকা হয়ে।তায় ঘরটিকে অচেনা আগন্তুকের পক্ষে একটু বাসযোগ্য করতে গিয়েই দিনের এই বাকি সময়টুকু যেন এক লহমাতেই ফুরিয়ে গেল।এখন এই পরিশ্রান্ত শরীর নিয়ে রান্না করা তো দূর,ভাত বসাতে গিয়েও যেন মনে হচ্ছে,হাঁটুতে যেন কেউ ভারী পাথর বেঁধে দিয়েছে।সে মুড়ির টিন থেকে বাটিতে কিছুটা মুড়ি ঢেলে নিয়ে তাতে কিছুটা চানাচুর ঢেলে নিল।ক্ষুধার্ত পেটে সেটাই এক নিমেষে শেষ করে রান্নাঘরের আলো বন্ধ করে সে শোবার ঘরে এল।ঘরে ঢুকে সে দেখল,মশারির ভিতরে সারা শরীরখানিকে গুটুলি পাকিয়ে নিয়ে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে কাদা হয়ে রয়েছে মেয়েটা।জামাকাপড় কেমন করে পরতে হয় এটাই বোধহয় মেয়েটা আজ পর্যন্ত শিখে উঠতে পারেনি।একমুখ মায়া ঢালা গভীর ঘুমে অবচেতন শরীরটির আনাচে কানাচে তাই বড়ো বেখাপ্পা ভাবেই উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে বিশ বর্ষীয়া তারুণ্যের উদ্দাম যৌবন।রাতুল একদৃষ্টে তিয়াসার মুখের দিকে চেয়ে রইল।অসহায় এই অপরিচিতার পরম নিশ্চিন্তের এই সুখনিদ্রা যেন রাতুলকেও কোনো একটা অব্যক্ত তৃপ্তির সাগরে ভাসিয়ে নিল।সে পরম মমতায় তিয়াসার কপালে তার হাতখানি রেখে দুই ভুরুর মাঝে একটা স্নেহ চুম্বন এঁকে দিল।তারপর মশারিটা ভালো করে গুঁজে দিয়ে নিজের জন্য মেঝেতে মাদুর পেতে চাদর আর বালিশ দিয়ে প্রতিদিনকার মতো নিজের বিছানা করে নিল।তারপর আলো নিভিয়ে সেও নিদ্রার সাগরে অস্তমিত হল।
হঠাৎ মাঝরাতে সে অনুভব করল,কেউ যেন তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরে থরথর করে কাঁপছে।সে দারুণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।মেয়েটা তার বুকের মধ্যে সভয়ে মাথা গুঁজে একমনে কি যেন বিড়বিড় করছে।রাতুল বুঝল কোনো কারণে বোধহয় মেয়েটা নিদারুণ ভয় পেয়ে গিয়েছে।সে সস্নেহে তিয়াসাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলতে লাগল,"কি হয়েছে মামন?কি দেখে ভয় পেলে?"
তিয়াসা কাঁপা কাঁপা ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,ও ও ওইদিকে কেউ আছে!আমি শব্দ পেয়েছি।আমার ভীষন ভয় করছে ...অজানা কোনো এক মূক আতঙ্কে থরোথরো তিয়াসা রাতুলার শার্টের কলারটা খামচে ধরে ওর বুকের মধ্যে তীব্রভাবে মাথাখানি গুঁজে দিয়ে সেখানেই যেন আত্মরক্ষা হেতু আপাদমস্তক ঢুকে যেতে চাইছে।রাতুল বুঝতে পারল ব্যাপারখানা কি হয়েছে।ওর রান্নাঘরে দিন রাত নির্বিশেষে বিড়ালের উৎপাত লেগেই থাকে।আর ঝনঝন শব্দে বাসনকোসন এদিক ওদিক হয়ে যাওয়াটাও একটা নিত্য রুটিনের মধ্যেই পড়ে।এই শব্দে এখন আর রাতুলের ঘুমের বিঘ্ন ঘটে না।সে এক ঘুমেই রাতকে সকাল করে।কিন্তু এই আনকোরা জায়গায় আতঙ্কে থরহরিকম্প এই মেয়েটি যেভাবে রাতুলকে আঁকড়ে ধরে কাঁপছে তাতে রাতুল বুঝল,তার এই যেমন খুশি ছন্নছাড়া জীবনটাকে অনির্দিষ্ট কিছুদিনের জন্য মুলতুবি রাখতে হবে।এখন তার অনেক দায়িত্ব। সে সস্নেহে তিয়াসার পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলল...কিচ্ছু হয়নি মামন...ও তো বেড়ালের আসার শব্দ...ও রোজ আসে...
পরদিন থেকে রাতুলের রোজকার রুটিন একেবারে পালটে গেল আর পরিশ্রম একেবারে দ্বিগুণ হয়ে উঠল।সে কাকভোরে উঠে মুখহাত ধুয়ে সবার আগে জলখাবার বানিয়ে নেয়।তারপর তিয়াসাকে ঘুম থেকে তুলে ওকে মুখ হাত ধুইয়ে দিয়ে গলায় কাপড় বেঁধে খাইয়ে দেয়।তারপর নিজে চা জলখাবার খেয়ে নিয়ে তিয়াসার দুপুরের খাবার জন্য ভাত তরকারি রান্না করতে বসে।রান্নাটান্না সেরে সে তিয়াসাকে স্নান করাতে নিয়ে যায়।টিশার্ট আর ট্রাউজার পরিহিতা তিয়াসাকে ভালো করে জল ঢেলে স্নানটান করিয়ে গা মুছিয়ে সে কাচা টিশার্ট আর ট্রাউজার সমেত তিয়াসাকে শোবার ঘরে পাঠিয়ে দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেয়।এবার সে নিজে স্নান সেরে নিজের আর তিয়াসার সব জামাকাপড় কেচেধুয়ে মেলে দিয়ে শোবার ঘরে নক করে নিয়ে ঢোকে।তারপর তিয়াসার অপটু হাতে পরা টিশার্ট আর ট্রাউজার নিজে ঠিকঠাক করে দিয়ে তিয়াসার চুল আঁচড়ে দেয় সযত্নে।কপালে পরিয়ে দেয় টিপ।তারপর সে রান্না করে রাখা ভাত তরকারি তিয়াসার জন্য থালায় করে বেড়ে রেখে দিয়ে ঝুরি দিয়ে চাপা দিয়ে রেখে দেয়।এরপর সে নিজে অফিস যাওয়ার জন্য তৈরি হয়।বেরোনোর সময় তিয়াসাকে বাইরে একা না বেরোনোর জন্য সাবধানবাণী দিয়ে কপালে একটা স্নেহচুম্বন এঁকে দিয়ে অফিসে বেরিয়ে যায়।সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিয়াসা ঘরে একাই থাকে।তবে এতে তিয়াসার কোনো অসুবিধা হয় না।কারণ রাতুলের ওই ছোট্ট ঘরটির ভিতরেই সে এমন ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছে যেটা তাকে কোনোভাবে তার বাবা মায়ের স্নেহ ভালোবাসা আর যত্নের সমস্ত অভাব ভুলিয়ে দিয়েছে। আর তাছাড়া রাতুল অনেক রকমের খেলনা আর পুতুল কিনে এনে ঘরে রেখেছে  তিয়াসার জন্য।বাক্স থেকে ধুলো ঝেড়ে পরিষ্কার করে রেখেছে বহুদিনের ব্যবহার না হওয়া পুরোনো টিভিটা।কেবলের মাধ্যমে ওই টিভিতে রাতুল চালু করে দিয়েছে তিয়াসার পছন্দের সব কার্টুন চ্যানেল।তিয়াসার এখন দিন কাটছে বেশ।রাতুল বেরিয়ে যাওয়ার পর সে বিছানায় সাজিয়ে নেয় খেলনা পুতুল আর টিভি খুলে চালিয়ে দেয় পছন্দের চ্যানেল।ঘরে রাখা থাকে নাড়ু বরফি।ইচ্ছেমতো সেগুলো নিয়ে খায়।দুপুরের পর থেকেই তার মধ্যে আরম্ভ হয়ে যায় এক অস্হির তোলপাড়। ক্রমশ যত বিকেল গড়ায়,তত সেটা যেন অসহ্য ঠেকে।সন্ধ্যার দিকে অবশেষে যেই কলিং বেলের শব্দটা হয় সাথে সাথে তিয়াসার ভিতরে যেন উচ্ছ্বাসের জলফড়িংগুলি কোরাসে গান গেয়ে ওঠে।সে লাফিয়ে...নেচে...ছুটে...একনিমেষে গিয়ে দরজা খুলেই বাচ্চা মেয়ের মতো জড়িয়ে ধরে রাতুলকে।রাতুলও যেন দুপুরের পর থেকেই অফিসের কাজে মন বসাতে পারে না কিছুতেই।মনটা শুধু পালাই পালাই করে।শুধু তার মনে হতে থাকে,এইসব অফিসের দায়িত্ব শেষ করে,বাস ট্রামের ঝক্কি পুইয়ে সে কখন ঘরে পৌঁছাতে পারবে।প্রায় দৌড়েই সে অফিস থেকে প্রতিদিন ঘরে আসে আর যখন কলিং বেল টেপার পরে একগাল মায়াভরা সরল সুমিষ্ট হাসি আর বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস নিয়ে দরজা খুলেই রাতুলের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার মামন,তখন রাতুলের মনে হয়,ওর জীবনের ছিন্নবিনার সমস্ত তারগুলি জুড়ে গিয়ে বাজতে শুরু করেছে সপ্তসুরের যাদুমূর্ছনা।এইভাবে দিন যায়।
