বদরুন্নেসা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো....
- সাইয়ারা কী....।
কথা শেষ করার আগেই ঘরে সাইয়ারাকে শুয়ে থাকতে দেখে বিচলিত হয়ে বললো....
- কী হয়েছে সাইয়ারার।
- জ্বর উঠেছে।
বদরুন্নেসা সাইয়ারার কপালে হাত রাখলো।
- এতো জ্বর উঠেছে। ঔষুধ দিয়েছো।
- দিয়েছিলাম খায়নি।
আরো কিছু বলার আগে বাইরে থেকে কারোর আর্তনাত শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো জেবা আর বদরুন্নেসা। বাইরে এসে নীলাকে উঠানে বসে পায়ে হাত বোলাতে দেখে জেবা তাড়াতাড়ি করে তাকে উঠালো।
- পড়লে কীভাবে।
নীলা পিড়ির দিকে ইশারা করে বললো....
- আমি ফুল দেখতে দেখতে আসছিলাম এই কাঠে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলাম
নীলার কথা শুনে জেবা মনে মনে বললো....
*মোমের পুতুলটা। এই একটুর ব্যথা পাওয়ার জন্য এতো জোড়ে চিৎকার করতে হয়।*
জেবা বিরক্তিতে চোখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালো।
- এটা কাঠ না পিড়ি।
- আম্মু আব্বু তোমাকে ডাকছিলো।
বদরুন্নেসা নীলাকে ইশারা করে যেতে বললো।
- কাকী আপনি গিয়ে কাপড় পাল্টে নিন। আমি সাইয়ারার কাছে আছি।
বদরুন্নেসা চলে গেলে জেবা ঘর থেকে সাইয়ারার ডাক শুনে তার কাছে গেলো।
- উইঠ্ঠা পড়ছস। কিছুই তো খাইছস না। চল আগে কিছু খাইবি।
- অহন মন চাইতাছে না। কাকী গলা হুনলাম। কাকী আইয়া পড়ছে।
জেবা মাথা নেড়ে হ্যাঁ উত্তর দিলো। সাইয়ারা চৌকি থেকে নামার জন্য উদ্যত হলে জেবা তাকে কোথায় যাচ্ছে জিঙ্গাসা করলে সে উত্তর দিলো।
- ঢংগিডাও তো আইবো। হের তো আবার আঙ্গর খাওন মুহো রুচে না।
জেবা ধমকের সুরে বললো....
- হের চিন্তা করিস না। আমি আছি না।
সাইয়ারা কিছু বলতে গেলে জেবা তাকে আটকে দিলো।
- কইছি না তর চিন্তা করুন লাগতো না। চুপ কইরা বো আমি খাওন আনতাছি খাইয়া ঘুমাবি।
জেবা বেরিয়ে গেলো। জোহরের ওয়াক্ত হয়েছে। সাইয়ারা পরিষ্কার হয়ে জরুরি কাজ সেরে জেবাকেও জরুরি কাজ শেষ করতে বললো।
নীলা চুপচাপ বসে রয়েছে। মুখটা মলিন। জামীর বাইরে থেকে ফিরে বারান্দয় নীলাকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে বললো....
- খাইছো মা।
নীলা না-বোধক মাথা নাড়লো।
- ক্ষিদা লাগছে না। কি খাইবা সাইয়ারারে গিয়া কও। হে রাইন্দ দিবো।
নীলা ডান দিকে মাথা নেড়ে সাইয়ারা ঘরের দিকে হাটা শুরু করলো। জেবা সাইয়ারাকে খায়িয়ে এটো থালা বাসন পরিষ্কার করে ঘরে যাচ্ছিলো। সরু রাস্তাটার কাছে গিয়ে নীলাকে দেখে থেমে গেলো।
- সাইয়ারা আপু কোথায়?
জেবা সাইয়ারাকে খোজার কারণ জিঙ্গাসা করলে সে বললো....
- একটু দরকার ছিলো।
- কী দরকার আমাকে বলো?
নীলা কিছুক্ষণ কি যেন ভাবলো।
- আমার ক্ষুধা লেগেছে। সাইয়ারা আপুকে বলো আমাকে চিকেন কাবাব করে দিতে কম ঝাল দিয়ে।
*দাড়া তোর কাবাব তোকে দিয়েই বানাবো।*
- সাইয়ারাতো অসুস্থ। আমি তো জানি না কিভাবে কাবাব বানায়। তুমি আমাকে একটু দেখিয়ে দাও। আমি বানিয়ে দিচ্ছে।
নীলা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। জেবা মুরগির মাংস ধুয়ে নীলা কথা অনুযায়ী মসলা দিয়ে কিভাবে মাখবে জিঙ্গাসা করলো। নীলা জেবা বারবার বলে দিলেও জেবা করতে পারছে না। সত্যি কথা হলো সে ইচ্ছা করেই করছে না। কয়েকবার এমন হওয়ার পর জেবা নীলার দিকে মুরগির বোলটা এগিয়ে দিয়ে বললো....
- নাও তুমি একটু মেখে দেখিয়ে দাও তারপর আমি করে দিচ্ছি।
নীলা নাক মুখ কুচকে বমির ভাব করে কোনো মতো মুরগির টুকরোগুলো নাড়িয়ে হাত সরিয়ে নিলো।
- এভাবে মাখতে হবে।
নীলার অবস্থা দেখে জেবা মিটি মিটি হাসছে। জেবা মাখানো মাংসের টুকরা গরম তেলে ছাড়তে নিলে নীলা তাকে থামিয়ে কিছুক্ষণের জন্য রেখে দিতে বললো। জেবা মাখানো থালাদিয়ে বোলটাকে ঢেকে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে উঠানে বসলো।
সাইয়ারার বসে থাকতে ভালো লাগছে না। আর শরীর খারাপ নিয়ে জেবা তাকে কোনো কাজও করতে দেবে না। তাই কাজ নিয়ে বসেছিলো। কিছুক্ষণ কাজ করার পর বাইরে এসে জেবা আর নীলাকে উঠানে বসে কথা বলতে দেখলো। জেবা সাইয়ারার ঘরের দিকে সোজাসুজি বসে থাকায় সাইয়ারকে বেরিয়ে আসা দেখে সে চোখ রাঙ্গিয়ে তাকালো। তার চোখ রাঙ্গানো দেখে সাইয়ারা পুকুর পাড়ে চলে গেলো। নীলা জেবা দৃষ্টি অনুসরণ করে পেছনে তাকালে দূরে দুইটা বিড়ালকে মারামারি দেখলো। নীলা ঘড়ি দেখে জেবাকে বললো....
- আপু আধাঘন্টা হয়ে গেছে।
জেবা রান্নাঘরে গিয়ে মাংসগুলোকে আরেকটু নাড়িয়ে তেলে মধ্যে ঢেলে দিতে চাইলে নীলা তাকে আটকে দিলো।
- আপু একটা একটা করে দিতে হবে। আর এতো তেল কমাতে হবে।
জেবা ইচ্ছে করেই নামমাত্র তেল কমিয়ে নীলকে দেখালো নীলা আরো কমাতে বললে একই কাজ করলো। কয়েকবার এমন হওয়ার পর জেবা বিরক্তির ভাব নিয়ে বললো....
- বইন কখন থেকে শুধু তেল কমাতেই বলছো। তুমি কতটুকু তেল খাও আমি তো জানি না। তুমিই দেখিয়ে দাও। কড়াই গরম সাবধানে ধোরো।
নীলা বুঝলো জেবা আগে কোনো দিন এসব করেনি। এখন জেবাকে শেখাতে গেলে আর খাওয়াটায় হবে না। সে জেবাকে বেরোতে বলে নিজে রান্নাঘরে ঢুকলো। স্যাতস্যাতে রান্নাঘরটায় ঢুকে নীলার গা গুলিয়ে উঠলো। কোনো মতো তেল কমিয়ে মাংসেরটুকরোগুলো কড়ায়ে দিয়ে বেরিয়ে এলো। জেবা নীলার অবস্থা দেখে মিটি মিটি হাসছে। সাইয়ারা পুকুর পাড়ে বসে তাদেরকেই দেখছিলো। জেবা যে ইচ্ছা করেই নীলাকে খাটাচ্ছে তা সে বেশ বুঝতে পারছে। একবার ওদিকে যেতে চেয়েও গেলো না। নীলারও তো একটু শিক্ষা হওয়া দরকার। হয়তো শিক্ষাটা সাইয়ারা আরো আগেই দিতো। কিন্তু বাড়িতে ঝামেলা হবে তাই কিছু করেনি। আসলে সাইয়ারার পরিবারের কারোর সামনে যেতে ইচ্ছা করে না। একপ্রকার বাধ্য হয়েই যেতে হয়। জেবা যখন বললো তাকে আজকে দেখতে আসছে তখন তার মনে একটা আশা জেগেছিলো হয়তো তার মুক্তির সময় এসেছে। কিন্তু যখন শুনেছে ছেলেটা সরকারি চাকরি করে তখনই ছেলেটা তার অপছন্দে খাতায় চলে গেছে। সরকারি চাকরি মানেই ঘুষের আখড়া। আর ঘুষ ইসলামে হারাম। সাইয়ারাও এটা অপছন্দ। এই ব্যাপারে সে জেবার সাথে কথা বলেছে কিন্তু জেবা তাকে বুঝিয়েছে ছেলেটা ভালো আর দেখতে আসলেই তো আর বিয়ে হয়ে যায় না। তবুও সাইয়ারার মন সায় দিচ্ছে না। কেউ ঘুষ নিয়ে তো আর বুক ফুলিয়ে বলবে না সে ঘুষ নেয়। এটা গর্ব করে বলার মতো কাজও না।