জানি ঠিকিই দেখা হবে (পর্ব-৭)
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
সাইয়ারার হাত থেকে চায়ের ট্রেটা নিয়ে তার মেয়ের হাতে দিলো। জেবা কিছু বলতে গেলে সাইয়ারা তার হাত ধরে ফেললো। জেবা সাইয়ারার দিকে তাকালে সে ইশারায় তাকে থেমে যেতে বললো। জেবা নিজের রাগটাকে সামলে চুপ হয়ে গেলো। তারা পা বাড়ালো ফিরে যাওয়ার জন্য।
সাইয়ারার জায়গায় মুনিহাকে দেখে পরিবারের সবাই বেশ বিরক্ত হলেও বাইরের মানুষের সামনে প্রকাশ করলো না। কিন্তু জামীর রাগ দমাতে পারলো না। বাইরের মানুষদের সামনে রাগটা প্রকাশ না করার জন্য একটু আসছে বলে বেরিয়ে এলো। বাইরে এসে সাইয়ারাকে চলে যেতে দেখে রাগটা একটু কমলো তার। সে ভেবেছিলো হয়তো সাইয়ারা আসেনি কিন্তু সাইয়ারাকে দেখে বুঝলো মাজেদা তাকে ঘরে ঢুকতে দেয় নি। সে সাইয়ারাকে ডাক দিলে জেবা আর সাইয়ারা ফিরে তাকালো। জামীর কিছু বলার আগে সাইয়ারা বলে উঠলো।
- বাবা দয়া করে অন্তত আমার বিয়েতে আমার ইচ্ছা প্রাধান্য পাক।
কথাটা বলেই সাইয়ারা ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। জামীর আর কিছু বললো না। বিরক্তিতে ভ্রু কুচকে ফিরে এলো জাভেদের ঘরে। ঘরে প্রবেশের সময় শুনতে পেলো পাত্রপক্ষের মুনিহাকে খুব পছন্দ হয়েছে। জামীরের কানে ভেসে এলো যেন কেউ তার কানের কাছে বলছে সাইয়ারাকে তাদের পছন্দ হয়েছে। সে পেছন দিকে ঘুরে এলোমেলো দৃষ্টিতে এদিক ওদিক দেখতে লাগলো। মুহুর্তেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো জামীরের। সে চোখ বন্ধ করে কয়েকবার জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করলো। চোখ খুলতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো ছোট্টে সাইয়ারা। উঠান জুড়ে দৌড়ে বেরাচ্ছে সে। জামীর এক গাল হাসি নিয়ে ছোট্ট সাইয়ারাকে কোলে নেওয়ার জন্য পা বাড়াতেই সে গায়েব। জামীরের হাসিটা মিলিয়ে গেলো। যদিও মেয়েটা এখন তেমন সামনে আসে না। তবুও একটা শান্তনা থাকে যে মেয়েটাতো বাড়িতেই আছে। আজকে না হয় মুনিহার জন্য সাইয়ারা বিয়েটা আটকে গেলো কিন্তু একদিন তো সাইয়ারাকেও চলে যেতে হবে। মেয়েটার জন্য কখনও এমন অনুভূতি হয়নি তার। সময় কত তাড়াতাড়ি বয়ে যায়। তার কাজ ছুটে চলা। তার মতোই থেমে থাকে না বয়সও। ছুটে চলে সমতালে শুধু থমকে যায় স্মৃতি। যা আবদ্ধ হয়ে যায় সময় ও বয়সের বেড়াজালে। মাঝে মাঝে বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আমাদের মনে কড়া নাড়ে। জামীর আর জাভেদের ঘরে প্রবেশ না করে চলে গেলো নিজের ঘরে।
জামীর বিছানায় বসে রয়েছে। তার দৃষ্টি জানালার বাইরে। পেছন থেকে ফাজেলার কন্ঠে সম্মতি ফিরলো তার।