আগের থেকে এখন রাতুলের খাটুনি যাচ্ছে প্রায় দ্বিগুণ। তা সত্ত্বেও তার মধ্যে কোনো ক্লান্তির উফ্ টুকুও নেই।উলটে তার মনে হচ্ছে,মামনের মামা মামীর খোঁজ আজ নয়,কাল করা যাবে'খন।ধীরে ধীরে তার এই চিন্তাতেও বদল এল।সে ঠিক করে নিল,তার আদরের মামনের মামার বাড়ির খোঁজ করার চিন্তা সে পুরোপুরি বাদ দিয়ে এবার সে এমন ব্যবস্হা করবে যাতে কোনোদিন তাকে মামনের কাছ থেকে আলাদা থাকতে না হয়।সে তিয়াসাকে বিয়ে করবে বলে মনঃস্হির করল।ইতিমধ্যে পাড়া প্রতিবেশীরাও ভীষণভাবে কানাঘুষো আরম্ভ করে দিয়েছে। ক্রমশ কানাঘুষো আর চাপাচাপির পরিধি পার করে সেটা একেবারে প্রকাশ্যে চলে এল।সবাই এবার রাতুলকে চেপে ধরল।সবাই তাকে বলল,এভাবে একটা আইবুড়ো মেয়েকে তুমি ঘরে রাখতে পারো না।যদি ওকে রাখতেই হয়,তাহলে ওকে বিয়ে করে নাও।রাতুল সবাইকে মুখের ওপরে জানিয়ে দিল,আর কয়েকদিনের মধ্যেই সে মেয়েটিকে বিয়ে করে নেবে।এখন মোটামুটিভাবে রাতুলের বিয়ের তোড়জোর আরম্ভ হয়ে গেল।রাতুল অফিসে কটাদিনের জন্য ছুটির আবেদন করল।বিয়ে শব্দটার অর্থ কি সেটা তিয়াসা না বুঝলেও সে যখন এটা বুঝল,একটা এমন ব্যবস্হা হচ্ছে যাতে সে এভাবেই রাতুলের সাথে সারাজীবন থাকতে পারবে তখন তিয়াসার মনে খুশি যেন আর ধরছে না।তার সীমাহীন প্রশ্রয়ে অর্থহীন বকবক শোনার অধীর আগ্রহ...তার ছোটো ছোটো দুষ্টুমি আর তাতে শাস্তির বদলে অকৃপণ আদর...এই যত্ন...এই ভালোবাসা থেকে যাবে সারাজীবন এটা সে তার অবোধ মস্তিষ্কে ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পেরেছিল।তার মনের গহিন কোণে উজ্জ্বল হতে থাকল বেঁচে থাকার উচ্ছ্বাস...তার সার্থকতা উদযাপনের সাতরঙা রামধনু।এরই মধ্যে হঠাৎ এক অপ্রত্যাশিত ঘটনার সম্মুখিন হল রাতুল।নিখোঁজ পরিবার পরিজনহীন মেয়েটি যে পুরোপুরি বেওয়ারিশ নয়...দুনিয়ার বুকে তার আপন রক্তের কেউ কোনোদিন তার খোঁজ করতে পারে তার প্রমাণ আজ এতদিন বাদে হঠাৎ হাতেকলমে পেল রাতুল এবং আন্তরিকতা আর আনন্দ নিয়ে বিয়ের আয়োজনে মশগুল পাড়া প্রতিবেশীরা।তিয়াসার নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই রীতিমতো হন্যে হয়ে তাকে খুঁজে চলেছেন তিয়াসার মামা অচিন্ত্যবাবু।তিনি কর্মসূত্রে আমেরিকায় থাকেন।তিয়াসার বাবা মা গত হওয়ার পর তিনি নিজে তার ভরণপোষণ সমেত সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে তাকে স্ত্রীর কাছে গচ্ছিত রেখে বলেছিলেন,এখন থেকে তোমার দুই মেয়ে।নিজের মেয়ের সাথে ওকেও সন্তানস্নেহে বড় করার দায়িত্ব এখন আমাদের। স্ত্রীর সেদিনের হাসিমুখে সম্মতিজ্ঞাপন দেখে তিনি এটা কখনোই আঁচ করতে পারেননি যে তিনি যদি বিদেশে প্রবাসী না হতেন তাহ‌লে সেদিন সেই সময়ে স্ত্রীর ঠিক কোন রূপ দেখতেন।ছমাসে কি বছরে একবার তিনি দেশে আসেন।এবার সেখানে সমস্তকিছু গুছিয়ে রেখে এখানে যখন স্ত্রী পরিবার নিয়ে একেবারে চিরকালের মতো পাড়ি দেবার জন্য তাদের সাথে নিয়ে যেতে এসেছেন তখন স্ত্রীর কাছে শোনেন তার ভাগ্নী কদিন ধরে নিখোঁজ।স্বামীকে সান্তনা দিতে তিনি এও বলেন যে তিয়াসার খোঁজ খবর পাওয়ার প্রচুর চেষ্টা করেও তার খোঁজ আর পাওয়া যায়নি।কিন্তু স্ত্রীর আচার আচরণে অচিন্ত্যবাবুর মনে সন্দেহ দানা বাঁধে।তিনি যে পরিবার নিয়ে একেবারে বিদেশে চলে যাওয়ার জন্য এখানে এসেছেন সেকথাটা স্ত্রীর কাছে যেভাবে সারপ্রাইজ হিসেবে রেখেছিলেন সেভাবেই তার এই পরিকল্পনা গোপনে রাখলেন।সমস্তকিছুকে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্হগিত রেখে গোপনে তিনি তিয়াসার খোঁজ শুরু করলেন হন্যে হয়ে।মরিয়া প্রচেষ্টার পর অবশেষে তিনি খোঁজ পেলেন ভাগ্নীর।রাতুলের সাথে ঘরে প্রবেশরত মামাকে দেখে তিয়াসার খুশি আর ধরল না।সে একছুট্টে গিয়ে মামা কে জড়িয়ে ধরল একমুখী হাসি নিয়ে।রাতুল আর বাকি সবাই জানল বাপ মা হারা তিয়াসার সমস্ত অতীত।কিন্তু অচিন্ত্যবাবু তখনও বুঝে উঠতে পারেননি এই রাতুলের সাথে বিয়ের তোড়জোড় চলছে তার আদরের ভাগ্নীর।তিনি যখন তিয়াসাকে নিজের সাথে করে নিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করলেন তখনই ভীষণভাবে বেঁকে বসল তিয়াসা।সে কিছুতেই যাবে না মামার সাথে। সে রাতুলের সাথেই থাকবে একথা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়ে ভীষণরকম শক্ত করে চেপে ধরল রাতুলের হাত।অচিন্ত্যবাবু জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে তাকালেন রাতুলের দিকে। রাতুল একটা লজ্জামিশ্রিত ভয় ও ইতস্ততভাব নিয়ে একদম চুপ হয়ে গেল।পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে এনে হইহই করে আসল ব্যাপারটা তখন সেখানে উপস্থিত পাড়াপ্রতিবেশীরাই পরিষ্কার করে দিল।সাথে সকলে মিলে রাতুলের হাতে তাঁর ভাগ্নীকে সম্প্রদানের জন্য করজোড়ে অনুরোধ জানাল।অচিন্ত্যবাবু সাথে সাথেই তাতে মত দিলেন খুশিমনে।চতুর্দিকে তখন খুশির রোশনাই আবার দ্বিগুণ হয়ে ফিরে এল।অচিন্ত্যবাবু তার মনের মতো করে তার ভাগ্নীকে বিদায় দেবার উদ্দেশ্যে তখনকার মতো তিয়াসাকে নিয়ে যাবার প্রস্তাব দিলেন।তিয়াসাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতে সেও খুশি মনেই মামার সাথে যাবার জন্য ব্যাগট্যাগ গোছাতে শুরু করল।মামা নিজে ভাগ্নীর অপটু হাতের সাথে সেই কাজে লাগালেন হাত।অতঃপর সূর্যাস্তের দিকে উদাস তাকিয়ে আনমনা রাতুলকে কাঁধ ঝাঁকিয়ে হুঁশে আনলেন।"মাত্র তো কটা দিনের ব্যাপার।তারপরই একেবারে এখানেই থাকবে তিয়াসা চিরকালের জন্য"এই কথাটা পাখিপড়া করে বোঝাতে বোঝাতে কোনোমতে তিয়াসাকে সেই ঘর থেকে বার করে এনে গাড়িতে তুলতে সমর্থ হলেন অচিন্ত্যবাবু।আকাশের অসীমতার কোলে মেঘের সাথেই একাকার হয়ে ভাসতে লাগল রাতুল আর তিয়াসার উদাস চোখের আকুল করা মন কেমনের মূর্ছনাগুলি।

তিয়াসাকে বাড়িতে আনবার সাথে সাথেই স্ত্রীর সাথে তার তুমুল গন্ডগোল আর বিরোধ শুরু হল।যে আপদকে বুদ্ধি খাটিয়ে কোনোমতে ঘাড় থেকে নামানো গেছে সে আবার কোথা থেকে উড়ে এসে একেবারে আগের মতোই জুড়ে বসতে চাইছে দেখে আর সহ্য হল না তিয়াসার মামীমার।তিনি একেবারে দক্ষযজ্ঞ বাঁধিয়ে দিলেন।অতঃপর মাথা ঠান্ডা করে সবটা শুনলেন।অচিন্ত্যবাবু স্ত্রীকে বললেন,"তোমার মতো হৃদয়হীন মহিলার সাথে ঘর করবার কোনো প্রবৃত্তিই এখন আর নেই আমার। কিন্তু এখন আমার কপালে শিরে সংক্রান্তি।এখন নিজের সন্তানের ভবিষ্যৎ সবার আগে।কারণ তিয়াসা যার কাছে এতদিন ছিল তার বাবাকেই আমি একসময় কিছু টাকার ভাগ বাঁটোয়ারার অংশীদার হওয়ার জন্য পিছন থেকে কলকাঠি নেড়ে সর্বস্বান্ত করেছিলাম। ওর সাথে কথা বলেই আমি নিশ্চিত হয়েছি ছেলেটির পিতৃপরিচয় সম্বন্ধে। এই ছেলে আজ যদি কোনোভাবে এই সত্যিটা জেনে যায় যে ওর বাবার বরবাদির মূল কালপ্রিট আমি ছিলাম আর তার সাথে যদি ওর ঘরে আমার সিগনেচার করা সেই কাগজগু‌লো থেকে থাকে তাহলে আজ নয় কাল প্রমাণসমেত সেই ছেলে আমায় আইনীভাবে চেপে ধরতে পারে।আর একমূহুর্ত যদি এখানে সময় নষ্ট করি তাহলে শিলিগুড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতা আসা আর বিদেশে চিরকালের মতো পালিয়ে যাওয়ার জন্য এতদিনের সব পরিশ্রম ভন্ডুল হয়ে যাবে।আমি এবার তোমাদের এখান থেকে আমেরিকায় নিয়ে যেতে এসেছি।তিয়াসা আমাদের সাথে যাবে কি যাবে না এই নিয়ে অশান্তি করে যদি নিজের মেয়ের ভবিষ্যৎ জলাঞ্জলি না দিতে চাও তো যত তাড়াতাড়ি পারো আমাদের চারজনের ব্যাগপত্র গুছিয়ে নাও।জলদি।"
মামীমা আর কথা না বাড়িয়ে একরাশ অসন্তোষ আর ক্ষোভ নিয়ে ব্যাগপত্র গোছানো শুরু করল।চোখের নিমেষেই ঘরের সমস্ত ফার্নিচার বিক্রীটিক্রী করে বাড়ির চাবিখানি ভাইকে ডেকে শিলিগুড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে ভাগ্নীকে নিয়ে সপরিবারে বিমানে চেপে উড়ান দিলেন আমেরিকার গন্তব্যে।
রাতুলের ঘর থেকে তিয়াসাকে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে তার সাথে অচিন্ত্যবাবু আর কোনোরকম যোগাযোগই রাখেননি।এখন সমস্ত ব্যাপারটা স্পষ্ট রাতুলের কাছে।বাস্তবকে সে যুক্তি দিয়ে মেনে নিয়ে ব্যস্ত হল আগের মতোই প্রতিদিনের রোজনামচায়।কিন্তু হঠাৎ আজ তার জীবনটা ভীষণভাবে অর্থহীন মনে হচ্ছে।যেন তার সুন্দর সাজানো জীবনটাতে এমনভাবে ধ্বস নেমেছে যে জীবনের প্রতিটি সুর প্রতিটি ছন্দকে কুড়িয়ে কাছিয়ে এক সূত্রে গাঁথার মরিয়া চেষ্টা করা সত্ত্বেও তাতে কৃতকার্য হওয়াটা এক কথায় অসম্ভব।যেন তার জীবনের এই বিশাল ধ্বংসস্তূপের মাঝখানে ভাঙ্গা ইঁট হাতে সে একা খুঁজে চলেছে বেঁচে থাকার কারণ।আজ ঘুম থেকে উঠে মনে হয়,তার করার মতো কোনো কাজই নেই।অফিস থেকে সে যতটা সম্ভব দেরিতে বেরোয়।যে রাতুল কটাদিন আগেও সূর্যাস্তের পরপরই ঘরে ফেরার জন্য শিশুর মতো উতলা হয়ে উঠত সেই রাতুল আজ ফাঁকা ঘরে তার একাকীত্বের মূক গোঙানিগুলিকে ভীষণভাবে ভয় পায়।ভীষণভাবে এড়িয়ে যেতে চায়।
বিদেশে পাড়ি দেওয়ার পরে তিয়াসার অবোধ মস্তিষ্কে এটা পরিষ্কারভাবে বোধগম্য হল যে তাকে ঠকানো হয়েছে। রাতুলকে আর সে চোখের সামনেও পাবে না কোনোদিন। কোমলস্বভাবের মিষ্টি মেয়েটি হঠাৎ যেন লাল কাপড় বাঁধা অন্ধ ষাড়ের ন্যায়ে ক্ষেপে উঠল।মরণপণ করে সে মুখে একটিই কথা নিয়ে রয়েছে। সে একবার রাতুলের কাছে যেতে চায়।পৃথিবী উল্টোদিকে ঘুরতে শুরু করলেও তার এই কথাখানা শুনতেই হবে।না হলে হয় এসপার নয় ওসপার।সে খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছে।সামনে যাকে পাচ্ছে তাকে রাতুলের কাছে একটিবার নিয়ে যাবার জন্য হাতেপায়ে ধরা থেকে শুরু করে আঁচড় কামড় দিয়ে তা শেষ করছে।আর পরিশেষে তাকে ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে হচ্ছে। এইভাবে দিন যায় রাত যায়।তিয়াসা এখন নিয়মিত শক থেরাপি নেয় আর দিনের বেশির ভাগ সময় ঘুমের ওষুধ খেয়ে পড়ে থাকে। আমেরিকাতে আসবার পর অচিন্ত্যবাবু কাজে আরো ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।তিনি পুনরায় স্ত্রীকেই তিয়াসার সমস্ত দায়িত্ব সঁপে দিয়ে শুধু এটুকু দাবী রেখেছেন,মেয়েটা যেন বাকি জীবনটা খাওয়াপরা সমেত একটা আশ্রয়ে থাকে।তিয়াসাকে নিয়ে আর কোনোকিছুই ভাববার প্রয়োজন নেই।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিয়াসার এইভাবে তিল তিল করে মৃত্যুরই প্রহর গুনছেন তার মামীমা যার জবাবদিহি চাওয়ার আজ একজনও অবশিষ্ট নেই।হাতে পায়ে শিকল বাঁধা অবস্হায় জানোয়ারের মতো পড়ে থাকে তিয়াসা।সেদিন প্রবল ঝড়জলের রাত।গুদামঘরের একপাশে শিকল বাঁধা তিয়াসা আধোঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎ তার মৃত হৃদপিঞ্জর ছিঁড়েখুঁড়ে কানে একটা ভীষণ পরিচিত চাপা ফিশফিশ কন্ঠস্বর ভেসে এল।"মামন...মামন..."
হঠাৎ যেন তার রুক্ষ হৃদয়ের প্রখর মরূভূমির তৃষ্ণার্ত বালুকারাশির সমস্ত আকুতি এক নিমেষে শান্ত করে তার মনের আকাশ জুড়ে নেমে এল তোলপাড় করা ঝড়।বাইরের ঝড়বৃষ্টির থেকেও সহস্রগুণ দামাল এই হঠাৎ সুনামি।অস্ফুটে গলা থেকে কোনোমতে স্বর বার করতে পারল তিয়াসা।রা...রা...তুল...
ততক্ষণে কাকভিজে হয়ে কোনোমতে ঘরের বাইরে অবস্হিত এই গুদামঘরটির জানলার স্ক্রুগলো তার সাথে আনা যন্ত্রের সাহায্যে সন্তর্পণে খোলার কাজটা অর্ধেকেরও বেশি শেষ করে এনেছে।অবশেষে জানলার পাল্লাটা খুলে সে উন্মাদের ন্যায়ে ছুটে এসে বুকে জড়িয়ে নিল তার জীবনের একমাত্র জীয়নকাঠি...প্রাণভোমরাকে।না আজ আর কোনো ভুল সে করবে না।তিয়াসা কে আজ সে এখান থেকে বার করে সাথে নিয়ে যাবেই।তারপর যা হওয়ার হোক কোনোকিছুর পরোয়া সে করে না।দামাল ঝড়বৃষ্টির এই দস্যি রাতে রাতুলের দুইবাহুর ভিতরে কোমল কুসুমের মতো ঢুকে গিয়ে যেন নতুন করে বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে পেল তিয়াসা।কেটে গেল হৃদয় তোলপাড় করা কিছু বোবা মূহুর্ত।হঠাৎ রাতুলের ভিতরে কে যেন বলে উঠল..."আর দেরী করা ঠিক নয়।এক্ষুনি পালাতে হবে।"
বিদ্যুৎ ঝলকানির আলোয় সে দেখতে পেল,ঘরের এককোণে দেওয়ালে একটা চাবি ঝুলছে।এদিকে তিয়াসার হাতে পায়ে শিকল।দুয়ে দুয়ে চার করে নিয়ে রাতুল চাবিটাকে হস্তগত করল।তারপর শিকলের মুখ খুঁজতে গিয়ে খুঁজে পেল শিকলের দুমুখ আটকানো একটি বড় তালা ঝুলছে।সে তাড়াতাড়ি করে চাবি দিয়ে তালাটা খুলে নিল।তারপর তিয়াসাকে আশ্বস্ত করল।তাকে কোনোরকম শব্দ করতে নিষেধ করল সে।তারপর তিয়াসার হাত ধরে তাকে জানলার বাইরে বার করে দিয়ে অতি সন্তর্পণে নিজে বার হয়ে এল জানলা দিয়ে।ব্যস।এবার একটু সাবধানতা অবলম্বন করে এই বাড়ির চত্বরটা পার হয়ে গেলেই জীবনের দিগন্তে শুধুই রামধনু ।কিন্তু হায়!সেই রামধনুর হাতে মৃত্যুর পরোয়ানা ধরিয়ে সামনে হঠাৎ এসে দাঁড়ালেন অচিন্ত্যবাবু স্বয়ং। রাতুল আর তিয়াসা দুজনই স্তব্ধ। কারোর মুখেই কথাটি সরল না।দুজনের হাত তখনো কিন্তু একইসাথে মুষ্টিবদ্ধ।নীরবতা ভাঙলেন অচিন্ত্যবাবু নিজে।তিনি বললেন,"রাতুল...আজ আমি তোমার কাছে স্বীকার করছি আমি অপরাধী।তোমার বাবার সর্বনাশ আর সর্বস্বান্ত হওয়ার মূল কারণ আমি।আমি তোমার কাছ থেকে পালানোর জন্যই এতদূরে এসেছি দেশ ছেড়ে। আমি ভেবেছিলাম এতেই আমার সন্তানের মঙ্গল।কিন্তু আজ যখন প্রতিমূহুর্তে দেখি আমার স্ত্রী নিজের সন্তানসম আরেক মেয়ের উপরে কি অমানুষিক নির্যাতনটাই করছে।ওর এটা বোঝার ক্ষমতা নেই যে এই এতবড় পাপের থেকে ও নিজে তো বটেই...আমাদের নিজেদের সন্তানও মুক্তি পাবে না।টাকা পয়সা দিয়ে ওকে মুড়িয়ে দিলেও কোনো না কোনোভাবে এই পাপের মাশুল দিতে গিয়ে ছারখার হবে ওও।তাই আজ আর আমার কোনো ভয় নেই।তুমি আমায় যা শাস্তি দেবার দিতে পারো।শুধু এটুকু অনুরোধ...আমার যে একটা ছোট মেয়ে আছে সেটা একটু দেখো।আমি আজ তোমার কাছে আত্মসমর্পণ করলাম বাবা...
মুখে অল্প হাসি এনে রাতুল বলল,"আসল কালপ্রিট আপনি তো নন..আপনি তো আমার সৎ নিষ্ঠাবান বাবার শত্রুদের বেতনভুক কর্মচারী ছিলেন মাত্র।আপনি যদি এই কাজ না করতেন তাহলে এই কাজ তারা অন্য কাউকে দিয়ে করাতো।আমি তো তাদের কোনো খোঁজ আজ পর্যন্ত পাইনি আর কোনোদিন পাবও না।লোক ঠকানোটা আসলিই আপনার রক্তে নেই।যদি থাকত তাহলে আপনার সই করা সেই কাগজগু‌লো আজ পর্যন্ত আমার কাছে রয়ে যেত না।ওরা ক
আপনাকে তাদের দাবার ঘুঁটি বানিয়ে কেটে পড়েছে আর আপনি অনুতাপের আমার থেকে পালিয়ে পালিয়ে বাঁচছেন!ওই সময়টায় তো আপনি এইটাও জানতেন না যে যাকে ঠকাচ্ছেন তারও একটি শিশু সন্তান আছে কাগজগু‌লো আজ আমার হাতে আছে বটে কিন্তু ওগুলো নিয়ে আমি সমস্ম দায় আপনার একার ওপরে চাপাতে পারব বড়জোর।আসল রাঘব বোয়ালদের শাস্তি দিতে পারব কি?আপনিই বলুন...
দীর্ঘশ্বাস ফেলে অচিন্ত্যবাবু বললেন,"কথাগুলো তো তুমি ঠিকই বলেছ।তবে কি জানো বাবা...অন্যায় তো আমি করেছি।আজ তার প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই।আজ তুমি যদি চাও আমায় শাস্তি দিতে পারো।আর না হলে আজ তুমি আমার কাছে যা চাও আমি আমার সাধ্যমতো তাই দিতে চাই তোমায়।"
---"ক্ষতিপূরণ আমি আপনার কাছে অবশ্যই চাইব।তবে টাকাপয়সা নয়।আপনার শাস্তিও আমার কাম্য নয়।আমার শুধু আপনার এই ভাগ্নীটিকে চাই।দেবেন? "
কাতর কন্ঠে বলল রাতুল।
নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। এ তো অতি আনন্দের কথা।আমি আজ এখনই তিয়াসার হাত তোমার হাতে তুলে দিলাম।রাতুলের হাতখানি ধরে সেটি চিৎ করে ধরে তার ওপরে তিনি রাখলেন তিয়াসার উপুড় করা হাত।
সুখে থাকো তোমরা।আমার আশীর্বাদ সব সময় তোমাদের সাথে থাকবে।সব সময় আমাকে তোমাদের পাশে পাবে।ওকে তোমার সাথে করে নিয়ে যাও।সময়ে অসময়ে কখনো ভুলে যেও না কেমন!
সম্মতির হাসি হাসল রাতুল।তিয়াসার মুখেও রামধনু যেন দ্বিগুণ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
আকাশ এখন শান্ত।রাতুল আর তিয়াসার হৃদয়জোড়া তোলপাড় করা সুনামিও থেকে গিয়ে এখন সেখানকার আকাশ সেজে উঠেছে সাতটি রঙএর উজ্জ্বল রোশনাইএ।দিগন্তজোড়া নতুন করে বাঁচার উদযাপনের সুরগুলি আাবার যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে।ফাঁকা রাস্তার নিস্তব্ধতা রাতুল আর তিয়াসার কলকল হাসিকথায় যেন রূপকথার কলম ধরেছে।তারা এখন ব্যস্ত টেডিবিয়ার খেলনা আর আচারের বোতলগুলি রাখার জায়গা নিয়ে মতবিবাদে...

রশ্মিতা দাস





আকাশে লালচে আভাযুক্ত সূর্যাস্তের স্বর্ণালী দ্যুতি ছড়িয়ে পড়েছে।পাখিদের বাসায় ফেরার কিচিরমিচির উল্লাসে চারদিকের বাতাস মুখরিত হয়ে উঠেছে।ফুটপাতের লাগোয়া বটগাছটির ক্রোড়দেশে অঘোরে ঘুমিয়ে থাকা বিশ বর্ষীয়া তিয়াসা চোখ কচলে জেগে উঠল। প্রাথমিক ঘোরটা কাটতে না কাটতেই সে তার সর্বনাশটা বুঝতে পারল।জনবহুল ভীড়ের রাস্তার মধ্যে সে "মামি মামি...তুমি কোথায়..." বলে ডুকরে কেঁদে উঠল।সে তো হারিয়ে গেছে।এখন এই অচেনা জায়গাটাতে মামা বা মামি তাকে কেমন করে খুৃঁজে পাবে!তাহলে কি আর তার ঘরে ফেরা হবে না?প্রবল আতঙ্কে তার গলা বুঁজে এল।আস্তে আস্তে করে তার মনে পড়তে লাগল সব।গতকাল সন্ধ্যার পর থেকেই তো হঠাৎ করে তার মামা আর মামি হঠাৎ কেমন ভালো হয়ে গিয়েছিলেন।বাবা মা অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার পর আজ মাস সাত কি আট হবে,সে মামা মামির কাছেই রয়েছে।মামির কাছে এত আদর আর যত্ন সে কোনোদিনও পায়নি।এমনকি তার জন্য মামি যখন এই নতুন সুন্দর লাল পোশাকটা কিনে আনলেন কোনো উপলক্ষ ছাড়াই,তখন মামাতো বোন হিংসা করায় মামি তাকে দু ঘা দিয়েছিলেন।দিদির সাথে সে আর কোনো খারাপ ব্যবহার করবে না,ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করবে না এই কথা দিয়ে তবে সে রেহাই পেয়েছিল।তিয়াসার মনে জ্বলে উঠেছিল খুশির রোশনাই।বাবা মা মরার এতদিন বাদে হলেও যা হোক...তাকে আর মামা মামির অত্যাচার আর মারধোর সইতে হবে না।তার ওপর কাল রাতে শুতে যাবার সময় মামিমা যখন বলে গেলেন,তার যতগুলো জামা ছিঁড়ে গেছে ততগুলো জামা ই তাকে নিয়ে শপিং মলে গিয়ে নিজে কিনে দেবেন,তখন তার খুুশি যেন ধরছিল না।সে আজ সক্কাল সক্কাল ঘুম থেকে উঠে চেষ্টা করল নিজে নিজে দাঁত ব্রাশ করতে।মা চলে যাবার পর এইসব নিত্যনৈমিত্তিক কাজ নিজে নিজে সারতে তার ভীষণ সমস্যা হত।মামি তো একটু সাহায্য করা দুর...ঘরের মেঝেতে তার লালা ঝরছে দেখেই মেরে মেরে আধমরা করে দিতেন।মামাতো বোন তিতির তখন খিলখিল করে হাসত।আজ মামি নিজে হাতে তাকে ব্রাশ করিয়ে,ভালো করে সাবান আর শ্যাম্পু সহযোগে স্নান করিয়ে নিজে হাতে করে ব্রেকফাস্টে বানানো চাউমিন খাইয়ে নতুন জামাখানি পরিয়ে ওকে পরীর মতো সাজিয়ে তৈরি করে গাড়িতে বসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল শপিং মলে তার জন্য নতুন জামাকাপড় কিনতে।গাড়িতে যেতে যেতে হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে মামি ওকে এই গাছতলায় বসিয়ে একটা বোতলের থেকে একটু শরবোত খেতে বললেন।মামির কথা শুনে ঢকঢক করে সুস্বাদু মিষ্টি আমের শরবতটা খেয়ে নিল তিয়াসা।তারপর মামি বললেন,তুই এখানে লক্ষী হয়ে বোস,আমি গাড়িটা একটু পার্ক করিয়ে আসছি।কাছেই শপিং মল।অবোধ তিয়াসা হাসিমুখে বলেছিল,আচ্ছা মামি।তারপর সে ব্যাগ থেকে পুতুলখানা বার করে খেলতে খেলতে হঠাৎ কেমন তার দুচোখ জুড়ে ঘুম নেমে এল।তারপর তার আর কিছু মনে নেই।এখন সন্ধ্যে গড়িয়ে অন্ধকার নামছে।সে এখন মামার বাড়িতে কেমন করে ফিরবে!কোনো বড় নাম অথবা ঠিকানা সে কিছুতেই মনে রাখতে পারে না।চারপাশে প্রচুর লোকজন চলাফেরা করছে তার সামনে দিয়ে।মা বলতেন,অচেনা লোকের সাথে কখ্খোনো কথা বলতে নেই।কিন্তু এখন তো রাত নেমে আসছে।কাউকে যদি সে ডেকে অনুরোধ করে তার মামার বাড়িতে তাকে যেন একটু পৌঁছে দেয়,তাহলেও তো লাভ নেই কারণ সে মামার বাড়ির ঠিকানা আদ্যোপান্ত ভুলে বসে আছে।অবশ্য ঠিকানা যে ঠিক কিভাবে কাজে লাগে সেটাও তো সে জানে না।তার মনে হল,ঠিকানা না বলতে পারলে মামার বাড়ি তাকে কেউ কি পৌঁছে দিতে পারবে না?একবার চেষ্টা করেই দেখা যাক...
সে ফুঁপিয়ে লাল হয়ে থাকা চোখদুটো দুহাত দিয়ে ভালো করে মুছে নিয়ে তাকাল সামনের দিকে।সামনে একটা পান সিগারেটের দোকান থেকে এক ভদ্রলোক সিগারেটের প্যাকেট কিনছে।সে কান্নাভেজা গলায় জড়ানো উচ্চারণে বলে উঠল,"এই লোকটা...একটু এদিকে শোনো..."
কোনো সাড়াশব্দ পেল না।আচ্ছা ঝামেলা তো...সে গুটিগুটি গাছতলা উঠে দু পা এগিয়ে এসে ভদ্রলোকের কনুই ধরে ঝাঁকাল।চমকে গিয়ে অফিস ফেরত রাতুল তাকাল পিছন দিকে।একটা জড়বুদ্ধি হাবা গোছের তরুণী মেয়ে একটা করুণ আকুতিপূর্ণ চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।জামাকাপড় দেখে তো ভিখারী বলে মনে হচ্ছে না।নিশ্চয়ই বাড়ির লোকেদের থেকে কোনোভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।রাতুল কিছু বলতে যাবে এমন সময় তিয়াসা কাতর কন্ঠে সজোরে বলে উঠল..."এই লোকটা...আমি হারিয়ে গেছি গো...আমায় একটু ঘরে পৌঁছে দাও না..."
রাতুল বুঝল তার আন্দাজ ভুল নয়।সে শুধালো...তোমার বাড়ি কোথায়?আমায় তোমার বাবা মায়ের নাম্বার দাও আমি চেষ্টা করছি তোমাকে তোমার বাড়ি পৌঁছে দিতে।তিয়াসা শশব্যস্ত কন্ঠে বলল,"বাবা মা তো আকাশে তারা হয়ে গেছে।তুমি আমায় মামার বাড়ি পৌঁছে দাও না...ওই যে গোলাপী রংএর তিনতলা বাড়িখানা..."
রাতুল মৃদু হেসে বলল,"বাড়ির রং নয়,তুমি আমায় তোমার মামার বাড়ির ঠিকানা টা বলো।"
তিয়াসা মাথা চুলকাতে লাগল তীব্র উৎকন্ঠায়।আমতা আমতা করে বলল,"ওই যে ব্যাচারামদার দোকানের পাশ দিয়ে গলি।তিনতলা বাড়ির ছাদে কত্তগুলো ফুলের টব আছে...ওই বাড়িখানা..."ফোঁপাতে লাগল তিয়াসা।ওই বাড়িতেই জানোয়ারের মতো ব্যবহার পেয়েছে তিয়াসা।ওই বাড়িতে ফিরে যাওয়ার চাইতে তার কাছে হয়তো চিরকালের জন্য হারিয়ে যাওয়াটাই ভালো।কিন্তু এখন তার পেট ক্ষিদেয় কাতরাচ্ছে।জড়বুদ্ধি হাবা হলেও কোনো অচেনা মানুষকে সে কখনোই মুখ ফুটে সে কথা বলতে পারছে না লজ্জায়।সেই যন্ত্রণাটাই কান্না হয়ে বেরিয়ে আসছে।রাতুলেরও সেটা বুঝতে খুব বেশি বেগ পেতে হল না।সাথে সে এটাও বুঝতে পারল যে এই অবোধ নারীর পক্ষে নিজের থাকার জায়গার সঠিক ঠিকানা বলতে পারা এক কথায় অসম্ভব। সে সহানুভূতিপূর্ণ কন্ঠে তিয়াসা কে শুধালো,তোমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে তাই না?
চাতকের দৃষ্টিতে তাকালো তিয়াসা রাতুলের চোখের দিকে।রাতুল কোমল কন্ঠে বলল,এসো আমার সাথে।
রাতুল তিয়াসাকে একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল।পেট ভরে তাকে মাছ ভাত খাওয়াল।রাতুল ভেবেছিল খাওয়া শেষে  মেয়েটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বলে বলে চেষ্টা করবে যদি কোনোভাবে তার বাড়ির ঠিকানা টা বেরিয়ে আসে...।কিন্তু খাওয়ার সময় যখন তিয়াসা ভাত সব্জি ঝালঝোল সবকিছু সারা মুখমন্ডলে আর সমস্ত জামাকাপড়ে ফেলে মাখিয়ে একশা করল আর শিশুর মতো অস্ফুটে রাতুলের কাছে তার মাছ বেছে দেবার জন্য দাবী জানাল, তখন রাতুল ঠিকানা জানতে পারার আশা পরিপূর্ণভাবে ত্যাগ করল এবং বুঝতে পারল,সর্বশরীরে যৌবন বিকশিত এই অবোধ মেয়েটিকে রাস্তায় একটু বেশিরাতে একা পেলে তো সব নিশাচর নরপিশাচেরা একেবারে ছিঁড়েখুঁড়ে খাবে।সে কোনোভাবে তখনকার মতো পকেট থেকে রুমাল বার করে মায়ের মতো তার মুখ হাত মুছিয়ে যতটা সম্ভব পরিষ্কার করে নিজের হাতে মাছের কাঁটা বেছে খাইয়ে দিল।তারপর তিয়াসাকে শুধালো,"তুমি আমার সাথে আমার বাড়িতে যাবে?"
পেট ভরে খেয়ে পরিতৃপ্ত তিয়াসা হাসিমুখে জবাব জানাল,"হ্যাঁ অ্যা অ্যা যাব"।
বেশ।তুমি তাহলে হাত মুখ ধুয়ে এসো আমি বিলটা পে করে আসি।তিয়াসা লক্ষী মেয়ের মতো ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে রাতুলের অঙ্গুলি নির্দেশ অনুসরণ করে মুখ ধোওয়ার বেসিনের দিকে এগিয়ে গেল।রাতুল খাবার বিল পে করে নিয়ে তিয়াসাকে নিতে এল ভিতরে।ভিতরে এসে তার একেবারে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ার মতো অবস্হা হল।সে দেখল,হাতমুখ ধুতে গিয়ে মেয়েটা কলের জলে পুরো স্নান করে গিয়েছে।একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে তিয়াসাকে বলল,এসো।আমার হাত ধরো।

জনবহুল রাস্তার ধারে ভীড় ও হকারে ঠাসা
ফুটপাতের মাঝ দিয়ে একজন অচেনা পুরুষের হাত ধরে এক জড়বুদ্ধি অবোধ নারী অদ্ভুত এক বিশ্বাস এবং অজানা এক ভরসার স্নিগ্ধ আশ্বাসে ধীর পায়ে চলতে লাগল অনিশ্চিত কোনো গন্তব্যের অভিমুখে।

শিশুকালে পিতৃবিয়োগ হওয়ার পরে আপন যৌথ পরিবার হতে ক্রমাগত অপমানিত আর অবশেষে বিতাড়িত হওয়ার পরে বাবার সঞ্চয় করে রাখা স্বল্প পুঁজি হাতে নিয়ে প্রায় এক কাপড়েই সদ্য বিধবা মায়ের সাথে সাত কি আট বছর বয়সে প্রথম অচেনা শহর কলকাতায় পা রেখেছিল ছোট্ট রাতুল।তারপর চরম দারিদ্র্য,জীবনযুদ্ধের চড়াই উতরাই রাস্তায় ক্ষতবিক্ষত হতে হতে অবশেষে এই অচেনা শহরের বুকে গড়ে নেয় তার ছোট্ট একটি স্হায়ী আস্তানা।রাতুল চাকরি পাওয়ার মাস কয়েকের মধ্যেই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পরলোকে পাড়ি দেন তার মা।তারপর থেকেই কার্যত এই এত বড় পৃথিবীর বুকে সে যন্ত্রের মতো বেঁচে আছে।একা।তার দু কামরা বিশিষ্ট একার এই সংসারটাতে জীবনের সমস্ত অর্থ যেন ভাষাহীন...দিশাহীন।ঘরদোরের প্রতিটি দিক,প্রতিটি কোণা যেন সেই দিকভ্রষ্টতার দিশাহীনতা তীব্রভাবে প্রতিফলিত করে চলেছে।ঘরখানার দশা এমন,যে সে ঘরে আদৌ মানুষ থাকে নাকি গোরু ছাগল থাকে প্রথমটা সেইটাই ঠাহর করা মুশকিল হবে।সাত পাঁচ কিছুমাত্র চিন্তাভাবনা না করেই সে ঘরে আজ দিনশেষে রাতুল সাথে করে নিয়ে এসেছে এক নতুন অতিথিকে।বারান্দার গেটের তালা খুলে রাতুল দরজার লক খুলে ভিতরে ঢুকতে যাবে,এই সময়ে সে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল,নবাগত অতিথিটি এখনো একবুক সংকোচ নিয়ে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।"ভিতরে এসো...লজ্জা কি!"বলে রাতুল বাইরে এসে তিয়াসার হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে প্রায় টেনে নিয়ে এল ঘরের ভিতরে।ঘরের ভিতরে পা দিয়ে সে প্রথম উপলব্ধি করল,এই ঘর কোনো মানুষের বাসযোগ্য নয়।বিছানার উপর সপ্তাহখানেকের উপর হতে জমিয়ে আসা অগোছালো জামাকাপড়ের ডাঁই এতটাই উঁচু একখানা ঢিবির রূপ নিয়ে নিয়েছে যে বেশ কদিন তো রাতুল অফিস থেকে ফিরে খাওয়া সেরে মেঝেতেই মাদুর পেতে ঘুমের কাজ সারছে।চেয়ারের উপর অফিসের ফাইলপত্রের ডাঁই আর সারা টেবিল জুড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যেন হরেকমালের দোকান দিয়েছে।বাসনপত্র রান্নাঘরের চৌহদ্দি পেরিয়ে বসা কাম শোওয়ার একমাত্র এই ঘরটিতে তার দখলদারি ছড়িয়েছে। মা গত হওয়ার পর থেকে কোনোদিন ঘরখানার দিকে রাতুল ঠিকভাবে তাকায়নি।আজ হঠাৎ এমন এক ঘটনাচক্রে সে এক নবাগতা অতিথির হাত ধরে তার নিজের এই ঘরখানায় প্রবেশ করেই হঠাৎ যেন তার সবকিছু অসহ্য ঠেকল।এতদিন বাদে সে যখন প্রথম উপলব্ধি করল তার এই ঘরখানা আসলেই মানুষের বাস করার অযোগ্য,সে তখন মনে মনে নিজেকেই নিজে গাল পাড়তে লাগল।তারপর চেয়ার টেবিল ছোট আলমারী আর খাটখানার মাঝে একখানা মাদুর পেতে দিয়ে তিয়াসাকে বলল,তুুমি এইখানে একটু বসো,আমি ততক্ষণ ঘরটা একটু গুছিয়ে দিই।তিয়াসা তার কথামতো মাদুরে গিয়ে বসে ঘরদোরের ছিরিছাঁদ ফেরাতে ব্যস্তসমস্ত রাতুলের দিকে এক অদ্ভুত মায়াময় দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে রইল ফ্যালফ্যাল করে।বছরের পর বছর ধরে যে কাজগুলির কোনো প্রয়োজনীয়তাই রাতুল অনুভব করেনি আজ হঠাৎ কোন এক অজ্ঞাত তাগিদে প্রায় এক লহমায় জামাকাপড় ভাঁজ করে রাখা থেকে শুরু করে ঘরের প্রতিটি জিনিসকে তার সঠিক জায়গাতে গুছিয়ে রেখে ঘর ঝাঁটপোছ করে ঘরখানার প্রায় ভোল পালটে ফেলল।তারপর তিয়াসার জন্য সুন্দর করে মশারি খাটিয়ে বিছানা করে দিল।কিন্তু মুশকিল হল,তিয়াসার পরনের পোশাক খানি নিয়ে।এমন দামী আর শৌখিন পোশাক পরে তো আর বিছানায় শোওয়া যায় না...আর রাতুলের ঘরে তো পোশাক বলতে তার নিজের শার্ট প্যান্ট আর গেঞ্জি পাজামা ছাড়া আর কিছুই নেই।মায়ের কিছু শাড়ি আছে অবশ্য,কিন্তু এই জড়বুদ্ধি হাবা মেয়েটির গায়ে শাড়ি যদি কোনোভাবে জড়িয়েও দেওয়া যায়,সেই শাড়িতে সে নিজেই জড়িয়ে টরিয়ে মেঝেয় পড়ে হাড়গোড় ভাঙবে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।কি করা যায়...উপায় না দেখে রাতুল নিজের ঘরে পরার একটা ট্রাউজার আর একটা টি শার্ট নিয়ে এল তিয়াসার সামনে।সে তিয়াসার সামনে গিয়ে সন্তর্পণে দাঁড়াল।সে লক্ষ্য করল,তিয়াসা দেওয়ালের একটা কোণ আঁকড়ে গুটিসুটি হয়ে একেবারে সিঁটিয়ে বসে আছে।রাতুল ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আস্তে করে ওর চিবুকটা তুলে ধরল।কয়েক মূহুর্তের জন্য সে তিয়াসার কাজল টানা দীঘল চোখদুটির নিষ্পাপ আর সরল চাহনির নিটোল মায়ায় কেমন যেন হারিয়ে গেল।রাস্তার পাশে হঠাৎ সজোরে বারোটার ঘন্টা বেজে উঠতেই তার সম্বিৎ ফিরল।হাতে ধরা টি শার্ট আর ট্রাউজার টা তিয়াসার সামনে এগিয়ে ধরে রাতুল বলল,এই নাও।এখনকার মতো এই জামা দিয়ে কাজ চালিয়ে নাও।কাল সকালে তোমার জন্য নতুন জামা কিনে আনব কেমন!
রাতুলের হাতে ধরা টি শার্ট আর ট্রাউজার খানি খপ্ করে ধরে ফেলল তিয়াসা।তারপর সারাদিন ধরে গায়ে চেপে থাকা এই দামী পোশাকের ধড়াচূড়োখানা অপটু হাতে টান মেরে খুলে ফেলতে গেল সে।রাতুল কোনোমতে তাকে আটকাল।তারপর বলল,এখানে নয়।তুমি বাথরুমে যাও।ফ্রেশ হও।আমি ততক্ষণে খাওয়াটা শেষ করে নিই কেমন!রাতুলের কথা শুনে সে বাধ্য মেয়ের মতো তার অঙ্গুলি নির্দেশ অনুসরণ করে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল।রাতুল রান্নাঘরের দিকে গেল নিজের জন্য কিছু খাবারের বন্দোবস্ত করতে।সন্ধ্যের পরে অন্য সব দিনে সে অফিস থেকে ফিরে এসে ফ্রিজ থেকে সকালের কুটে রাখা সব্জি আর ভেজে রাখা মাছ দিয়ে ভাতের সাথে একটা ঝোল বা তরকারি যা হোক কিছু চাপিয়ে দেয়।সেটা হতেও খুব বেশি সময় লাগে না।কিন্তু আজ তো সে একা নয়,ফিরেছে দোকা হয়ে।তায় ঘরটিকে অচেনা আগন্তুকের পক্ষে একটু বাসযোগ্য করতে গিয়েই দিনের এই বাকি সময়টুকু যেন এক লহমাতেই ফুরিয়ে গেল।এখন এই পরিশ্রান্ত শরীর নিয়ে রান্না করা তো দূর,ভাত বসাতে গিয়েও যেন মনে হচ্ছে,হাঁটুতে যেন কেউ ভারী পাথর বেঁধে দিয়েছে।সে মুড়ির টিন থেকে বাটিতে কিছুটা মুড়ি ঢেলে নিয়ে তাতে কিছুটা চানাচুর ঢেলে নিল।ক্ষুধার্ত পেটে সেটাই এক নিমেষে শেষ করে রান্নাঘরের আলো বন্ধ করে সে শোবার ঘরে এল।ঘরে ঢুকে সে দেখল,মশারির ভিতরে সারা শরীরখানিকে গুটুলি পাকিয়ে নিয়ে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে কাদা হয়ে রয়েছে মেয়েটা।জামাকাপড় কেমন করে পরতে হয় এটাই বোধহয় মেয়েটা আজ পর্যন্ত শিখে উঠতে পারেনি।একমুখ মায়া ঢালা গভীর ঘুমে অবচেতন শরীরটির আনাচে কানাচে তাই বড়ো বেখাপ্পা ভাবেই উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে বিশ বর্ষীয়া তারুণ্যের উদ্দাম যৌবন।রাতুল একদৃষ্টে তিয়াসার মুখের দিকে চেয়ে রইল।অসহায় এই অপরিচিতার পরম নিশ্চিন্তের এই সুখনিদ্রা যেন রাতুলকেও কোনো একটা অব্যক্ত তৃপ্তির সাগরে ভাসিয়ে নিল।সে পরম মমতায় তিয়াসার কপালে তার হাতখানি রেখে দুই ভুরুর মাঝে একটা স্নেহ চুম্বন এঁকে দিল।তারপর মশারিটা ভালো করে গুঁজে দিয়ে নিজের জন্য মেঝেতে মাদুর পেতে চাদর আর বালিশ দিয়ে প্রতিদিনকার মতো নিজের বিছানা করে নিল।তারপর আলো নিভিয়ে সেও নিদ্রার সাগরে অস্তমিত হল।
হঠাৎ মাঝরাতে সে অনুভব করল,কেউ যেন তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরে থরথর করে কাঁপছে।সে দারুণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।মেয়েটা তার বুকের মধ্যে সভয়ে মাথা গুঁজে একমনে কি যেন বিড়বিড় করছে।রাতুল বুঝল কোনো কারণে বোধহয় মেয়েটা নিদারুণ ভয় পেয়ে গিয়েছে।সে সস্নেহে তিয়াসাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলতে লাগল,"কি হয়েছে মামন?কি দেখে ভয় পেলে?"