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হচ্ছে। একটু পরেই সাইয়ারাকে দেখতে ছেলের বাড়ির লোকজন আসবে। কাবাব রান্না করার সময় নীলার হাতে তেল ছিটে এসেছিলো। এটা নিয়েও ঝামেলা হতো কিন্তু জেবা সামলে নিয়েছে। আর বাড়িতে মেহমান আসবে তাই জামীরও কোনো ঝামেলা করেনি। সাইয়ারার জ্বর অনেকটাই কমেছে। তাই সে কাজগুলো নিয়ে বসলো। কিছুক্ষণ পর বদরুন্নেসা আর জেবা আসলো। জেবার হাতে একটা প্যাকেট। ঘরে এসে প্যাকেটটা সাইয়ারার দিকে এগিয়ে দিলো। সাইয়ারা প্যাকেটটা খুলে একটা সোনালি রঙের সিল্কের শাড়ি বের করলো।
- এটা পড়ে আসো আমরা তোমাকে সাজিয়ে দেই।
বদরুন্নেসার কথায় সাইয়ারা সম্মত হতে পারলো না।
- কাকী আমি সাজবো না।
সাইয়ারার আপত্তি দেখে বদরুন্নেসা সাইয়ারার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো....
- আজকে তোমাকে দেখতে আসবে একটু সেজে যাবে না। একটু সাজলে তো ভালো দেখা যেত।
সাইয়ারা বদরুন্নেসার হাতটা মাথা থেকে সরিয়ে নিজের দুহাতে মধ্যে আবদ্ধ করে মুখে হাসি রেখে তার দিকে তাকিয়ে বললো....
- মুসলমান মেয়েদের সজ্জিত রুপে দেখার জন্য সার্টিফিকেট লাগে। সেই সার্টিফিকেট হলো সাক্ষি, কাবীননামা, দেনমোহর। যা তিনি এখনো অর্জন করতে পারেননি। তাই আমি আজকে সাজবো না।
বদরুন্নেসা মুচকি হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। একটু পরে সামীর এসে জানালো আগন্তুকগণ চলে এসেছে। সাইয়ারা ভালোভাবে নিজেকে ওরনা দিয়ে আবৃত্ত করে নিলো। বদরুন্নেসা সাইয়ারার হাতে চায়ের ট্রে ধরিয়ে দিলে জেবা তাকে নিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো। সাইয়ারার চোখে মুখে অনিচ্ছা। তবুও জেবার কথা ফেলতে পারলো না। আসলে সাইয়ারা তার পছন্দের কোনো মানুষের কথায় ফেলতে পারে না। তার অপছন্দের মানুষের তালিকা বড় হলেও পছন্দের মানুষের তালিকাও ছোট নয়। তার মধ্যে জেবা একজন। এসব ভাবতে ভাবতে তারা জাভেদের ঘরের সামনে এসে পড়লো। ঘরে ঢোকার সময় সাইয়ারা থেমে গেলো। জেবা ভেতরে যাওয়ার জন্য টানলে সে জেবাকেও আটকে দিলো। অনেকগুলো কন্ঠ ভেসে আসছে জাভেদের ঘর থেকে। সে বোঝার চেষ্টা করলো বাইরের কতজন আছে। পরিবারের পুরুষদের কন্ঠ আলাদা করে সে ৩-৪জন অপরিচিত পুরুষালি কন্ঠ শুনতে পেলো।
- আপু আমি যাবো না।
জেবা কিছু বলার আগেই মাজেদা মুনিহাকে নিয়ে এলো।
- সর সর সর। আঙ্গরে যাইবার দে।
মাজেদা এগিয়ে যেতে নিলে জেবা তার হাত ধরে আটকে দিলো। মুনিহাকে পরখ করে বললো....
- ছেড়াইরা তো সাইয়ারারে দেখবার আইছে। তুমার ছেড়িরে সাজাইয়া আনছোকে? হেরে গরো যাইবার কও কুনু অশান্তি কইরো না আম্মা। কতাডা আব্বার কানো গেলে বালা অইতো না।
মাজেদা জেবার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালো তারপর মুনিহাকে নিয়ে এগোতে গেলে আবার থেমে গেলো।
চলবে....
জানি ঠিকিই দেখা হবে (পর্ব-৬)
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
525
Views
8
Likes
0
Comments
5.0
Rating