আমাদের বাড়ির সাথে লাগোয়া পুকুর। পুকুরটা সবাই ব্যবহার করে। আমাদের গ্রামে এই একটাই মাত্র পুকুর যেটাতে এলাকার সবাই নিজেদের ইচ্ছেমতো ব্যবহার করতে পারে। অন্যকোনো পুকুর থাকলেও তাতে সবাই ব্যবহার করতে পারে না।
আপনারা সবাই হয়তো জানেন যে আমি কী পরিমাণ পুকুরপ্রেমী আর কী পরিমাণ প্রকৃতিপ্রেমী। এই প্রচণ্ড গরমে রাত ১১ টা বা ১২ টা অবধি অনায়াসে পুকুরপাড়ে বসে কাটিয়ে দিই। ভালোই লাগে আমার। এটা শুধু গরমকাল বলে কথা না, শীতকালেও সেম। গায়ে চাদর মুড়িয়ে, শীতের কাপড় পড়ে একদম পরিপাটি হয়ে বসে থাকি! কখনও মশা কামড়ায়, কখনও পোকা ডিস্টার্ব করে তবুও আমার ওখানে বসতে হবে।
এই পুকুরপাড় আমার জীবনের একটা পার্ট মনে হয়। আমার ভালো-খারাপ, হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ সহ সকল ভালো খারাপ কাজের স্বাক্ষী বহন করে। কখনো পুরো দুনিয়া ঘুমালে আমি উঠে পুকুরপাড়ে বসে থাকি। পুকুরপাড়ের সাথে আনমনে কথা বলি, হাসি, মজা করি! কত অভিযোগ জানায়, না পাওয়ার আপসোস করি, কত রকমের মানুষজন দুনিয়াতে আছে তাদের নিয়ে সমসাময়িক আলোচনা করি পুকুরপাড়ের সাথে! পুকুরপাড় কিন্তু আমার সাথে কথা বলে। আমাকে বুঝে, তার মাঝে আমি আমার অস্তিত্ব খুঁজে পাই। নিজেকে আপন করে ভেবে নেয় একমাত্র ঐ পুকুরপাড়!
পুকুরপাড় নিয়ে আমার এই পাগলামো সবাই জানে বাড়িতে। সেটা নিয়ে আগে বিশাল বিশাল লেকচার দিত বাবা মা। কিন্তু আমি সে লেকচার এক কান দিয়ে ঢুকাতাম আর অপর কান দিয়ে বের করে নিতাম। এখনো দেয় না বলে কথা নেই, সুযোগ পেলে ঝাড় দিতে আস্ত রাখে না। এরিমধ্যে ছোটবোনও আবার জুটেছে। কোনো কিছু এদিক ওদিক হলে আমার বিপক্ষে মায়ের কাছে নালিশ দেয়, "সব ঐ রাত বিরাতে পুকুরপাড়ে বসে থাকার জন্য হচ্ছে! পুকুরপাড়ের পেত্নী তোমার ছেলের উপর ভর করে আছে। তাই তোমার ছেলে কোনোকিছু করতে পারছে না। তাড়াতাড়ি ভুত তাড়ানোর ব্যবস্থা কর। তাহলে বেঁচে যাবে। না হলে সেও মরবে, আমাদেরও মারবে!"
যে যতই যা বলুক না কেন, আমি পুকুরপাড় ছাড়তে পারব না এটা সবাই ভালো করে জানে। ইদানীং দেখছি গরম থেকে বাঁচতে অনেকেই পুকুরপাড়ে বসছে। কিন্তু আমি যেই জায়গায় বসি সাধারণত সেই জায়গায় কাউকে বসতে দিই না।
তো এবার মূলকথায় আসা যাক। ঈদের আমেজ সবদিকে শেষ হয়ে গেলেও, আমাদের এদিকে কিছুটা এখনো আছে। কারণ আমাদের চট্টগ্রামের মানুষ খুব ঘুরাঘুরি করে। একজনের বাড়িতে বেড়াতে গেলে কমপক্ষে কয়েকদিন তো থাকবেই। যদি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত আত্নীয় হয়, তাহলে তো সপ্তাহ দুয়েক না থেকে আসে না। এটা আবার সবার ক্ষেত্রে হয় না। যে সমস্ত মানুষের সারাদিন খাওয়া দাওয়া ছাড়া অন্যকোনো কাজ-কর্ম নেই, বাড়িতে বাবা মায়ের বেকার সন্তান হিসেবে অচল মাল হয়ে পড়ে আছে তাদের ক্ষেত্রে বেশি।
সেরকম একদল অচল মানুষকে দেখছি আজ কদিন ধরে আমার এক চাচার বাড়িতে! খাচ্ছে, ধাচ্ছে, ঘুরছে আর সবার সাথে মজা-মাস্তি করছে। সবগুলো মেয়ে! একটি মাত্র ছেলে। তাদের সাথে আবার আমার ছোটবোনও যোগ দিয়েছে। তাদের গাইড হয়ে যেখানে সেখানে যাচ্ছে! তাদের নিয়ে আসা যাওয়া করছে।
গতরাতে ঘটে গেল একটা ভয়ঙ্কর ঘটনা। আমি আমার অভ্যেস মতো পুকুরপাড়ে গিয়ে বসে ছিলাম। চুপচাপ করে একমন একধ্যানে পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ঘরম সহ্য করতে না পেরে একটা স্যান্ডোগেঞ্জি আর একটা লুঙ্গি পড়েই বসেছিলাম। রাত মোটামুটি গভীর অন্ধকার ছিল কালকে। তবে আমার মনে হয় নি। কারণ মানুষের অভয়ব ভ্যারিফাই করতে খুব বেশি দূরত্বের প্রয়োজন ছিল না।
আমি বসার কিছু সময় পর কারেন্ট চলে যায়৷ তখন চাচার বাড়িতে থাকা সকল রিলেটিভরা মানে যারা বেড়াতে এসেছে তারা বাইরে বেরিয়ে আসে। বাইরে বের হতেই পুকুরপাড়ের দিকে তাকিয়ে একজনে বিশাল চিৎকার দিয়ে উঠে! তারা নাকি পুকুরপাড়ে ভুত দেখেছে! কাউকে বসে থাকতে দেখেছে! যে মেয়েটা দেখে সে ঐ অবস্থায় মাটিতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে! বাকীরা সবাই ভয়ে চুপসে যায়।
আওয়াজ শুনে আমি তাদের কী বিপদ হয়েছে ভেবে তাদের কাছে এগিয়ে যায়। গিয়ে দেখি বাড়ির গৃহকর্ত্রী মেয়েটার মাথায় পানি ঢালছে! মেয়েটার মুখে পানি ঢালতেই মেয়েটা জেগে উঠে তারপর বলে, ভুত! ভুত আপু তোমাদের ঐ পুকুরপাড়ে ভুত আছে! এইমাত্র আমি কিছু দেখেছি। কুচকুচে কালো রঙের!
মেহমানরা বাদে আমাকে জানে এমন লোকজন ওখানে যারা উপস্থিত ছিল সবাই আমার দিকে তাকিয়ে বড় বড় করে ঢোক গিলতে থাকে! তাদের আর বুঝতে বাকী রইল না তারা আমাকে দেখে ভুত ভেবে ভয় পেয়েছে! তবুও চাচা সিউর হওয়ার জন্য ভিড়ের ভেতর থেকে আমাকে টেনে একপাশে সরিয়ে আনে আর আমাকে জিজ্ঞেস করে, "ওটা কি তুই? মানে তোকে দেখে কী ওরা ভয় পেয়েছে?"
আমি চাচার দিকে তাকিয়ে বললাম, "আমাকে দেখে কেন ভয় পাবে? আমাকে কী প্রথম দেখছে নাকি ওরা? হ্যা, তবে আমি ওখানে আধাঘন্টা ধরে বসে ছিলাম। তারপর হঠাৎ চিৎকারের আওয়াজ শুনে কী হয়েছে দেখতে এলাম।"
চাচা এবার আমার দিকে তার দুই দাঁত খুলে একটা গোয়েন্দা মার্কা হাসি দিয়ে চলে গেল। আমিও বাড়িতে ঢুকে শুয়ে পড়লাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দাঁত মাজতে মাজতে মুখ ধুতে যখন পুকুরের ঘাটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি তখন কোত্তেকে চাচা এসে আমার সামনে হাজির হলো আর বলল, "বাপ বড়ই উপকার করলি তুই আমার! বড় খরচের হাত থেকে বাঁচালি আমাকে!"
চাচার এমন কথা শোনে আমি বেকুব হয়ে গেলাম। তবুও ক্যামনে কী করলাম এটা জানার জন্য জিজ্ঞেস করলাম, "চাচা, আপনার কথা তো কিছু বুঝতে পারছি না আমি। আমি আপনার খরচ বাঁচিয়ে দিলাম কীভাবে?"
"আরে গতকাল রাতে তোকে ভুত ভেবে আমার শালিরা ভয় পেয়ে গেছে! বলছে এখানে ভুত আছে। থাকবে না! তারা তো পারলে রাতেই চলে যেত। এখন ভোরবেলা হতে না হতেই ওরা চলে গেছে। তাদের বিদায় দিয়ে আমি তোকে শুকরিয়া জানাতে এলাম। কারণ তুই না হলে ওরা যেত না!"
"মানে? চাচা স্পষ্ট করে বলেন তো কী বলার! ওরা না গেলে বা কী আর গেলেও বা কী?"
"আরে চারদিন ধরে এসেছে আমাদের বাড়ি। কিছুতেই যাচ্ছিল না। এদিকে পকেটের স্বাস্থ্য ও খারাপ হয়ে আসছিল। পাচঁজন মানুষ, প্রতিদিন নাশতা, নানারকম ভালো খাবার দিয়ে ভাত আর পারছিলাম না। তোর চাচির ভয়ে কিছু বলতেও পারছিলাম না। তাই বাহানা খুঁজছিলাম কীভাবে তাদের তাড়ানো যায়৷ শেষে তোকে দেখে ভুত ভেবে এতই ভয় পেয়ে গেছে যে ভোরের আলো ফুটতেই চলে গেছে। আগে যদি জানতাম তাহলে ওরা আসার পরের দিন তোকে ভুত হিসেবে কারিশমা দেখাতে বলতাম তাদের সামনে!"
আমি চাচার এমন কথা শোনে তো 'থ' হয়ে গেলাম! অবাক হয়ে গেলাম! চাচাকে উদ্দেশ্য করে বললাম, "হাড়কিপটে কোথাকার"
চাচা মুচকি হাসি দিয়ে বলল, "তোর চাচিকে ভুলেও বলিস না যেন!"
অতিথি তাড়ানো ভুত
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
185
Views
3
Likes
1
Comments
3.0
Rating