তিয়াসা কাঁপা কাঁপা ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,ও ও ওইদিকে কেউ আছে!আমি শব্দ পেয়েছি।আমার ভীষন ভয় করছে ...অজানা কোনো এক মূক আতঙ্কে থরোথরো তিয়াসা রাতুলার শার্টের কলারটা খামচে ধরে ওর বুকের মধ্যে তীব্রভাবে মাথাখানি গুঁজে দিয়ে সেখানেই যেন আত্মরক্ষা হেতু আপাদমস্তক ঢুকে যেতে চাইছে।রাতুল বুঝতে পারল ব্যাপারখানা কি হয়েছে।ওর রান্নাঘরে দিন রাত নির্বিশেষে বিড়ালের উৎপাত লেগেই থাকে।আর ঝনঝন শব্দে বাসনকোসন এদিক ওদিক হয়ে যাওয়াটাও একটা নিত্য রুটিনের মধ্যেই পড়ে।এই শব্দে এখন আর রাতুলের ঘুমের বিঘ্ন ঘটে না।সে এক ঘুমেই রাতকে সকাল করে।কিন্তু এই আনকোরা জায়গায় আতঙ্কে থরহরিকম্প এই মেয়েটি যেভাবে রাতুলকে আঁকড়ে ধরে কাঁপছে তাতে রাতুল বুঝল,তার এই যেমন খুশি ছন্নছাড়া জীবনটাকে অনির্দিষ্ট কিছুদিনের জন্য মুলতুবি রাখতে হবে।এখন তার অনেক দায়িত্ব। সে সস্নেহে তিয়াসার পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলল...কিচ্ছু হয়নি মামন...ও তো বেড়ালের আসার শব্দ...ও রোজ আসে...
পরদিন থেকে রাতুলের রোজকার রুটিন একেবারে পালটে গেল আর পরিশ্রম একেবারে দ্বিগুণ হয়ে উঠল।সে কাকভোরে উঠে মুখহাত ধুয়ে সবার আগে জলখাবার বানিয়ে নেয়।তারপর তিয়াসাকে ঘুম থেকে তুলে ওকে মুখ হাত ধুইয়ে দিয়ে গলায় কাপড় বেঁধে খাইয়ে দেয়।তারপর নিজে চা জলখাবার খেয়ে নিয়ে তিয়াসার দুপুরের খাবার জন্য ভাত তরকারি রান্না করতে বসে।রান্নাটান্না সেরে সে তিয়াসাকে স্নান করাতে নিয়ে যায়।টিশার্ট আর ট্রাউজার পরিহিতা তিয়াসাকে ভালো করে জল ঢেলে স্নানটান করিয়ে গা মুছিয়ে সে কাচা টিশার্ট আর ট্রাউজার সমেত তিয়াসাকে শোবার ঘরে পাঠিয়ে দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেয়।এবার সে নিজে স্নান সেরে নিজের আর তিয়াসার সব জামাকাপড় কেচেধুয়ে মেলে দিয়ে শোবার ঘরে নক করে নিয়ে ঢোকে।তারপর তিয়াসার অপটু হাতে পরা টিশার্ট আর ট্রাউজার নিজে ঠিকঠাক করে দিয়ে তিয়াসার চুল আঁচড়ে দেয় সযত্নে।কপালে পরিয়ে দেয় টিপ।তারপর সে রান্না করে রাখা ভাত তরকারি তিয়াসার জন্য থালায় করে বেড়ে রেখে দিয়ে ঝুরি দিয়ে চাপা দিয়ে রেখে দেয়।এরপর সে নিজে অফিস যাওয়ার জন্য তৈরি হয়।বেরোনোর সময় তিয়াসাকে বাইরে একা না বেরোনোর জন্য সাবধানবাণী দিয়ে কপালে একটা স্নেহচুম্বন এঁকে দিয়ে অফিসে বেরিয়ে যায়।সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিয়াসা ঘরে একাই থাকে।তবে এতে তিয়াসার কোনো অসুবিধা হয় না।কারণ রাতুলের ওই ছোট্ট ঘরটির ভিতরেই সে এমন ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছে যেটা তাকে কোনোভাবে তার বাবা মায়ের স্নেহ ভালোবাসা আর যত্নের সমস্ত অভাব ভুলিয়ে দিয়েছে। আর তাছাড়া রাতুল অনেক রকমের খেলনা আর পুতুল কিনে এনে ঘরে রেখেছে  তিয়াসার জন্য।বাক্স থেকে ধুলো ঝেড়ে পরিষ্কার করে রেখেছে বহুদিনের ব্যবহার না হওয়া পুরোনো টিভিটা।কেবলের মাধ্যমে ওই টিভিতে রাতুল চালু করে দিয়েছে তিয়াসার পছন্দের সব কার্টুন চ্যানেল।তিয়াসার এখন দিন কাটছে বেশ।রাতুল বেরিয়ে যাওয়ার পর সে বিছানায় সাজিয়ে নেয় খেলনা পুতুল আর টিভি খুলে চালিয়ে দেয় পছন্দের চ্যানেল।ঘরে রাখা থাকে নাড়ু বরফি।ইচ্ছেমতো সেগুলো নিয়ে খায়।দুপুরের পর থেকেই তার মধ্যে আরম্ভ হয়ে যায় এক অস্হির তোলপাড়। ক্রমশ যত বিকেল গড়ায়,তত সেটা যেন অসহ্য ঠেকে।সন্ধ্যার দিকে অবশেষে যেই কলিং বেলের শব্দটা হয় সাথে সাথে তিয়াসার ভিতরে যেন উচ্ছ্বাসের জলফড়িংগুলি কোরাসে গান গেয়ে ওঠে।সে লাফিয়ে...নেচে...ছুটে...একনিমেষে গিয়ে দরজা খুলেই বাচ্চা মেয়ের মতো জড়িয়ে ধরে রাতুলকে।রাতুলও যেন দুপুরের পর থেকেই অফিসের কাজে মন বসাতে পারে না কিছুতেই।মনটা শুধু পালাই পালাই করে।শুধু তার মনে হতে থাকে,এইসব অফিসের দায়িত্ব শেষ করে,বাস ট্রামের ঝক্কি পুইয়ে সে কখন ঘরে পৌঁছাতে পারবে।প্রায় দৌড়েই সে অফিস থেকে প্রতিদিন ঘরে আসে আর যখন কলিং বেল টেপার পরে একগাল মায়াভরা সরল সুমিষ্ট হাসি আর বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস নিয়ে দরজা খুলেই রাতুলের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার মামন,তখন রাতুলের মনে হয়,ওর জীবনের ছিন্নবিনার সমস্ত তারগুলি জুড়ে গিয়ে বাজতে শুরু করেছে সপ্তসুরের যাদুমূর্ছনা।এইভাবে দিন যায়।
আগের থেকে এখন রাতুলের খাটুনি যাচ্ছে প্রায় দ্বিগুণ। তা সত্ত্বেও তার মধ্যে কোনো ক্লান্তির উফ্ টুকুও নেই।উলটে তার মনে হচ্ছে,মামনের মামা মামীর খোঁজ আজ নয়,কাল করা যাবে'খন।ধীরে ধীরে তার এই চিন্তাতেও বদল এল।সে ঠিক করে নিল,তার আদরের মামনের মামার বাড়ির খোঁজ করার চিন্তা সে পুরোপুরি বাদ দিয়ে এবার সে এমন ব্যবস্হা করবে যাতে কোনোদিন তাকে মামনের কাছ থেকে আলাদা থাকতে না হয়।সে তিয়াসাকে বিয়ে করবে বলে মনঃস্হির করল।ইতিমধ্যে পাড়া প্রতিবেশীরাও ভীষণভাবে কানাঘুষো আরম্ভ করে দিয়েছে। ক্রমশ কানাঘুষো আর চাপাচাপির পরিধি পার করে সেটা একেবারে প্রকাশ্যে চলে এল।সবাই এবার রাতুলকে চেপে ধরল।সবাই তাকে বলল,এভাবে একটা আইবুড়ো মেয়েকে তুমি ঘরে রাখতে পারো না।যদি ওকে রাখতেই হয়,তাহলে ওকে বিয়ে করে নাও।রাতুল সবাইকে মুখের ওপরে জানিয়ে দিল,আর কয়েকদিনের মধ্যেই সে মেয়েটিকে বিয়ে করে নেবে।এখন মোটামুটিভাবে রাতুলের বিয়ের তোড়জোর আরম্ভ হয়ে গেল।রাতুল অফিসে কটাদিনের জন্য ছুটির আবেদন করল।বিয়ে শব্দটার অর্থ কি সেটা তিয়াসা না বুঝলেও সে যখন এটা বুঝল,একটা এমন ব্যবস্হা হচ্ছে যাতে সে এভাবেই রাতুলের সাথে সারাজীবন থাকতে পারবে তখন তিয়াসার মনে খুশি যেন আর ধরছে না।তার সীমাহীন প্রশ্রয়ে অর্থহীন বকবক শোনার অধীর আগ্রহ...তার ছোটো ছোটো দুষ্টুমি আর তাতে শাস্তির বদলে অকৃপণ আদর...এই যত্ন...এই ভালোবাসা থেকে যাবে সারাজীবন এটা সে তার অবোধ মস্তিষ্কে ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পেরেছিল।তার মনের গহিন কোণে উজ্জ্বল হতে থাকল বেঁচে থাকার উচ্ছ্বাস...তার সার্থকতা উদযাপনের সাতরঙা রামধনু।এরই মধ্যে হঠাৎ এক অপ্রত্যাশিত ঘটনার সম্মুখিন হল রাতুল।নিখোঁজ পরিবার পরিজনহীন মেয়েটি যে পুরোপুরি বেওয়ারিশ নয়...দুনিয়ার বুকে তার আপন রক্তের কেউ কোনোদিন তার খোঁজ করতে পারে তার প্রমাণ আজ এতদিন বাদে হঠাৎ হাতেকলমে পেল রাতুল এবং আন্তরিকতা আর আনন্দ নিয়ে বিয়ের আয়োজনে মশগুল পাড়া প্রতিবেশীরা।তিয়াসার নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই রীতিমতো হন্যে হয়ে তাকে খুঁজে চলেছেন তিয়াসার মামা অচিন্ত্যবাবু।তিনি কর্মসূত্রে আমেরিকায় থাকেন।তিয়াসার বাবা মা গত হওয়ার পর তিনি নিজে তার ভরণপোষণ সমেত সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে তাকে স্ত্রীর কাছে গচ্ছিত রেখে বলেছিলেন,এখন থেকে তোমার দুই মেয়ে।নিজের মেয়ের সাথে ওকেও সন্তানস্নেহে বড় করার দায়িত্ব এখন আমাদের। স্ত্রীর সেদিনের হাসিমুখে সম্মতিজ্ঞাপন দেখে তিনি এটা কখনোই আঁচ করতে পারেননি যে তিনি যদি বিদেশে প্রবাসী না হতেন তাহ‌লে সেদিন সেই সময়ে স্ত্রীর ঠিক কোন রূপ দেখতেন।ছমাসে কি বছরে একবার তিনি দেশে আসেন।এবার সেখানে সমস্তকিছু গুছিয়ে রেখে এখানে যখন স্ত্রী পরিবার নিয়ে একেবারে চিরকালের মতো পাড়ি দেবার জন্য তাদের সাথে নিয়ে যেতে এসেছেন তখন স্ত্রীর কাছে শোনেন তার ভাগ্নী কদিন ধরে নিখোঁজ।স্বামীকে সান্তনা দিতে তিনি এও বলেন যে তিয়াসার খোঁজ খবর পাওয়ার প্রচুর চেষ্টা করেও তার খোঁজ আর পাওয়া যায়নি।