অভাগীর ভাগ্য (পর্ব ২)

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
কারণ ওনি তো বলল কাল আসবেন আবার। যদি আসেন, তাহলে তো হলো। দেখা হয়ে যাবে মায়ের সাথে তখন।

গহনা দেখার ভান করে যে আবির এতক্ষণ ধরে তার মায়ের খোঁজ নিতে আসল সেটা দোকানদার বুঝতেই পারল না। এদিকে গহনা দেখার ভান করে মায়ের ব্যাপারে কিছুটা হলেও তো জানতে পারল। সেসব জেনে একটা সুরাহা করতে পেরে খুশি হয়ে গেল আবির আর ভাবতে লাগল,

- "মায়ের কি হয়েছে? মায়ের তো এখন গ্রামে থাকার কথা। সাথে বড় ভাই আর তার পরিবারও থাকবে। কিন্তু মা এখানে কেন এসেছে? এখানে এই অবস্থায় মায়ের আগমন কেন? এভাবে নোংরা,,  ময়লা, ফাঁটা ছিটে, জীর্ণ-শীর্ণ আর খারাপ কাপড় জড়িয়ে মা গহনা বিক্রি করতে এসেছে এখানে কেন? কার গহনা এগুলো? কিসের টাকা দরকার মায়ের? এই অচেনা শহরে মা কার গহনা বিক্রি করতে এসেছে? আর কেনই বা এসেছে?"

এসব ভাবতে ভাবতে দোকানদারের কথায় আবির তার সামনে মেলে দেওয়া গহনাগুলো হালকা নেড়ে-ছেড়ে দেখল, আর এমন ভাব করল যে, গহনা তার পছন্দ হয় নি। তাই জুয়েলার্সের দোকানদারকে পরে আসবে বলে সে দোকান থেকে বেরিয়ে আসল। বাইরে এসে সোজা রিকশায় গিয়ে উঠল আর বাড়ির পথ ধরল। মাথায় আকাশ সমান ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে আবিরের! অনেকগুলো প্রশ্ন মাথায় কিলবিল করছে। সবগুলো প্রশ্নের একটাই উত্তর মা এখানে কেন এসেছে?

মাকে এভাবে দেখলাম কেন?

মায়ের এ অবস্থা কেন?

মা, ভাই-ভাবি ভালো থাকার জন্য তো আমি আবিরের আজ এই অবস্থা। কতো বছর মা ডাকতে পারি নি। মাকে চোখের দেখা দেখতে পারি নি। নিজের জন্মদাতা মাকে দেখতে না পারার কষ্ট আর মা বলে ডাকতে না পারার কষ্ট শুধু তারাই বুঝে, যারা নিজের বাবা মা থাকা স্বত্বেও নানা রকম সমস্যার কারণে মায়ের থেকে, বাবার থেকে অনেক অনেক দূরে আছে। আর যদি কোনো সমস্যার কারণে চিরদিনের জন্য মায়ের সাথে দেখা করা, কথা বলার অধিকারটা হারিয়ে ফেলে তাহলে তার থেকে পোড়া কপালের মানুষ আর কেউ হতে পারে না। আবিরের অবস্থা আজ সেই পোড়া কপালের লোকের মতো হয়ে গেছে। আজ মায়ের চেহারাটা দেখে মনে হলো সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গেছে। মা কি তবে সুখী নেই? ভাইয়া-ভাবি কোথায়? মাকে তো তাদের সাথে থাকার কথা। কিন্তু মা একলা এখানে কেন? কী হয়েছে মায়ের?

- "স্যার আপনার বাসার সামনে এসে পড়েছি। এইবার নেমে পড়ুন। আমার ভাড়াটা দিয়ে দেন। আমি চলে যাব।"

- "ওহহ। দাঁড়ান আমি নামছি। কখন এলাম বুঝতেই পারিনি বাড়ির সামনে।"

নেমে গেল রিকশা থেকে আবির। ভাড়া মিটিয়ে বাসার দিকে পা বাড়াল।

কলিংবেলের শব্দ শুনে শ্রুতি দরজা খুলে আবিরের অবস্থা দেখে পুরো থ হয়ে গেল যেন! কারণ তার স্বামীকে এই অবস্থায় কখনো দেখে নি শ্রুতি। পুরো চোখ মুখ লাল করে আছে। মনে হয় কান্না করেছে অনেক। চেহারাটা শুকিয়ে খুব বাজে হয়ে আছে! ব্যাপারটা এমন য়ে, অবেকদিন ধরে অসুস্থ থাকলে মানুষ যেভাবে শুঁকিয়ে যায়, বাজে অবস্থা হয়ে যায়, ঠিক সেরকম হয়ে গেছে।

শ্রুতি কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে এমন অবস্থায় হঠাৎ আবির শ্রুতিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হু-হু করে কান্না শুরু করে দিল। সে কি কান্না৷ এক ছোট বাচ্চার মতো কান্না! শ্রুতিও নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। সেও আবিরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকের মাঝে নিয়ে কান্না শুরু করে দিল। কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করার বদলে শ্রুতি নিজেও কান্নায় জড়িয়ে পড়ল। দুই জনে একসাথে কান্না করতে লাগল। শেষে শ্রুতি কান্না মাখা আদুরে কন্ঠে আবিরকে জিজ্ঞেস করল,

- "আমার বাবুটার কি হয়েছে? এভাবে কান্না করছ কেন গো তুমি? কি হয়েছে আমাকে খুলে বল। কোনো সমস্যা হয়েছে সোনা?"