- মেমানরা যাইবোগা তুমারে খুজতাছে। ইট্টু দেহা কইরা যাও।
জামীর মাথা নাড়িয়ে দরজার দিকে যাওয়ার সময় আলমারির সাথে ধাক্কা খেলো। মুহুর্তেই দুলে উঠলো আলমারিটা। আলমারির দোলা সহ্য করতে না পেরে কিছু একটা পড়ে গেলো আলমারির উপর থেকে। সেই জিনিসটার মধ্যে জমে থাকা ধুলা ছড়িয়ে পড়লো ঘরজুড়ে। জামীর ডানে-বামে হাত নাড়িয়ে মুখের সামনে থেকে ধুলা সরিয়ে দিয়ে মেঝেতে তাকালে একটা খাতা পড়ে থাকতে দেখলো। সে কাশতে কাশতে খাতাটা হাতে নিলো। খাতাটা তারই অনেক আগের খাতা আলমারির উপরে সেই কবে রেখেছিলো দরকার পড়েনি তাই নামায়নি। অনেকদিন ধরে আলমারির উপরটা পরিষ্কার করা হয়না তাই বেশ ধুলা জমেছে। জামীর খাতার পাতাগুলো উল্টিয়ে উল্টিয়ে দেখছিলো। একটা পাতায় এসে আটকে গেলো। পাতাটায় ফুল আঁকা যে কেউ বলে দেবে এটা কোনো বাচ্চার আঁকা। জামীর মনে করার চেষ্টা করলো এটা কে আকতে পারে।
- আবু দেক পুল। আমি আকতি।
সাইয়ারা বলা কথাটা কানে ভেসে আসাই সে মুচকি হাসলো। তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো ছোট সাইয়ারা। একটু কলম ধরা শিখেছে কি শেখেনি যা পেতো হাতের কাছে সেই জিনিসটাই হয়ে যেতো তার আঁকি-বুকির স্থান। বেশি আঁকি-বুকি করতো তার দাদির শাড়িতে। প্রতিদিনই সাইয়ারার আঁকার জন্য বিচার আসতো জামীরের কাছে। জামীর মেয়ে কান্ডে হাসতো। ছোট থেকেই সাইয়ারা ছিলো চঞ্চল ধীরে ধীরে সেই চঞ্চলাতা কোথায় হারিয়ে গিয়েছে। পুনরায় ফাজেলার কন্ঠ পেয়ে জামীর খাতাটা রেখে বেরিয়ে গেলো। জাভেদের ঘরে প্রবেশ করতেই পাত্রপক্ষ বিয়েতে তার মত জানতে চাইলে সে বললো..,
- বাইতো বাড়িত নাই। বাই না আওয়া পর্যন্ত বিয়ার কতা-বার্তা বন্দ থাক। বাই আইয়া সিদ্ধান্ত নিবো হের ছেড়ির ব্যাপারে।
জামীর পাত্রপক্ষদের এগিয়ে দিতে গেলো।
সাইয়ারার জ্বরটা অনেকটা কমেছে। জেবা আর সাইয়ারা হাতে হাতে কাজ করে নিচ্ছে। রান্না প্রায় শেষের দিকে। জেবা অনুমার করলো বেশ এতোক্ষনে হয়তো পাত্রপক্ষরা চলে গেছে। সে সাইয়ারাকে তরকারিটা নামিয়ে রাখতে বলে বাড়ির সামনের দিকে গেলো। সবাইকে উঠানেই দেখতে পেলো। জেবা জামীরকে দেখতে না পেয়ে ফিসফিসিয়ে ফাজেলাকে জামীরের ব্যাপারে জিঙ্গাসা করলে সে জানালো জামীর পাত্রপক্ষকে এগিয়ে দিতে গেছে। সবাই মাজেদাকে মুনিহাকে পাত্রপক্ষের সামনে নিয়ে যাওয়ার কারণ জিঙ্গাসা করলে সে জানায় সাইয়ারা আসেনি।
মাজেদার কথাটা জেবার গায়ে গিয়ে লাগে। সে রেগে বলে উঠলো..,
- সাইয়ারা আইছিলো না, না তুমি হেরে গরো ডুকবার দিছো না। সত্যিডা কইয়ালাও।
এতোক্ষনে সবাই আসল সত্যিটা বুজতে পারলো। জেবার কথায় মাজেদা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো।