কিন্তু স্ত্রীর আচার আচরণে অচিন্ত্যবাবুর মনে সন্দেহ দানা বাঁধে।তিনি যে পরিবার নিয়ে একেবারে বিদেশে চলে যাওয়ার জন্য এখানে এসেছেন সেকথাটা স্ত্রীর কাছে যেভাবে সারপ্রাইজ হিসেবে রেখেছিলেন সেভাবেই তার এই পরিকল্পনা গোপনে রাখলেন।সমস্তকিছুকে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্হগিত রেখে গোপনে তিনি তিয়াসার খোঁজ শুরু করলেন হন্যে হয়ে।মরিয়া প্রচেষ্টার পর অবশেষে তিনি খোঁজ পেলেন ভাগ্নীর।রাতুলের সাথে ঘরে প্রবেশরত মামাকে দেখে তিয়াসার খুশি আর ধরল না।সে একছুট্টে গিয়ে মামা কে জড়িয়ে ধরল একমুখী হাসি নিয়ে।রাতুল আর বাকি সবাই জানল বাপ মা হারা তিয়াসার সমস্ত অতীত।কিন্তু অচিন্ত্যবাবু তখনও বুঝে উঠতে পারেননি এই রাতুলের সাথে বিয়ের তোড়জোড় চলছে তার আদরের ভাগ্নীর।তিনি যখন তিয়াসাকে নিজের সাথে করে নিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করলেন তখনই ভীষণভাবে বেঁকে বসল তিয়াসা।সে কিছুতেই যাবে না মামার সাথে। সে রাতুলের সাথেই থাকবে একথা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়ে ভীষণরকম শক্ত করে চেপে ধরল রাতুলের হাত।অচিন্ত্যবাবু জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে তাকালেন রাতুলের দিকে। রাতুল একটা লজ্জামিশ্রিত ভয় ও ইতস্ততভাব নিয়ে একদম চুপ হয়ে গেল।পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে এনে হইহই করে আসল ব্যাপারটা তখন সেখানে উপস্থিত পাড়াপ্রতিবেশীরাই পরিষ্কার করে দিল।সাথে সকলে মিলে রাতুলের হাতে তাঁর ভাগ্নীকে সম্প্রদানের জন্য করজোড়ে অনুরোধ জানাল।অচিন্ত্যবাবু সাথে সাথেই তাতে মত দিলেন খুশিমনে।চতুর্দিকে তখন খুশির রোশনাই আবার দ্বিগুণ হয়ে ফিরে এল।অচিন্ত্যবাবু তার মনের মতো করে তার ভাগ্নীকে বিদায় দেবার উদ্দেশ্যে তখনকার মতো তিয়াসাকে নিয়ে যাবার প্রস্তাব দিলেন।তিয়াসাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতে সেও খুশি মনেই মামার সাথে যাবার জন্য ব্যাগট্যাগ গোছাতে শুরু করল।মামা নিজে ভাগ্নীর অপটু হাতের সাথে সেই কাজে লাগালেন হাত।অতঃপর সূর্যাস্তের দিকে উদাস তাকিয়ে আনমনা রাতুলকে কাঁধ ঝাঁকিয়ে হুঁশে আনলেন।"মাত্র তো কটা দিনের ব্যাপার।তারপরই একেবারে এখানেই থাকবে তিয়াসা চিরকালের জন্য"এই কথাটা পাখিপড়া করে বোঝাতে বোঝাতে কোনোমতে তিয়াসাকে সেই ঘর থেকে বার করে এনে গাড়িতে তুলতে সমর্থ হলেন অচিন্ত্যবাবু।আকাশের অসীমতার কোলে মেঘের সাথেই একাকার হয়ে ভাসতে লাগল রাতুল আর তিয়াসার উদাস চোখের আকুল করা মন কেমনের মূর্ছনাগুলি।

তিয়াসাকে বাড়িতে আনবার সাথে সাথেই স্ত্রীর সাথে তার তুমুল গন্ডগোল আর বিরোধ শুরু হল।যে আপদকে বুদ্ধি খাটিয়ে কোনোমতে ঘাড় থেকে নামানো গেছে সে আবার কোথা থেকে উড়ে এসে একেবারে আগের মতোই জুড়ে বসতে চাইছে দেখে আর সহ্য হল না তিয়াসার মামীমার।তিনি একেবারে দক্ষযজ্ঞ বাঁধিয়ে দিলেন।অতঃপর মাথা ঠান্ডা করে সবটা শুনলেন।অচিন্ত্যবাবু স্ত্রীকে বললেন,"তোমার মতো হৃদয়হীন মহিলার সাথে ঘর করবার কোনো প্রবৃত্তিই এখন আর নেই আমার। কিন্তু এখন আমার কপালে শিরে সংক্রান্তি।এখন নিজের সন্তানের ভবিষ্যৎ সবার আগে।কারণ তিয়াসা যার কাছে এতদিন ছিল তার বাবাকেই আমি একসময় কিছু টাকার ভাগ বাঁটোয়ারার অংশীদার হওয়ার জন্য পিছন থেকে কলকাঠি নেড়ে সর্বস্বান্ত করেছিলাম। ওর সাথে কথা বলেই আমি নিশ্চিত হয়েছি ছেলেটির পিতৃপরিচয় সম্বন্ধে। এই ছেলে আজ যদি কোনোভাবে এই সত্যিটা জেনে যায় যে ওর বাবার বরবাদির মূল কালপ্রিট আমি ছিলাম আর তার সাথে যদি ওর ঘরে আমার সিগনেচার করা সেই কাগজগু‌লো থেকে থাকে তাহলে আজ নয় কাল প্রমাণসমেত সেই ছেলে আমায় আইনীভাবে চেপে ধরতে পারে।আর একমূহুর্ত যদি এখানে সময় নষ্ট করি তাহলে শিলিগুড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতা আসা আর বিদেশে চিরকালের মতো পালিয়ে যাওয়ার জন্য এতদিনের সব পরিশ্রম ভন্ডুল হয়ে যাবে।আমি এবার তোমাদের এখান থেকে আমেরিকায় নিয়ে যেতে এসেছি।তিয়াসা আমাদের সাথে যাবে কি যাবে না এই নিয়ে অশান্তি করে যদি নিজের মেয়ের ভবিষ্যৎ জলাঞ্জলি না দিতে চাও তো যত তাড়াতাড়ি পারো আমাদের চারজনের ব্যাগপত্র গুছিয়ে নাও।জলদি।"
মামীমা আর কথা না বাড়িয়ে একরাশ অসন্তোষ আর ক্ষোভ নিয়ে ব্যাগপত্র গোছানো শুরু করল।চোখের নিমেষেই ঘরের সমস্ত ফার্নিচার বিক্রীটিক্রী করে বাড়ির চাবিখানি ভাইকে ডেকে শিলিগুড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে ভাগ্নীকে নিয়ে সপরিবারে বিমানে চেপে উড়ান দিলেন আমেরিকার গন্তব্যে।
রাতুলের ঘর থেকে তিয়াসাকে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে তার সাথে অচিন্ত্যবাবু আর কোনোরকম যোগাযোগই রাখেননি।এখন সমস্ত ব্যাপারটা স্পষ্ট রাতুলের কাছে।বাস্তবকে সে যুক্তি দিয়ে মেনে নিয়ে ব্যস্ত হল আগের মতোই প্রতিদিনের রোজনামচায়।কিন্তু হঠাৎ আজ তার জীবনটা ভীষণভাবে অর্থহীন মনে হচ্ছে।যেন তার সুন্দর সাজানো জীবনটাতে এমনভাবে ধ্বস নেমেছে যে জীবনের প্রতিটি সুর প্রতিটি ছন্দকে কুড়িয়ে কাছিয়ে এক সূত্রে গাঁথার মরিয়া চেষ্টা করা সত্ত্বেও তাতে কৃতকার্য হওয়াটা এক কথায় অসম্ভব।যেন তার জীবনের এই বিশাল ধ্বংসস্তূপের মাঝখানে ভাঙ্গা ইঁট হাতে সে একা খুঁজে চলেছে বেঁচে থাকার কারণ।আজ ঘুম থেকে উঠে মনে হয়,তার করার মতো কোনো কাজই নেই।অফিস থেকে সে যতটা সম্ভব দেরিতে বেরোয়।যে রাতুল কটাদিন আগেও সূর্যাস্তের পরপরই ঘরে ফেরার জন্য শিশুর মতো উতলা হয়ে উঠত সেই রাতুল আজ ফাঁকা ঘরে তার একাকীত্বের মূক গোঙানিগুলিকে ভীষণভাবে ভয় পায়।ভীষণভাবে এড়িয়ে যেতে চায়।
বিদেশে পাড়ি দেওয়ার পরে তিয়াসার অবোধ মস্তিষ্কে এটা পরিষ্কারভাবে বোধগম্য হল যে তাকে ঠকানো হয়েছে। রাতুলকে আর সে চোখের সামনেও পাবে না কোনোদিন। কোমলস্বভাবের মিষ্টি মেয়েটি হঠাৎ যেন লাল কাপড় বাঁধা অন্ধ ষাড়ের ন্যায়ে ক্ষেপে উঠল।মরণপণ করে সে মুখে একটিই কথা নিয়ে রয়েছে। সে একবার রাতুলের কাছে যেতে চায়।পৃথিবী উল্টোদিকে ঘুরতে শুরু করলেও তার এই কথাখানা শুনতেই হবে।না হলে হয় এসপার নয় ওসপার।সে খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছে।সামনে যাকে পাচ্ছে তাকে রাতুলের কাছে একটিবার নিয়ে যাবার জন্য হাতেপায়ে ধরা থেকে শুরু করে আঁচড় কামড় দিয়ে তা শেষ করছে।আর পরিশেষে তাকে ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে হচ্ছে। এইভাবে দিন যায় রাত যায়।তিয়াসা এখন নিয়মিত শক থেরাপি নেয় আর দিনের বেশির ভাগ সময় ঘুমের ওষুধ খেয়ে পড়ে থাকে। আমেরিকাতে আসবার পর অচিন্ত্যবাবু কাজে আরো ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।তিনি পুনরায় স্ত্রীকেই তিয়াসার সমস্ত দায়িত্ব সঁপে দিয়ে শুধু এটুকু দাবী রেখেছেন,মেয়েটা যেন বাকি জীবনটা খাওয়াপরা সমেত একটা আশ্রয়ে থাকে।তিয়াসাকে নিয়ে আর কোনোকিছুই ভাববার প্রয়োজন নেই।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিয়াসার এইভাবে তিল তিল করে মৃত্যুরই প্রহর গুনছেন তার মামীমা যার জবাবদিহি চাওয়ার আজ একজনও অবশিষ্ট নেই।হাতে পায়ে শিকল বাঁধা অবস্হায় জানোয়ারের মতো পড়ে থাকে তিয়াসা।সেদিন প্রবল ঝড়জলের রাত।গুদামঘরের একপাশে শিকল বাঁধা তিয়াসা আধোঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎ তার মৃত হৃদপিঞ্জর ছিঁড়েখুঁড়ে কানে একটা ভীষণ পরিচিত চাপা ফিশফিশ কন্ঠস্বর ভেসে এল।"মামন...মামন..."