কিন্তু আবির কোনো উত্তর দিল না শ্রুতির এসব কথায়। কিছু না বলাতে শ্রুতি আবার জিজ্ঞেস করল। কিন্তু আবার কিছু বলল না।  আরও দুইবার বলার পর আবির মুখ খুলে "মা" বলে একটা শব্দ করে আবার কান্না শুরু করে দিল!

- "মা মানে? কি হলো আবির তোমার? মা শব্দের মানে? কান্না করার কারণ জানতে চাইলাম তোমার থেকে, আর তুমি মা বলে আবার কান্না করছ? ব্যাপার কি?"

- "আমার মাকে দেখলাম আজ শ্রুতি!"

- "কিহ?"

শ্রুতি ভ্রু কুচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আবিরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল। কারণ এই আবিরের এই কথাটা শ্রুতি বিশ্বাস করতে পারল না! সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। শ্রুতি জানে আবিরের মা গ্রামে আছে। বড় ভাই আর তার বউয়ের সাথে গ্রামে থাকে। এখানে কোনোমতেই থাকার কথা না।

- "মাকে দেখলাম আজ খুব বাজে ভাবে রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করছে। এই শহরের রাস্তায় একটা পুরাতন জীর্ণ-শীর্ণ কাপড় পড়ে পায়ে স্যান্ডেল ছাড়া অবস্থায়!"

- "কোথায় গো? কোন রাস্তায় দেখেছ? তুমি কি সত্যি দেখেছ নাকি চোখের ভুল ছিল? তোমার মা তো তোমাদের গ্রামে। তাহলে এখানে কেন আসবে?"

আবির এবার কান্না থামিয়ে নিল। তারপর সব ঘটনা খুলে বলতে লাগল এক এক করে শ্রুতিকে। সব শুনে শ্রুতি বলল,

- "আচ্ছা কাল তো আসবে বলছে মা গহনার দোকানে গহনাগুলো বিক্রি করার জন্য। তাহলে কাল চল আমিও যাব তোমার সাথে।গিয়ে ওনি কোথায় থাকে? এখানে কেন এসেছে? কি জন্য এসেছে? গ্রাম ছেড়ে এখানে কি জন্য এসেছে। এসব বিস্তারিত জেনে নেব। আর সম্ভব হলে এখানে নিয়ে আসব। তুমি যেভাবে মাকে দেখেছ, আর যেসব কথা বর্ণনা করছ, সেসবের উপর ভিত্তি করে আমি বলতে পারি, মায়ের বড় কোনো সমস্যা হয়েছে! তোমাদের পরিবারে কিছু হয়েছে। না হলে তোমার মা এখানে কেন আসবে? এই শহরে তার কাজ কি?"

- "এসব প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই শ্রুতি। উত্তর জানার জন্য মনটা বড়ই ব্যকুল হয়ে উঠছে। আর মা এখানে আমার সাথে আসবে না। মা তো আমাকে তার সামনে মুখ না দেখাতে বলছিল। আমি বাড়ির সবার শত্রু হয়ে গেছিলাম। সুতরাং মা আমাকে ভুলে গেছে হয়তো। মনেই নেই আমার কথা আর মায়ের।"

চলুন ফিরে দেখা যাক সে সময়। যখন আবির তার বড় ভাই নিবিড় আর মা শাহিনা বেগমের পরিবারের ছিল।

আবির তার বাবাকে দেখেনি। আবির জন্মের আগে তার বাবা মারা যায় এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায়! শাহিনা বেগমের পেটে তখন তার দ্বিতীয় সন্তান আবির। আর বড় সন্তান সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। তাদের আর্থিক সচ্ছলতা বেশ ভালো ছিল। অনেক সম্পত্তি ছিল আর শাহিনা বেগম সরকারি চাকরিজীবি ছিল বিধায় সেদিকে কোন চিন্তা ছিল না। সম্পত্তির লোভে শাহিনা বেগমকে অনেকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু এক বাক্যে শাহিনা বেগম না বলে দিয়েছিল। তার শুধু একটা শ্বপ্ন ছিল আবির আর নিবিড়কে মানুষের মত মানুষ করে গড়ে তুলবে।

দিন, মাস, বছর করে করে বেশ কয়েক বছর পেরিয়ে যায়। কর্মস্থল থেকে শাহিনা বেগম অবসর গ্রহণ করেন। বড় ছেলে নিবিড় ডাক্তারিতে এমবিবিএস করে বের হয়ে সরকারি মেডিকেলে সেবা দিতে থাকে। ছোট ছেলে আবির এইচএসসি পাশ করে রেজাল্টের জন্য অপেক্ষায় থাকে।

বড় ছেলে নিবিড়ের বিয়ের জন্য ইতিমধ্যে পাত্রী দেখার তোড়জোড় শুরু হয়। এটা নিবিড়ের কানে যেতেই, সে জানিয়ে দেয় তার পছন্দের একজন মেয়ে আছে এবং তারা বিয়ে করতে চায়। তারা দুজন দুইজনকে ভালোবাসে।

ব্যাপারটা সবার দৃষ্টিগোচর হওয়ার পর পরবর্তীতে দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে হয়ে যায় নিবিড় আর তার পছন্দ করা মেয়ের সাথে।

বিয়ের পর থেকে আবিরের সাথে নিবিড়ের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঝগড়া শুরু হতে থাকে। বিয়ের পরে কিছুদিন ভালো সম্পর্ক ছিল, কিন্তু তার পরে সব বিষয় নিয়ে ঝগড়া শুরু হয়।

ক্রমশ...
298 Views
4 Likes
1 Comments
3.5 Rating
Rate this: