সাইয়ারা ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না। মাথাটা কেমন করছে মনে হচ্ছে এখনি পড়ে যাবে। শরীরে তাপমাত্রাও অনেক। যদি উপায় থাকতো তাহলে সে স্কুলে যেতো না। কিন্তু বাড়িতে থাকার চেয়ে স্কুলে যাওয়াটায় ভালো। সাইয়ারা টেবিলটা গুছিয়ে রান্নাঘরে গেলো। এখন কাজগুলো সেরে রাখলে তাড়াতাড়ি স্কুলে চলে যেতে পারবে। সাইয়ারা সকালের নাস্তা তৈরি করে দুপুরের রান্নার জন্য সবজিগুলো হাতে নেবে তখন মায়ের আগমন ঘটলো।
- হুন ঢাকাত্তে তর বদরুন্নেসা চাচীরা আইতাছে।
সাইয়ারা বদরুন্নেসার কথা শুনে যতটা না আনন্দিত হলো তার চেয়ে বেশি বিরক্ত হলো বদরুন্নেসার মেয়ে নীলার কথা মনে পড়ে। সে মনে মনে বললো।
*দো*যাডাও তো আইবো।*
ফাজেলা কিছু বলতে যাবে তখন জামীরের আগমন। হাতে ব্যাগ ভর্তি বাজার। বাজারের ব্যাগটা রান্নাঘরে রেখে বললো....
- তর উসামা কাকারা আইতাছে। হেগর লাইগ্গা ভালা কইরা রানবি।
জামীর চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর স্টেশনে যেতে হবে উসামাদের আনতে। সাইয়ারা একটা বিরক্তির শ্বাস ছাড়লো। নীলা আসলে সাইয়ারার ঝামেলা আরো বেড়ে যায়। এটা খাবে না, ওখানে থাকবে না, আরো কত কি? সব তার ইচ্ছে মতো হতে হবে। কারোর বাসায় বেড়াতে গিয়ে অন্যের অসুবিধা করে যে কেউ নিজের সুবিধা খুজতে পারে তা নীলাকে না দেখলে কেউ বুঝতে পারতো না। মা বাজারগুলো বের করতে করতে বললো....
- নীলা মায়ে আঙ্গর খাওন খাইবার পায় না। হের লাইগ্গা অন্যকিছু রাইন্দা থইস।
সাইয়ারা বিরক্তিতে চোখ ঘোরালো।
- আমার স্কুলো যাওন লাগবো।
সাইয়ারা কথায় মা বেশ রেগে গেলেন।
- তর কয়েকদিন স্কুলো না গেলে কী অয়। এমন ভাব দেহাস যে স্কুলের এক নাম্বার ছাত্রী।
সাইয়ারা মুচকি হাসলো।
- সাইয়ারা, সাইয়ারা, কই তুই।
চেনা কন্ঠ শুনে সাইয়ারা উৎসুক হয়ে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রইলো। বোরকা পরিহিত কেউ একজন দেয়াল পেরিয়ে উঠানে প্রবেশ করলে সাইয়ারা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। জেবাকে দেখে ফাজেলা কয়েক কদম এগিয়ে গেলো। তারা সালাম বিনিময় করলো।
- কীরুম আছো?
- আলহামদুলিল্লাহ। আইন্নে?
- আলহামদুলিল্লাহ। তুমি একলাই আইছো। জামাই আইছে না।
- আইছে কাকার সাথে কতা কইতাছে।
জেবা সাইয়ারার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ তাকে পরখ করলো।
- কাকি সাইয়ারা শরীরডা মনো ভালা না।
ফাজেলা একবার সাইয়ারার দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে জেবার দিকে তাকালো।
- হের অসুখ তো ব্যাঙের সর্দি। এইতা কিছু অইতো না। এরতে বড় বড় অসুখ লাইয়াও আমরা কত কাম করছি।
ফাজেলার কথায় জেবা বেশ বিরক্ত হলেও প্রকাশ করলো না।
- আচ্ছা কাকি। কাকা তুমারে ডাকতাছে।
ফাজেলা চলে গেলে জেবা সাইয়ারার কাছে গেলো। দুজন সালাম বিনিময় করলো। সাইয়ারার মলিন মুখটা দেখে জেবা সাইয়ারার কপালে হাত দিলে চমকে উঠলো।
- এতো জ্বর উঠছে আর তুই রানতাছোস। ঘরে গিয়া বিশ্রাম নে।
- কী কও কত কাম রইছে? আর উসামা কাকারাও আইতাছে।
জেবা চোখে মুখে রাগি ভাব আনলো।
- থাপ্পর চিনস। যাইবার কইছি না।
সাইয়ারা অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ঘরে চলে গেলো। মেয়ের আসার খবর শুনে মাজেদা বাড়ির পেছনের দিকে এসে মেয়েকে রান্নাঘরে দেখে চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুললো। চিৎকার শুনে সাইয়ারা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। জামীর বাড়ি থেকে বেরোচ্ছিলো মাজেদার চিৎকার শুনে বাড়ির পেছনের দিকে এলো। পেছনে ফাজেলা, জালসান, আর জালসানের মেয়েরা। মাজেদা সাইয়ারাকে উদ্দেশ্যে করে বলতে থাকলো।
- ছেড়িডা শ্বশুড় বাড়িত্তে আইয়াও হারছে না। মহারানী ছেড়িডারে কামো বওয়াইয়া দিছে।
সাথে মা, দাদি আর ফুফুরাও অনেক কথা শোনালো। জেবা তাদের আটকাতে চাইলেও পারলো না। জামীর রাগে সাইয়ারার গালে চড় বসিয়ে দিলো। একেই জ্বর, ঠান্ডা আর মাথাটা ভার হয়ে থাকায় চড়টা সহ্য করে দাড়িয়ে থাকাটা তার জন্য সম্ভব হলো না। পড়ে যাওয়ার আগেই তাকে আগলে নিলো জেবা। জামীর কিছু বলার আগেই জেবা বলে উঠলো।
- দাড়াও কাকা। মা কইলো দেইখ্খা তুমি না জাইন্না না হুইন্না এত্তো বড়ো ছেড়িডারে মারলা তাও সবার সামনে। ছেড়িডার শোইলডা বালা না। জ্বর উঠছে হেইল্লেগ্গা আমি হেরে গরো পাডাইয়া আমি রানতাছি। আমার মায়ে তো কিছু জানবো না, বুঝবো না খালি চিলাইলেই ভাবে দুনিয়া উদ্ধার হইয়া যাইবো।
মাজেদা রেগে জেবাকেও কিছু কথা শোনালো তা জেবার কর্ণগোচর হলো না। ফাজেলা মাজেদাকে শান্ত করলো। সাইয়ারাকে ইঙ্গিত করে জেবাকে বললো....
- এইতা কুমিরের জ্বর। ইট্টু পরেই ঠিক অইয়া যাইবো।
জেবা একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ফাজেলার দিকে তাকিয়ে হাসলো। সেই দৃষ্টি পরিপূর্ণ ঘৃণায়। মুখের হাসিটা মলিন, অবজ্ঞাপূর্ণ।
- হুম কাকি। সাইয়ারার জ্বর সত্যিই কুমিরের জ্বর। কারণ কি জানেন?
ফাজেলা উৎসুক দৃষ্টিতে জেবার দিকে তাকিয়ে রইলো। জেবা কাকির দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে সাইয়ারার দিকে তাকিয়ে বলল....
- অহন কইতাম না। সময় আইলে আইন্নে নিজেই বুঝবাইন। আর আজকে আমি একটা কামে আইছি।
সবাই জেবার আসার কারণ জানার জন্য তার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। জেবা সাইয়ারাকে জলচৌকিতে বসিয়ে জামীরের দিকে তাকিয়ে বললো....
- কাকা আমার শ্বশুর বাড়ির এলাকাত একটা ছেড়া থাহে ছেড়াডা অনেক বালা আর সরকারি চাকরি করে। হেরা পাত্রী খুজতাছিলো আমি সাইয়ারার কতা কইছি হেগরে। আজকে হেরা বিহালে সাইয়ারারে দেখবার আইবো।
জামীরের জেবার প্রস্তাবটা মোটেও ভালো লাগেনি। সে এখনি মেয়ের বিয়ে দিতে চায় না। তবে ছেলে সরকারি চাকরি করে শুনে মাজেদার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
সাইয়ারা ভার মাথা নিয়েই কোনোমতো উঠে দাড়িয়ে বললো....
- আপু আমি পড়বার চাই।
জেবা সাইয়ারার কাধে হাত রেখে বললো....
- হেরা তোরে বিয়ার পড়েও পরবার দিবো।
মাজেদা মনে মনে বললো।
*সাইয়ারারে ছেড়াইনগর পছন্দ অইতো না। এর চেয়ে বালা আমি মুনিহারে হেগরে দেহাইয়ামনে। হেরে দেখলেই হেগর পছন্দ অইয়া যাইবো।*
ভাবতে ভাবতে মাজেদা চলে গেলো। জামীর বলে উঠলো।
- আমি অহনি ছেড়ি বিয়া দিতাম না।
জেবা জামীরের দিকে তাকালো।
- হেরে দেখবার আইতাছে দেইখ্খাতো আর অহনই বিয়া অইয়া যাইতাছে না। আইয়া দেহুক পছন্দ অয় নাকি।
বোধহয় ঔদিকে উসামারা চলে এসেছে। জামীরের দেড়ি হয়ে যাচ্ছে তাই সে আর কথা বাড়ালো না। চলে গেলো। সাইয়ারাকে ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে জেবা রান্না করা শুরু করলো। তার সাথে হাত লাগালো ফাজেলাও।
মাজেদা ঘরে এসে মেয়ের কাপড় বের করে করে দেখতে লাগলো। যেটাই হাতে নিচ্ছে নাক কুচকে রেখে দিচ্ছে। মায়ের এমন কর্মের কারণ না বুঝতে পেরে মুনিহা জিঙ্গাসা করলো।
- কি অইছে আমার কাপর-চুপর বাইর করতাছো কে?
মেয়ের একটা পোষাকও তার পছন্দ হলো না।
- তুই বো আমি আইয়া কইতাছি।
কিছুক্ষণ পর মাজেদা ফিরে এলো। হাতে একটা কাতান শাড়ি।
- হুন আজকে এইডা ফিইন্দা সুন্দর কইরা সাজবি। আজকে তোরে দেখবার আইবো।
বিয়ের কথা শুনে মুনিহা গাল ফুলিয়ে বললো....
- হ্যান্ডসাম ছেড়া না অইলে আমি বিয়া করতাম না।
মেয়ের কথায় মাজেদা বিরক্ত হয়ে বললো....
- আইচ্ছা। আগে আয়ুক দেহি। পড়ে চিন্তা করবাম নে।
জেবা রান্না শেষ করে সাইয়ারার ঘরে গেলো। সাইয়ারা ঘুমিয়ে আছে। জেবা সাইয়ারার কপালে হাত রেখে তাপমাত্রা দেখলো। মগ দিয়ে পানি এনে সাইয়ারার রুমালটা ভিজিয়ে জলপট্টি দিলো। কপালে ঠান্ডা কিছু অনুভব হতেই চোখ খুলে জেবাকে জলপট্টি দিতে দেখে উঠে বসতে চাইলে জেবার চোখ রাঙানো দেখে থেমে গেলো। কিছুক্ষণ জলপট্টি দেওয়ার পর সাইয়ারার শরীরের তাপমাত্রা কিছুটা কমলো।
- ইম। কী গন্ধ। আংকেল আমি এখান দিয়ে যাবো না। ওয়াক থু।
সাইয়ারাদের বাড়ির কয়েক বাড়ি আগে রহমান নামের এক লোকের বাসা। তারা গরু পালেন। প্রতিদিন এই রাস্তা দিয়েই গরুকে নিয়ে যান আন্দাল দিঘীতে গোছল করাতে। মাঝে মাঝেই গরুর বিষ্ঠা পরে থাকে রাস্তায়।
- ইট্টু কষ্ট কইরা আইয়া পড়ো মা। পুকুর পাড় দিয়া গেলে অনেকটা আডুন লাগবো। তুমার কষ্ট অইবো।
নীলা নাক টিপে ধরে বাড়িতে প্রবেশ করলো। সরু রাস্তা দিয়ে আসতে আসতে নীলা বললো....
- ওয়াও কী সুন্দর ফুলগুলো। আংকেল আগেরবার যখন এসেছিলাম তখন তো এতোগুলো গাছ ছিলো না।
- এইতা সাইয়ারায় লাগায়। হেয়ি দেখে।
নীলা আর কিছু না বলে হাটতে শুরু করলো। বেশ কয়েক কদম এগিয়ে ডান দিকের ছোট উঠানে প্রবেশের সময় বদরুন্নেসা উসামাকে একটু আসছে বলে সরু রাস্তাটা ধরে সামনে এগিয়ে গেলো। বড় উঠানে এসে কাউকে দেখতে না পেয়ে ভাবলো হয়তো সাইয়ারা স্কুলে গেছে। সে ফিরে যাচ্ছিলো কি ভেবে যেন সাইয়ারার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। ঘরের সামনে দাড়িয়ে সাইয়ারাকে ডাক দেওয়ার আগেই জেবা বেরিয়ে এলো। দুজন সালাম বিনিময় করে বদরুন্নেসাকে ঘরে আসতে বললো জেবা।
চলবে....
জানি ঠিকিই দেখা হবে (পর্ব ৫)
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
510
Views
11
Likes
0
Comments
4.3
Rating