হঠাৎ যেন তার রুক্ষ হৃদয়ের প্রখর মরূভূমির তৃষ্ণার্ত বালুকারাশির সমস্ত আকুতি এক নিমেষে শান্ত করে তার মনের আকাশ জুড়ে নেমে এল তোলপাড় করা ঝড়।বাইরের ঝড়বৃষ্টির থেকেও সহস্রগুণ দামাল এই হঠাৎ সুনামি।অস্ফুটে গলা থেকে কোনোমতে স্বর বার করতে পারল তিয়াসা।রা...রা...তুল...
ততক্ষণে কাকভিজে হয়ে কোনোমতে ঘরের বাইরে অবস্হিত এই গুদামঘরটির জানলার স্ক্রুগলো তার সাথে আনা যন্ত্রের সাহায্যে সন্তর্পণে খোলার কাজটা অর্ধেকেরও বেশি শেষ করে এনেছে।অবশেষে জানলার পাল্লাটা খুলে সে উন্মাদের ন্যায়ে ছুটে এসে বুকে জড়িয়ে নিল তার জীবনের একমাত্র জীয়নকাঠি...প্রাণভোমরাকে।না আজ আর কোনো ভুল সে করবে না।তিয়াসা কে আজ সে এখান থেকে বার করে সাথে নিয়ে যাবেই।তারপর যা হওয়ার হোক কোনোকিছুর পরোয়া সে করে না।দামাল ঝড়বৃষ্টির এই দস্যি রাতে রাতুলের দুইবাহুর ভিতরে কোমল কুসুমের মতো ঢুকে গিয়ে যেন নতুন করে বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে পেল তিয়াসা।কেটে গেল হৃদয় তোলপাড় করা কিছু বোবা মূহুর্ত।হঠাৎ রাতুলের ভিতরে কে যেন বলে উঠল..."আর দেরী করা ঠিক নয়।এক্ষুনি পালাতে হবে।"
বিদ্যুৎ ঝলকানির আলোয় সে দেখতে পেল,ঘরের এককোণে দেওয়ালে একটা চাবি ঝুলছে।এদিকে তিয়াসার হাতে পায়ে শিকল।দুয়ে দুয়ে চার করে নিয়ে রাতুল চাবিটাকে হস্তগত করল।তারপর শিকলের মুখ খুঁজতে গিয়ে খুঁজে পেল শিকলের দুমুখ আটকানো একটি বড় তালা ঝুলছে।সে তাড়াতাড়ি করে চাবি দিয়ে তালাটা খুলে নিল।তারপর তিয়াসাকে আশ্বস্ত করল।তাকে কোনোরকম শব্দ করতে নিষেধ করল সে।তারপর তিয়াসার হাত ধরে তাকে জানলার বাইরে বার করে দিয়ে অতি সন্তর্পণে নিজে বার হয়ে এল জানলা দিয়ে।ব্যস।এবার একটু সাবধানতা অবলম্বন করে এই বাড়ির চত্বরটা পার হয়ে গেলেই জীবনের দিগন্তে শুধুই রামধনু ।কিন্তু হায়!সেই রামধনুর হাতে মৃত্যুর পরোয়ানা ধরিয়ে সামনে হঠাৎ এসে দাঁড়ালেন অচিন্ত্যবাবু স্বয়ং। রাতুল আর তিয়াসা দুজনই স্তব্ধ। কারোর মুখেই কথাটি সরল না।দুজনের হাত তখনো কিন্তু একইসাথে মুষ্টিবদ্ধ।নীরবতা ভাঙলেন অচিন্ত্যবাবু নিজে।তিনি বললেন,"রাতুল...আজ আমি তোমার কাছে স্বীকার করছি আমি অপরাধী।তোমার বাবার সর্বনাশ আর সর্বস্বান্ত হওয়ার মূল কারণ আমি।আমি তোমার কাছ থেকে পালানোর জন্যই এতদূরে এসেছি দেশ ছেড়ে। আমি ভেবেছিলাম এতেই আমার সন্তানের মঙ্গল।কিন্তু আজ যখন প্রতিমূহুর্তে দেখি আমার স্ত্রী নিজের সন্তানসম আরেক মেয়ের উপরে কি অমানুষিক নির্যাতনটাই করছে।ওর এটা বোঝার ক্ষমতা নেই যে এই এতবড় পাপের থেকে ও নিজে তো বটেই...আমাদের নিজেদের সন্তানও মুক্তি পাবে না।টাকা পয়সা দিয়ে ওকে মুড়িয়ে দিলেও কোনো না কোনোভাবে এই পাপের মাশুল দিতে গিয়ে ছারখার হবে ওও।তাই আজ আর আমার কোনো ভয় নেই।তুমি আমায় যা শাস্তি দেবার দিতে পারো।শুধু এটুকু অনুরোধ...আমার যে একটা ছোট মেয়ে আছে সেটা একটু দেখো।আমি আজ তোমার কাছে আত্মসমর্পণ করলাম বাবা...
মুখে অল্প হাসি এনে রাতুল বলল,"আসল কালপ্রিট আপনি তো নন..আপনি তো আমার সৎ নিষ্ঠাবান বাবার শত্রুদের বেতনভুক কর্মচারী ছিলেন মাত্র।আপনি যদি এই কাজ না করতেন তাহলে এই কাজ তারা অন্য কাউকে দিয়ে করাতো।আমি তো তাদের কোনো খোঁজ আজ পর্যন্ত পাইনি আর কোনোদিন পাবও না।লোক ঠকানোটা আসলিই আপনার রক্তে নেই।যদি থাকত তাহলে আপনার সই করা সেই কাগজগু‌লো আজ পর্যন্ত আমার কাছে রয়ে যেত না।ওরা ক
আপনাকে তাদের দাবার ঘুঁটি বানিয়ে কেটে পড়েছে আর আপনি অনুতাপের আমার থেকে পালিয়ে পালিয়ে বাঁচছেন!ওই সময়টায় তো আপনি এইটাও জানতেন না যে যাকে ঠকাচ্ছেন তারও একটি শিশু সন্তান আছে কাগজগু‌লো আজ আমার হাতে আছে বটে কিন্তু ওগুলো নিয়ে আমি সমস্ম দায় আপনার একার ওপরে চাপাতে পারব বড়জোর।আসল রাঘব বোয়ালদের শাস্তি দিতে পারব কি?আপনিই বলুন...
দীর্ঘশ্বাস ফেলে অচিন্ত্যবাবু বললেন,"কথাগুলো তো তুমি ঠিকই বলেছ।তবে কি জানো বাবা...অন্যায় তো আমি করেছি।আজ তার প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই।আজ তুমি যদি চাও আমায় শাস্তি দিতে পারো।আর না হলে আজ তুমি আমার কাছে যা চাও আমি আমার সাধ্যমতো তাই দিতে চাই তোমায়।"
---"ক্ষতিপূরণ আমি আপনার কাছে অবশ্যই চাইব।তবে টাকাপয়সা নয়।আপনার শাস্তিও আমার কাম্য নয়।আমার শুধু আপনার এই ভাগ্নীটিকে চাই।দেবেন? "
কাতর কন্ঠে বলল রাতুল।
নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। এ তো অতি আনন্দের কথা।আমি আজ এখনই তিয়াসার হাত তোমার হাতে তুলে দিলাম।রাতুলের হাতখানি ধরে সেটি চিৎ করে ধরে তার ওপরে তিনি রাখলেন তিয়াসার উপুড় করা হাত।
সুখে থাকো তোমরা।আমার আশীর্বাদ সব সময় তোমাদের সাথে থাকবে।সব সময় আমাকে তোমাদের পাশে পাবে।ওকে তোমার সাথে করে নিয়ে যাও।সময়ে অসময়ে কখনো ভুলে যেও না কেমন!
সম্মতির হাসি হাসল রাতুল।তিয়াসার মুখেও রামধনু যেন দ্বিগুণ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
আকাশ এখন শান্ত।রাতুল আর তিয়াসার হৃদয়জোড়া তোলপাড় করা সুনামিও থেকে গিয়ে এখন সেখানকার আকাশ সেজে উঠেছে সাতটি রঙএর উজ্জ্বল রোশনাইএ।দিগন্তজোড়া নতুন করে বাঁচার উদযাপনের সুরগুলি আাবার যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে।ফাঁকা রাস্তার নিস্তব্ধতা রাতুল আর তিয়াসার কলকল হাসিকথায় যেন রূপকথার কলম ধরেছে।তারা এখন ব্যস্ত টেডিবিয়ার খেলনা আর আচারের বোতলগুলি রাখার জায়গা নিয়ে মতবিবাদে...
825 Views
9 Likes
1 Comments
5.0 Rating
Rate this: