সাইয়ারা কিছু বললো না। চুপচাপ দাড়িয়ে রইলো। পাশ থেকে জালসান বলে উঠলো।
- তর ছেড়ি বড় লায়েক অইয়া গেছে। আমারে মানে তো নায়ি উল্ডা মুহে মুহে তর্ক করে।
মায়ের কথায় রাগ বেড়ে যায় জামীরের। সাইয়ারা আড় চোখে তাকিয়ে রয়েছে জালসানের দিকে।
- কী কইছোস তোর দাদিরে রে।
সাইয়ারা কিছু না বললে ধমক দেয় জামীর।
- দাদু আমারে কইছিলো মা আমারে কিছু শিহাইনাই। এইল্লেগ্গা আমি কইছি ছুডু থেইক্কাতো দাদির কাছেই ছিলাম হেরা শিহাইলো না কে?
জামীর যখন সাইয়ারাকে মারতেই যাবে তখন বড় ভাইয়ের ছেলে জাভেদ তাকে আটকে দিলো। ফাজেলা চেচাতে লাগলো।
- কী জাতের মানুষরে তুই। পুলাপানরে বাপে মারবার গেলে পুলাপান দৌড়াইয়া পলায়। আর তুই গাড়তেড়ামি কইরা বাপের সামনে দাড়াইয়া রইছোস।
জাভেদ মনে মনে বললো।
*হেইল্লেগ্গা পুলাপানরে আদরও দিওন লাগে। সবাই মিইল্লা সবসময় একজনরে চাপের উপরে রাখলে, ইট্টু কিছু অইলেই কথা হুনাইলে হের মধ্যে আর কেউয়ের লাইগ্গা, কুনু কিছুর লাইগ্গা ডর থাহে না।*
জামীর জাভেদের হাত থেকে ছোটবার চষ্টা করছে। জাভেদ শান্ত গলায় সাইয়ারাকে ঘরে যেতে বললো। সাইয়ারা চলে যাওয়ার পরে সে তার কাকাকে শান্ত করার চেষ্ট করলো। বেশ অনেক্ষণপর জামীর শান্ত হলো। সবাই ঘরে চলে গেলো। জাভেদ অনার্স ৪র্থ বর্ষের ছাত্র। তাদের মফস্বল শহরে ভালো বিশ্ববিদ্যালয় না থাকায় ঢাকা গিয়ে পড়াশোনা করছে। যখনই শুনেছে মুনিহাদের রেজাল্ট দিয়েছে তখনই বাসায় আসার জন্য রওনা দিয়ে দিয়েছে। সে জানে তার পরিবারের লোকগুলো কেমন। বিশেষ করে মা, দাদি, ফুফু। জওয়াদ থাকলে এমন কিছু হয়না। তাকে বাড়ির সবাই ভয় পায়। জামীর বড় ভাইয়ের সামনে কিছু বলতে পারে না। মাজেদাও স্বামীর সামনে কিছু বলার সাহস পায় না। যতদিন জাওয়াদ বাড়িতে থাকে ততদিন সাইয়ারার দিনগুলো কিছুটা ভালো যায়। কেউ তাকে কথা শোনাতে পারে না। জওয়াদ প্রতিবাদ করে। মাজেদা আর মুনিয়াও খোচা দিয়ে দিয়ে কথা বলতে পারে না। জাভেদ বাড়ির বড় ছেলে সবার আদরের। বড় ছেলে হওয়ায় বেশ কদরও আছে বাড়িতে। তাই সেও বাড়ির পরিস্থিতি কিছুটা সামলাতে পারে।
রাত অনেকটা হয়েছে। সাইয়ারা হাতের কাজগুলো শেষ করছে। এমন সময় খাবার ঘর থেকে মায়ের ডাক ভেসে আসছে। সাইয়ারা রান্নাঘরে গেলে ফাজেলা বললো....
- কই থাহস তুই। তোর জেডিরে, ফুফুরে খাওন বাইরা দে।
মায়ের কথায় সাইয়ারা বেশ বিরক্ত হলেও মুখে প্রকাশ করলো না। মনে মনে বললো....
*এইডার লাইগ্গাও আমারে ডাহুন লাগে।*
সাইয়ারা মনের মধ্যে বেশ বিরক্তি নিয়েই খাবার বাড়লো। ফুফু, জেডি, মা আর বাকী বোনদের খাওয়া শেষে থালা-বাসন সরিয়ে নিজে খেয়ে নিলো। সবকিছু গুছিয়ে যখন ঘরে প্রবেশ করলে তার ভাই সামীরকে ঘরে পেলো এসাইমেন্টের প্রশ্নগুলো দেখছে। সাইয়ারাকে দেখে সামীর জিঙ্গাসা করলো....
- আপু তুমার সাহায্য লাগবো।
সাইয়ারা বুঝলো এখন না করলে সামীর তাকে জ্বালিয়ে তার সময় নষ্ট করবে। তাই সে বললো...
- হ।
সাইয়ারার মুখ থেকে হ্যাঁ উত্তর শুনে। সামীর যেন অমাবস্যার চাঁদ দেখতে পেয়েছে। সাধারণত সাইয়ারা সামীরকে তার কাজের ধারে কাছে আসতে দেয় না। এর দুটো কারণ অন্যের কাজ একটু সমস্যা হলে কথা শুনতে হবে। আর অন্যকারণ হলো বাড়ির মানুষের কাছ থেকে কথা শুনতে হয়। কিন্তু আজকে সাইয়ারার তাকে দরকার অ্যাসাইনমেন্টে যে প্রশ্নগুলো দেয়া হয়েছে সেগুলো সে খুজে পাচ্ছে না। যদি সামীর খুজতে সাহায্যে করে তাহলে সে অ্যাসাইনমেন্টগুলো শেষ করতে পারে।
- কী কইরা দিয়াম কও।
সাইয়ারা প্রশ্নগুলো সমীরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো....
- এইডি খুইজ্জা দে।
- সবগুলা প্রশ্ন আমি দেখছি। নেট থেইক্কা বাইর করতে অইবো। দাড়াও জাভেদ বাইয়ের কাছতে হের মুবাইলডা লইয়া আয়ি।
সামীর ফোন আনার জন্য চলে যাচ্ছে। পেছন থেকে সাইয়ারা তাকে অনেকবার ডেকে না করেছে সে শোনেনি।
জাভেদ সামীরের ঘরে এসে তাকে না পেয়ে কয়েকবার ডাকলো। কোনো সারা শব্দ না পেয়ে নিজের ঘরে ফিরে যাচ্ছিলো। তখন সামীরকে বাড়ির পেছনের দিক থেকে আসতে দেখলো। সামীর তার কাছে এসে সাইয়ারার অ্যাসাইনমেন্টের কথা বলে মোবাইলটা চাইলে সে সামীরকে তার ঘরে নিয়ে গিয়ে একটা ব্যাগ ধরিয়ে দিলো। সামীর ব্যাগ খুলে একটা স্মার্ট হেন্ডসেট পেলো।
- মুবাইল কার লাইগ্গা বাই।
- সাইয়ারারে দিবি। আব্বু পাডাইছে হের লাইগ্গা।
জাভেদ ফোনটা নিজেই দিতো কিন্তু সাইয়ারা তার চাচাত্তো ভাইদের সামনে আসতে চায় না খুব বেশি প্রয়োজন না হলে। জাভেদের সাইয়ারাকে কিছু জানানোর থাকলে সামীরকে বলে দেয় সামীর সাইয়ারাকে জানিয়ে দেয়। সামীর খুব খুশি হলো। জাভেদ বাক্স থেকে মোবাইল বের করে তার বিকাশ থেকে লোড করে এমবি কিনে দিয়ে মোবাইলটা পুনরায় বাক্সে রাখলো। সামীর চলে যাবে তখন জাভেদ তাকে দাড় করালো।
- হুন সাইয়ারারে কইবি মুবাইল মিউড কইরা রাখতে আর স্কুলো গেলেগা মুবাইল বন্দ কইরা লুকাইয়া রাইখ্খা যাইতো। অন্তত আব্বু না আওয়া পর্যন্ত নাইলে আবার বাড়িত এইডা লইয়াও ঝামেলা অইবো। আব্বা কল দিবো। অহন যা দিয়া আ গা।
সামীর বেরিয়ে গেলো।
সাইয়ারা কাজে মন বসাতে পারছে না। সামীরকে না বলার পরেও সে গেলো। সে অনুমান করছে জাভেদ ঘুমিয়ে পরেছে আর সামীর তার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিয়েছে। সামীরকে একটু শাসন করা প্রয়োজন। ইদারনিং সে সাইয়ারার কথা শুনতে চাই না। তাই সামীর ঠিক করলো সামীর আসলে তাকে বকবে। সামীরের কথা চিন্তা করতেই সে এসে উপস্থিত।
- তরে না করছিলাম না। বাইয়ের ঘুমডা ভাঙ্গাইয়া দিলি।
- ঘুমাইলে তো ঘুম ভাঙ্গায়াম। আর এতো রাইতও অইছে না যে বাই ঘুমাইবো। মাত্র পনে ১০টা বাজে।
সাইয়ারা হাতের কলম রেখে দিয়ে সামীরের দিকে ঘুরে বসলো।
- না ঘুমাক। কত্তডা রাস্তা আইছে ক্লান্ত অইয়া গেছে না।
সামীর হাতের ব্যগটা সাইয়ারার হাতে দিলো। সাইয়ারা হ্যান্ড সেটটা দেখে বেশ অবাক হলো।
- বাই দিছে। জেডা তুমার লাইগ্গা পাডাইছে।
- মিছা কতা কছকে।
সাইয়ারা কথায় সামীরের একটু অভিমান হলো।
- তুমার সন্দেহ থাকলে বাইরে গিয়া জিঙ্গাসা করগা।
সাইয়ারা কিছু বলতে যাবে তখন ফোনে একটা কল আসলো। অপরিচিত নাম্বার দেখে সাইয়ারা কলটা ধরবে কি ধরবে না চিন্তা করতে করতে কলটা কেটে গেলো। মিনিট খানেক পর আবার কল আসলো। সাইয়ারা ফোনটা তার ভাইয়ের হাতে ধরিয়ে দিলো। সামীর কলটা ধরে স্পিকারে দিলো। অপরপাশ থেকে পুরুষালি কন্ঠ সালাম দিয়ে সাইয়ারার নাম ধরে ডাক দিলো।
- সাইয়ারা।
কন্ঠটা সাইয়ারার খুব পরিচিত। সে অশ্রু মিশ্রিত কন্ঠে সালামের জবাব দিয়ে পুনরায় সালাম দিয়ে বললো....
- আব্বু।
সাইয়ারা আগে জওয়াদকে বড় আব্বু বলে ডাকতো আর আব্বু ডাকতো তার বাবাকে। মাঝে মাঝে ডাকও অবহেলার মাধ্যমে প্রভাবিত হয়। ডাকের পরিবর্তটাও বুঝিয়ে দেয় যে মানুষটাকে ডাকা হচ্ছে সে মানুষটা কতটা দূরে চলে গেছে। কিন্তু সেই মানুষটা তা টের পায় না। ভাবে ডাকের পরিবর্তন স্বাভাবিক একটা বিষয়। কিন্তু স্বাভাবিকতার মধ্যে লুকিয়ে থাকে অস্বভাবিকতা। সাইয়ারা একটা দীর্ঘশ্বাস নিলো। জওয়াদ সালামের উত্তর দিয়ে বললো....
- কেমন আছিস মা।
- আলহামদুল্লিাহ ভালো। তুমি কেমন আছো।
- আলহামদুল্লিাহ আমিও ভালো আছি। আচ্ছা শোন হয়তো ইতিমধ্যে সামীরের কাছ থেকে সব শুনেছিস। তবুও আমি আবারও বলছি ফোনের কথাটা এখনই বাড়িতে জানানোর দরকার নেই। তুই ঝামেলা সামলাতে পারবি না। আমি এসে সবাইকে জানাবো।
সাইয়ারা জবাবে “হুম” বললো।
- আচ্ছা শোন। তোর হাতে কতগুলো কাজ আছে।
- কিছু আছে।
- কিছু কাজ পাঠালে করে দিতে পারবি।
সাইয়ারা উত্তর দিলো “হুম”।
- তোর কথা আমার এক সহকারীকে বলেছিলাম তার মেয়ের প্রাকটিক্যাল করে দিতে হয়। সাথে তার মেয়ের কিছু বান্ধবীর খাতাও করে দিতে হবে। পারবি তো।
- হ্যাঁ পারবো। তুমি পাঠিয়ে দিও।
- আচ্ছা আমি পাঠিয়ে দিতে বলছি। জাভেদ তোর কাছে পৌঁছে দেবে।
তারা পুনরায় সালাম বিনিময় করে কল কেটে দিলো।
- কী কইছিলাম। তুমি হুদাহুদি আমারে মিথ্যুক ভাবছো।
সাইয়ারা ভাইয়ের মাথায় আস্তে একটা গাট্টা মারলো।
- আমি অ্যাসাইমেন্টের প্রশ্ন খুইজ্জা দিতাছি তুমি বাকীগুলা করতে থাকো।
সাইয়ারা মুচকি হেসে মাথা নেড়ে সায় দিলো। তারপর পুনরায় তার কাজে মন দিলো। সামীর প্রশ্নগুলো খুজে বের করে সাইয়ারাকে দেখিয়ে দিয়ে চলে গেলো।
ফজরের আজানের আগে সাইয়ারার ঘুম ভেঙে গেলো। সে নিজেকে গুছিয়ে আজান পড়লে জরুরি কাজ সেরে নিলো। পুকুর পাড়ে একটু হাটা হাটি করে আবার কাজ শুরু করলো।
চলবে....
জানি ঠিকই দেখা হবে (পর্ব ৪)
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
552
Views
12
Likes
2
Comments
4.8
Rating