চোখে-মুখে পানির ছিটা পড়ায় মুখ কুচকে তাকিয়ে খালাত্তো বোন নায়লাকে দেখে মুচকি হেসে পাশের বালিশটা ছুড়ে মেরে উঠে বসলো সাইয়ারা। নায়লা বালিশটা তুলে রেখে বলল....
- সুহৃদ সিন্ডারেলা আর কত ঘুমান আপনি। এইবার তো ওয়াজ শুরু হবে।
নায়লা আর সাইয়ারা স্বমস্বরে হেসে উঠলো। সাইয়ারার আর নায়লা সমবয়সী। পড়েও একই শ্রেণিতে। বেশিরভাগ ছুটিগুলো নায়লা সাইয়ারার সাথেই কাটায়। এবারও গ্রীষ্মের ছুটিটা সাইয়ারার সাথে কাটাতেই এসেছে। বড় জেঠির মাজেদার কন্ঠে হাসি থামিয়ে দিলো তারা।
- যা ওয়াজ শুরু।
সাইয়ারা মুচকি হেসে নায়লাকে “শ*য়*তা*ন” সম্মোধন করে নিজেকে গুছিয়ে বেরিয়ে যায়। রান্নাঘরের পাশের ঘরটা খাওয়ার ঘর এর পরের ছোট ঘরটা সাইয়ারার। তাই তার আসতে দেরি হলো না। রান্নাঘরে যাওয়ার সময় মা আর জেঠি উঠানে বসে সবজি কাটতে দেখে সে। সাইয়ারাকে দেখেই জেঠির গলার জোড় আরো বেড়ে গেলো।
- আইছে মহারানী। উঠলি কে আরো ঘুমাইতি।
জেঠির সাথে যোগ দিলো সাইয়ারা মা ফাজেলা।
- এইসুম তোর বাপ, ভাইয়েরা যে বাইরোয়াজা তোর খবর নাই। অহন কী খাইয়া যায়বো হেরা।
- কি যে কছ না ফাজেলা। হেরা খাইলো কি না খাইলো তে হের কি অইছে। তোর ছেড়ির কি হের বাপের প্রতি কুনু টান আছে যে ভাইগোর প্রতি থাকবো।
কথাগুলো সাইয়ারার বুকে সূচের মতো বিধলেও এখন আর অশ্রুশিক্ত হয়না চোখ। সে মনে মনে বললো....
* আহারে আইছে টানের বানি হুনাইবার। কুনুদিন তো ছেড়াইনগোর লাইগ্গা টান দেহাইবার দেখলাম। আবার আইছে টান নাই লইয়া।*
এই মহিলা সবসময়ই এইভাবে খুচিয়ে খুচিয়ে কথা বলে তাই সাইয়ারার ইচ্ছে করে না এই মহিলার সাথে কথা বলতে। প্রয়োজন ছাড়া কথাও বলে না।
থমথমে মুখ নিয়ে মাকে বললো....
- ওডো। আমি করতাছি। বাবা যাওনের আগেই অইয়া যাইবো।
মা জেঠি চলে যেতেই বাম হাত দিয়ে গলার বাম পাশটা কয়েক সেকেন্টের হালকা চেপে ধরে কয়েকবার শ্বাস নিয়ে রান্নায় মন দিলো সাইয়ারা। সামনে ও কিছুটা ডানে-বামে বাশের কঞ্চি দিয়ে তৈরি দেয়াল, পেছনে রান্নার সামগ্রী রাখার ঘরের দরজা, দুইদিকে দুইটা বাশের কঞ্চি দিয়ে বানানো দরজা, মাঝখানে গ্যাসের চুলা পাশে রান্নার করার সময় মসলা, কাটা সবজি রাখার জন্য দুই পাশে ইট দিয়ে বসানো তক্তা এটাই রান্নাঘর। বাড়ির লোকদের এদিকে দেখা গেলেও রান্নাঘরে কাজ করতে তেমন একটা দেখা যায় না। এইদিকটাকে সাইয়ারার এলাকাই বলা চলে। বাড়ির রান্নাঘরটা, বাড়ির পেছনের দিকটা আর তার শোয়ার ঘরটা সাইয়ারার নিজের বলতে এইটুকুই। আর এটুকু নিয়েই আনন্দিত সে। খানিক বাদে নায়লা এলে তাকে দেখে সাইয়ারা বললো....
- মাঝে মাঝে তোকে দেখে হিংসা হয়।
নায়লা একটা জলচৌকি নিয়ে রান্নাঘরের কাছে উঠানে বসতে বসতে বলল “কেন”।
- খাম্মু তোর মা বলে।
সাইয়ারা ঢাকনা তুলে তরকারি নাড়া দিতে দিতে বললো....
- মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হয় জানিস। খাম্মু কেন আমার আম্মু হলো না।
সাইয়ারা চোখ অশ্রুশিক্ত হলো। নায়লা রান্নাঘরে প্রবেশ করে সাইয়ারার কাধে হাত রাখলো। সাইয়ারা পুনরায় গলার বাম পাশটা হালকা চেপে ধরলো।
- অনেকবার দেখেছি তোকে এমন করতে। এটা কি করিস?
- আমার কষ্ট লাগলে এমন করলে কষ্ট কমে যায়।
সাইয়ারার কথায় নায়লা কপাল কুচকে বললো....
- সত্যি। আমি যদি এমন করি আমারও কষ্ট কমবে।
সাইয়ারা নায়লার দিকে তাকিয়ে আবার সামনে তাকালো।
- আমার তো কমে। তোরটা আমি কিভাবে বলবো।
নায়লা চুলে হাত খোপা করতে করতে বললো....
- আচ্ছা আমি করে দেখবো হয় কি না।
ফাজেলা রান্না কতদূর এগিয়েছে দেখতে এসে নায়লাকে দেখে অনেক খুশি হন। নায়লা খালার সাথে সালাম ও কুশল বিনিময় করে।
- কহন আইছো মা।
নায়লা কিছু বলার আগেই সাইয়ারা বলে....
- কাইকা রাইতে আইছে। নাইলে এতা সহালে এইনো আইতো।
ফাজেলা মেয়ের কথায় কিছুটা বিরক্তবোধ করলেও কিছু বললেন না।
- আফা বাড়ির সবাই কিরুম আছে। তুমারে তো আইতে দেখলাম না। কইদ্দে আইছো?
সাইয়ারা এটারও উত্তর দিতে গিয়েও দিলো না। একটা পাত্র নিয়ে খাবার ঘরে চলে গেলো।
- আলহামদুল্লিাহ সবাই ভালো আছে। আমি পুকুর পাড় দিয়ে এসেছি।
- হেইন্দে আইছো কে গেইট দিয়াইতো আইবার পারতা। নাকি খালামনির সাথে দেহা করবার চাও নাই।
ফাজেলার নায়লার মনের কথা বুঝে যাওয়াতে সে কিছুটা বিব্রত হয়ে “চমকে দিতে চেয়েছিলো” বলে কাটিয়ে দিলো। ফাজেলা কিছু বলতে যাবে তার আগে সাইয়ারা বলে উঠলো।
- মা নাস্তা বানানি অইয়া গেছে। তুমি বাবারে বাইরা দেও। আমি রাইখ্খা আইছি।
ফাজেলা খাবার বাড়তে চলে গেলে নায়লা হাফ ছেড়ে বাঁচলো। সাইয়ারার হাতে নুডুলসের বাটি দেখে নায়লা বললো....
- আবার আমার জন্য কষ্ট করে নুডুলস বানাতে গেলি কেন?
নায়লার হাতে নুডুলসের বাটিটা ধরিয়ে দিয়ে বললো....
- সাইয়ারাকে কেউ কোনো কাজে বাধ্য করলে সে হয়তো সেটা করে দেয় কিন্তু সেই কাজে সাইয়ারার মন থাকে না, কষ্ট না হলেও বিরক্তি মিশে থাকে। এরকারণেই কাজে ভুল হয়। যেই কাজ আমি নিজে করি সেটা ভালোবেসেই করি। আর যাদেরকে আমি ভালোবাসি তাদের জন্য কিছু করলে ভালোবেসেই করি এতে আমার কষ্ট হয় না। বরং শান্তি লাগে।
নায়লা মুচকি হাসলো। জলচৌকিতে বসে এক চামচ নুডুলস মুখে দিয়ে সাইয়ারাকে বললো....
- তুই এতো কিছু সহ্য করিস কিভাবে। তোর বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছা করে না।
সাইয়ারা জোরে শ্বাস ছেড়ে হুম উচ্চারণ করলো।
- করে তো। কিন্তু যখন তোর সিন্ডারেলা ডাকটা মনে পড়ে তখন আর করে না। তখন মনে হয় এইতো আর কয়েকদিন ডিজনি সিন্ডারেলার মতো একদিন আমাকেও একটা রাজকুমার নিয়ে চলে যাবে।
হাতের আঙুল দিয়ে হাটার মতো ইশারা করে কথাটা বলেই হেসে দিলো সাইয়ারা। সাইয়ারার কথায় নায়লার চোখ অশ্রুশিক্ত হলো মনে মনে বললো....
* সত্যি তুই মানুষ না। একটা জীবন্ত পাথর যা মাটির চামড়ায় আবৃত্ত। ইন শা আল্লাহ একদিন এই সিন্ডারেলার জন্যও একদিন সত্যি রাজকুমার আসবে। নিয়ে যাবে এই যন্ত্রনাপুরী থেকে। অনেক অনেক দূরে।
সাইয়ারা নায়লার সাথে কথা বলতে বলতে রান্না শেষ করলো। তখন মাজেদার আগমন ঘটলো। নায়লাকে দেখে যে খুশি হয়নি তা চোখে মুখে স্পষ্ট। সে নায়লাকে উপেক্ষা করে সাইয়ারাকে বললো....
- ওই ছেড়ি মুনিহার গলা বেদনা করতাছে একটু পানি গরম কইরা দে তো।
সাইয়ারা রান্নাঘর পরিষ্কার করছিলো কথাটা শুনে বিরক্তিতে চোখ উল্টিয়ে মনে মনে বললো....
*সামান্য পানিডাও গরম কইরা নিবার পারে না।*
সাইয়ারা হাত ধুতে ধুতে বললো....
- রান্দা শেষ চুলা নিবাইআলছি।
মাজেদা বিরক্তি নিয়ে বললো....
- নিবাইআলছোস দেইখ্খা আর জালানি যায় না। নাকি ইট্টু গরম পানি কইরা দিলে তোর আত পইচ্চা যা।
মাজেদা চলে গেলো। মাজেদার এসব কথা শুনে নায়লা মুখে রাগ ফুটে উঠলো মনে মনে বললো....
*নিজের মেয়েকে পটের বিবি বানিয়ে রেখে অন্যের মেয়েকে দিয়ে কাজ করাতে আসে। এই স্যাতস্যাতে রান্নাঘরে রান্না করা যায়। ফালতু মহিলা।*
সাইয়ারা গরম পানি বসিয়ে ময়লার কাগজে কিছু খুজতে লাগলো। ফেলে দেওয়া খারাপ সবজিগুলো থেকে কয়েকটা বেগুনের বীচ বের করে ছাকনির মাধ্যমে পানিতে কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রেখে ছাকনি তুলে ফেললো। সাইয়ারার কান্ড দেখে নায়লা মুচকি মুচকি হাসছে।
- তুই ঘরে যা আমি এগুলো ঘরে রেখে আসি।
সাইয়ারা রান্না করা খাবারগুলো রেখে ময়লাগুলো ফেলে দিয়ে এলো। মাজেদা দেখতে আসলো পানি বসিয়েছে কিনা। পানি বলকাতে থাকলে গ্লাসে পানি ঢেলে লবণ দিয়ে তার হাতে দিয়ে দিলো।
- তুই পারিসও বটে।
- কিছু পারছি না। শুধু মনে করাচ্ছি রুপ সবসময় এক রকম থাকে না। তাই রুপ নিয়ে অহংকার করার কিছু নেই।
এই বাড়ির কোনো কিছুই নায়লার অজানা নয়। অনেক কিছু সে নিজে প্রত্যক্ষও করেছে। তাই সাইয়ারার কথার মানে ভালো মতোই বুঝলো সে। আসল কথা হলো সাইয়ারার জেঠাত্তো বোন মুনিহা সবসময় মেকাপ করে থাকায় তাকে অনেক ফর্সা দেখা যায়। তাই তার রুপের খুব অহংকার। মাঝে মাঝে সাইয়ারাকে সামনে ভাব নেয়। এমনকি নায়লার সামনেও এমন করেছে সে। যখনই এমন হয় তখনই সাইয়ারা তার খাবারে কোনো না কোনো ভাবে বেগুন মিশিয়ে দেয়। এমন ভাবে মেশায় যাতে কেউ বুঝতে না পারে। বেগুনে এলার্জি থাকার কারণে মুনিহার মুখসহ হাত-পায়ে র্যা শ বের হয়। এর ফলে সাময়িকের জন্য তার ভাব-ভঙ্গি বন্ধ থাকে।
সাইয়ারার কাজ শেষ করতে করতে প্রায় সাড়ে ১০টা বাজে, ১১টায় স্কুল। সাইয়ারা স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে বেরোবে তখন আবার মাজেদার আগমন হুকুম তার মেয়ের র্যা শ বেরিয়েছে তাই হলুদ বেটে দিতে হবে। সাইয়ারার স্কুলের সময় হয়ে গেছে তাই জেঠির কথা না শুনে জেঠির সামনেই দিয়ে বেরিয়ে যায় সে। গেইট দিয়ে বেরোতে বেরোতে জেঠির চিৎকার শুনতে পেলো। সাইয়ারাকে কথা শোনাতে শোনাতে বাড়ি মাথায় তুলছে। সাইয়ারা মুখে একটা বিজয়ী হাসি নিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিকাল সাড়ে ৫টা। এর মধ্যে বাড়িতে ভূমিকম্প হয়ে গেলেও তার কিছু যায় আসে না।
চলবে....
জানি ঠিকই দেখা হবে
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
1.58K
Views
30
Likes
1
Comments
4.4
Rating