- কী কইলি তুই। আমি তোর মা। জন্ম তুই না আমি তোরে দিছি।
মায়ের কথার প্রতিত্তোর করার আগেই জালসান জেবা আর মাজেদাকে থামিয়ে দিলো।
- আর জামীর তোর ছেড়িরে তো হেগোর পছন্দও অইতো না অইলে। আইলেতো হেই বুড়িগর লাহানই সাইজ্জা আইতো। আমার এতো বয়স অইছে তাও আমি এমনে থাহি না তোর ছেড়ি যেমনে থাহে। বাড়ীর এক ছেড়ির না অইলেও অন্য ছেড়ির বিয়া ঠিক অইছে। এইডাই অনেক। এইডা লইয়া আর যাতে কুনু কতা না অয়।
সাইয়ারা তার কাজগুলো করছিলো জেবাকে তার ঘরে ঢুকতে দেখে চৌকির উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা কাগজগুলো সরিয়ে জেবা বসতে বলে পুনরায় নিজের কাজে মন দিলো। জেবা সাইয়ারা কাধে হাত রাখলে সাইয়ারা মুখ তুলে তাকালো। জেবার অনুতপ্ত দৃষ্টি তার নজর এড়ালো না। সে জেবার রাখা হাতের উপর হাত রেখে বললো..,
- কষ্ট পেয়ো না আপু।
জেবা সাইয়ারা পাশে বসলো।
- সাইয়ারা আমাকে মাফ করে দে। আমি তো পারতাম মাকে আটকাতে। তুই কেন আমাকে আটকালি বলতো। জায়গাটাতো তোর ছিলো।
সাইয়ারা কাধ থেকে জেবার হাতটা সরিয়ে নিজের দুহাতে আবদ্ধ করলো।
- যে জায়গাটা আমার না সেটা আমি নেই কি করে বলো তো।
- কিন্তু ওরা তো তোকেই দেখতে...
জেবার কথা শেষ হওয়ার আগেই সাইয়ারা তাকে আটকে দিলো।
- হুম জানি উনারা আমাকে দেখতে এসেছিলো। দেখতে এলেই তো বিয়ে হয়ে যায় না। আর সত্যি আজকে মুনিহাকে অনেক সুন্দর লাগছিলো। ওদের ওকেই পছন্দ হতো। আমাকে না।
- তুই কিভাবে বুজলি যে ওদের তোকে পছন্দ হতো না। আর পছন্দ না হলেও একটিবার তো যেতেই পারতি।
সাইয়ারা জেবার হাত ছেড়ে সামনের দিকে ঘুরে বসলো। তার দৃষ্টি দেয়ালে।
- পারতাম না। আর পারলেও চাইতাম না।
জেবা ভ্রু কুচকে সাইয়ারার দিকে তাকিয়ে বলল..,
- কেন?
সাইয়ারা দৃষ্টি তখনো দেয়ালে।
- তাকে আমার পছন্দ হয়নি?
জেবা এবার কিছুটা বিষ্মিত হলো।
- তুই তো তাকে দেখিসি নি। তাহলে তোর পছন্দ হয় না কি করে?
- সবসময় দেখার প্রয়োজন হয় না। উনি যদি ভালো মানুষি হতেন তাহলে এতোগুলো মানুষ নিয়ে আসতেন না।
জেবা সেকেন্ট খানেক সাইয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো..,
- ছেলেটা অনেক ভালো ছিলো সাইয়ারা। আর বিয়ে করাবে সবাই একটু কনেকে দেখবে না।
সাইয়ারা জেবার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। সাইয়ারার উপহার দেওয়া হাসিটা জেবাকে আরো বিষ্মিত করলো। সে জেবার চোখে চোখ রেখে বললো..,
- কন্যার পিতা মাত্রই স্বীকার করিবেন, আমি সৎপাত্র। তামাকটুকু পর্যন্ত আমি খাই না। ভালোমানুষ হওয়ার কোনো ঝঞ্ঝাট নাই, তাই আমি নিতান্ত ভালোমানুষ। এতো ভালো হওয়া সত্তেও অনুপমের সাথে কল্যাণীর বিয়ে হলো না কেন।
চলবে...
494
Views
11
Likes
0
Comments
4.3
Rating